হিজরি নববর্ষ ও আশুরা : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মহানবী (সা.)-এর মদীনা হিজরতকে ভিত্তি করে প্রবর্তিত বর্ষপঞ্জি গোটা পৃথিবীর মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনুসরণীয় কাল নির্দেশিকা। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) সময়ে নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করে হজরত আলীর (রা.) প্রস্তাব অনুযায়ী রাসূল (সা.)-এর হিজরতের ঘটনাকে মাইলফলক হিসেবে গণ্য করে চান্দ্রমাসের গণনা অনুযায়ী ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নতুন সন পঞ্জিকা চালু করেন আমিরুল মুমিনিন।

বর্ষ গণনার সূত্রপাত কখন থেকে হয় এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, বর্ষ গণনার সূচনা হয় প্রাচীন মিসরে অথবা ব্যাবিলনে। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৪১ সালে সর্বপ্রথম বর্ষ গণনা আরম্ভ হয়। হিজরি সালের মতো চন্দ্র মাস অনুসারেই তখন সময় নির্ণয় করা হতো। পরে সৌর বছর গণনার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। প্রাচীন আরবে যখন মানুষের মধ্যে গোত্রগত বিভাজন ছিল এবং বিভিন্ন গোত্র তাদের নিজস্ব স্বাধীনতায় পরিচালিত হতো, তখন সেখানে নানা ধরনের বর্ষ গণনা ছিল। আরববাসী প্রায় সবাই ছিল ব্যবসায়ী। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য তাদের নিকট তখন একটা আন্তর্জাতিক বর্ষ গণনাও ছিল। কোনো কোনো সাহাবী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম তারিখ থেকে সাল গণনার প্রস্তাব দেন। আবার কেউ তার নবুওয়াত লাভের সাল হতে গণনা শুরু করার প্রস্তাব দেন। কেউ নবী (সা.)-এর মৃত্যুর তারিখ হতে নতুন সাল গণনার কথা বলেন। হজরত ওমর (রা.) সবার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেন, যদি নবী করীম (সা.)-এর জন্ম তারিখ ধরা হয় তবে সেটা খ্রিষ্টানদের অনুকরণ করা হবে, তারা ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখ থেকে সাল গণনা শুরু করেছে।

অন্যদিকে মৃত্যুর সাল গণনা করলে সেটা হবে জাহেলি যুগের অনুকরণ। হজরত ওমর (রা.) ও সাহাবীগণ অনুভব করছিলেন যে, সাল গণনা প্রত্যেক জাতির জাতীয় অস্তিত্বের একটি মৌলিক ভিত্তি। নিজস্ব সন তারিখ একটি জাতির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। জাতির উত্থান-পতন, জন্ম-মৃত্যু, জয়-পরাজয়, উন্নতি-অগ্রগতির সমুজ্জ্বল ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এ সাল।

নানাবিধ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে স্বয়ং হযরত ওমর (রা.) নিজস্ব একটি প্রস্তাব পেশ করে বলেন ইসলামের একটি যুগান্তকারী ঐতিহাসিক দিন হিজরত থেকে সাল গণনা শুরু করা হোক। সবাই এক বাক্যে এ প্রস্তাব গ্রহণ করে।

কিন্তু বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত উল্লিখিত প্রথাসমূহ প্রত্যাখ্যান করে সাহাবীগণ একটা অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। আর তা হচ্ছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি সাল গণনা শুরু করা। কেননা ইসলামের নবীর হিজরত শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। এটাকে স্মরণীয় করে রাখতেই রাসুল (সা.)-এর উম্মতের জন্য প্রণীত হয়েছে হিজরি বর্ষপঞ্জি। হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস ধরা হয় মহরমকে। এই মাস ইসলামের আগেও সম্মানিত ছিল। আরবরা এই মাসসহ চার মাসে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ রাখত। অন্য তিন মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও রজব। ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের বাণী তাদের কাছে না থাকলেও আরবরা মহরম থেকেই বছরের শুরু হিসাব করত এবং হজের মৌসুম তিন মাস ও রজব মাসের সম্মান করত।

মহরম মাসের দশম তারিখকে বলা হয় আশুরা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শেষ নবীর উম্মত পর্যন্ত অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী ও স্মারক হয়ে রয়েছে দিনটি। শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়, ইহুদি ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছেও দিনটি অনন্য মর্যাদার অধিকারী।

বস্তুত আশুরার এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক নবীর স্মৃতি। মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থেকে এই দিন তারা এক স্থানে মিলিত হন। হজরত নূহ (আ.)-এর জাহাজ কয়েক মাস প্লাবনের পানিতে ভাসার পর এই দিনে জুদি পাহাড়ের গায়ে এসে লাগে। হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে সমকালীন জালেম শাসক আগুনে নিক্ষেপ করলে আল্লাহর নির্দেশে সেই আগুনের গর্ত পরিণত হয় ফুলের বাগানে। এই দিনেই ঘটনাটি ঘটেছিল। হজরত ইদরিস (আ.)-কে এই দিন উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। হজরত ইউসুফ (আ.) দীর্ঘকাল পর এই দিন পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.) ও মায়ের সঙ্গে আবার মিলিত হন। হজরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘকাল রোগভোগের পর এই দিন আরোগ্য লাভ করেন। হজরত মূসা (আ.) এই দিনে তূর পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অনন্য মর্যাদা লাভ করেন। ফেরাউনের কবল থেকে হজরত মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের নিষ্কৃৃতি লাভের ঘটনাও ছিল এদিনে। এভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিবছর আশুরার দিন। তেমনি কিয়ামতও এই দিনেই সংঘটিত হবে বলে মহানবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।

কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে একটি ঘটনা এই দিনের অন্যসব স্মৃতিকে ম্লান করে দিয়েছে। শেষ নবী (সা.)-এর আদরের নাতি, হজরত আলী (রা.) ও হজরত ফাতেমা (রা.)-এর নয়নমণি হজরত হুসাইন (রা.) ও তার সাথিরা বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত কুফা নগরীর অদূরে কারবালা প্রান্তরে এই দিনেই নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন ইয়াজিদ নিযুক্ত আঞ্চলিক গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনীর হাতে। ৭০ জনের কিছু বেশি সদস্যের প্রায় সবাই ছিলেন নবী পরিবারের যুবক ও কিশোর। এ ঘটনার স্মৃতি প্রতিটি মুসলমানের মনে আবেগের ঢেউ তোলে। এমনকি কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস অবলম্বন করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য, মহাকাব্য ও উপন্যাস।

তবে আশুরার দিনটিকে নিছক শোকের উপলক্ষ হিসেবে পালন করা ইসলামের মৌল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আশুরা শোক নয়, ইবাদত ও উপলব্ধির দিন। বরং হজরত হুসাইনের আত্মত্যাগ ও অবিচলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করার অঙ্গীকার এ দিনের প্রধান আবেদন।

তিরমিজী শরীফে হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)-এর একটি উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেন, আরবরা জাহেলী যুগেও আশুরার দিনে রোজা রাখত। আল্লাহর রাসূল (সা.)ও এদিন রোজা রাখতেন। তারপর তিনি হিজরত করে মদীনায় এসে নিজেও রোজা রাখলেন, মুসলমানদেরকেও রোজা রাখার আদেশ দিলেন। পরে যখন রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আয়াত নাজিল হলো, তখন থেকে আশুরার রোজা নফল বা ঐচ্ছিক হয়ে গেল। আরেক বর্ণনায় অছে, আল্লাহর শেষ নবী (সা.) মদীনায় এসে দেখলেন, এখানকার ইহুদিরা রোজা রেখেছে এবং এদিনটিকে তারা বিশেষ মর্যাদা দেয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, হজরত মূসা ও বনি ইসরাইলকে এই দিনে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দান করেছিলেন। এজন্য হজরত মূসা (আ.) এদিনে রোজা রাখতেন। এ কথা শুনে মহানবী (সা.) ইরশাদ করলেন, হজরত মূসার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ। এই বলে তিনি মুসলমানদেরকে আশুরার দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। তবে তিনি মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য আশুরার আগের দিন বা মহরম মাসের নবম তারিখেও রোজা রাখার পরামর্শ দিলেন।

অতএব আশুরার দিনের প্রধান কর্তব্য রোজা রাখাসহ ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকা। শোক মিছিল ও এ জাতীয় কর্মকাণ্ড ইসলাম সমর্থিত নয়। এগুলো বিদয়াত। এগুলো পরিহার করা প্রয়োজন। বরং শ্রেষ্ঠ নবীর অনুসারীরা এ শুভ লগ্নে তাদের কর্তব্য ও পালনীয় সম্বন্ধে সচেতনতার নবায়ন করবে। ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর দৃঢ়বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ হয়ে মুসলিম মিল্লাত আবার এগিয়ে যাবে নিজেদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে- এটাই আমাদের কামনা।

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //