নিয়মিত লোডশেডিং

দিনে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা করে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং এবং সপ্তাহে একদিন পেট্রল পাম্প বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাদুঘরে রেখে দেওয়া লোডশেডিং ফিরে এসেছে বিপুল বিক্রমে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং আগামীতে তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে বলে বিদ্যুৎসংশ্লিষ্টরা সতর্কবাণী দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য থেকে জানা যায়, দিনে গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। জ্বালানি গ্যাসের সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। তাই সারাদেশে লোডশেডিং বাড়ানো হয়েছে। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী তাদের নিজস্ব মালিকানাধীন ৪৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ১৮টিতে পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না, আর গ্যাস সংকট আছে গ্যাসনির্ভর ২৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) চাহিদার চেয়ে প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম সরবরাহ পাচ্ছে। এ সংস্থার চাহিদা প্রতিদিন ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। রাজধানীর আরেক বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) সরবরাহ কমেছে দিনে ২০০ মেগাওয়াট। এ সংস্থার দিনে চাহিদা ১ হাজার মেগাওয়াট, কিন্তু পাচ্ছে কমবেশি ৮০০ মেগাওয়াট।

এ তো গেল রাজধানীর চিত্র। যে কোনোভাবে ঢাকাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলে সবসময়। তাই ঢাকায় থেকে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের দুরবস্থা অনুমান করা যায় না। একে তো প্রচণ্ড গরম তার উপর বিদ্যুৎ নেই। নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না, কিন্তু দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। পরিমাণের দিক দিয়ে যা ৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো। গত কিছুদিন ধরে ৮০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে আরইবিকে। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করা হচ্ছে ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোয়। রংপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, বগুড়ায়ও বেড়েছে লোডশেডিং। সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুরেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা, কোনো কোনো এলাকায়। ভুক্তভোগীরা বলছেন বিদ্যুৎ যাচ্ছে এবং আসছে না দীর্ঘসময়।

সরকারসংশ্লিষ্টরা যদিও এখন বলছেন, তারা আগেই অনুমান করেছিলেন, নজর রাখছিলেন, বিশ্ববাজারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা আকস্মিক। কারণ এই তো কদিন আগে ২১ জুন ১ হাজার ৩২০টি পায়রা উড়িয়ে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনের পর দেশের শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।

ব্যাপারটা অনেকটা ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেট লেখার মতো। সেখানে কারণ যা-ই লেখা থাক না কেন, আত্মীয়স্বজন একটা কথাই বুঝতে পারে যে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যু হয়েছে। তেমনি করোনাপরবর্তী উল্লম্ফন, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি নানা কারণের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু ফলাফল লোডশেডিং এবং দু-এক দিনের মধ্যেই আসবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা। 

কয়েক দিন আগেও খুব জোরের সঙ্গেই বলা হতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেককেই অবাক করেছে। উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট, গ্রিড সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট, নির্ভরযোগ্য উৎপাদন ক্ষমতা ১৭ হাজার মেগাওয়াট আর চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। প্রেসক্লাবের এক আলোচনা সভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জানালেন, বিদ্যুৎ এত বেশি আছে যে আমরা এখন পরিবহন খাতে বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা ভাবছি। সেই ভাবনা এত দ্রুত বিদ্যুৎ ঘাটতির দুর্ভাবনায় পরিণত হয়ে গেল কেন তা একটা বিরাট প্রশ্ন। তাহলে কি মন্ত্রীরা বিশ্বপরিস্থিতি জানতেন না, নাকি বাস্তবতাকে চাপা দেওয়ার জন্য বাগাড়ম্বর করতেন? 

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে সারাদেশে চার হাজার ২শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উৎপাদন আর চাহিদার মধ্যে ফারাক অনেক। গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান খসড়া-২০১৭ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চাহিদা অনুযায়ী গড়ে ১৯৬৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি হবে।

২০১১ সালে ফরাসি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান স্ল্যামবার্জার এক সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিল, বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে কিছু সংস্কার ও পরিবর্তন আনলে তিন বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ কোটি (৫০০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাসের উত্তোলন বাড়ানো সম্ভব। সমীক্ষা চালিয়েছিল তৎকালীন সরকার যারা এখনো ক্ষমতায় কিন্তু পদক্ষেপ নেয়নি এক কদমও।

আবার সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয় করেছে ২০১২ সালে ও ভারতের সঙ্গে ২০১৪ সালে। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এবং ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের কাছ থেকে পেয়েছে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। ব্যাপক প্রচার এবং উৎসাহের পর কী করা হয়েছে সেখানে?  তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অথচ মিয়ানমার ঠিকই সেখানে গ্যাস পেয়েছে। ইতোমধ্যে ৮ বছর চলে যাচ্ছে!

দেশের গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন ও সেখান থেকে উত্তোলনের কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই হঠাৎ করে ২০১৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে বলা শুরু হয় যে গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। যে গ্যাস আছে, তা দিয়ে আর ১৫ বছর চলবে। ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর এক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছিলেন, সামনে কঠিন দিন আসছে। ১৫ বছর পর দেশের গ্যাস একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। বাপেক্স ২০২১ সালের মধ্যে ১০৮টি কূপ খননের মাস্টারপ্ল্যান করেছিল, কিন্তু উদ্যোগ ও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল কি, সে প্রশ্নের জবাব নেই।

হিসাব অনুযায়ী এ কথা জানা ছিল যে গ্যাসের সংকট হবে। আর আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৬০ শতাংশের বেশি গ্যাসভিত্তিক। তাহলে পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছিল এই ঘাটতি পূরণের জন্য? বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়েকটি বিষয় তো প্রধান। যেমন- গ্যাস, কয়লা, ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, পারমাণবিক শক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সৌর শক্তি, পানি, বাতাস, জৈব বর্জ্য ইত্যাদি লাগে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উৎপাদন কেন্দ্র লাগে, সঞ্চালনের জন্য সঞ্চালন লাইন লাগে, আর লাগে গ্রাহকের চাহিদা এবং সক্ষমতা অর্থাৎ দাম। বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মোহে কি জ্বালানির বিষয় খেয়াল করা হয়নি নাকি দাম যা-ই হোক দেবে তো জনগণ এই নীতিতে আচ্ছন্ন ছিলেন তারা। তন্দ্রা কেটে যাওয়ার পর দেখছেন দেশে প্রয়োজনীয় গ্যাস নেই, আর বিদেশেও দাম বেশি। অতএব জাদুঘর থেকে লোডশেডিং ফিরে আসছে শুধু নয়, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াও শুরু হবে।

একদিকে আতঙ্ক ছড়ানো, অন্যদিকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নেওয়া সমানতালেই চলতে থাকে। তখনই তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার তথ্য প্রচার করার কারণ হচ্ছে উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা। তাই করা হয়েছে। এভাবেই গ্যাস খাতকে স্বাবলম্বী করার পরিবর্তে আমদানিনির্ভর করা হয়, যার বিষময় ফল ভোগ করছে দেশবাসী। গ্যাস উৎপাদন কমছে, এলএনজির দাম আকাশছোঁয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়ছে। লোডশেডিং মেনে নেওয়া আর বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা ছাড়া জনগণের সামনে বিকল্প রাখা হয়নি।

ক্ষমতায় যারা থাকেন, বলতে খুব পছন্দ করেন যে, তারা সব জনগণের কথা ভেবেই করেন। এখন লোডশেডিং হচ্ছে ভুক্তভোগী কে? জনগণ। এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়বে, কে দেবে? জনগণ। বেশি দামে তেল, এলএনজি কিনতে হচ্ছে, ভর্তুকি বাড়বে। কে দেবে? জনগণ। জনগণ ছাড়া তাদের আর কেউ নেই। কিন্তু এ সব কিছুর সুবিধা কে পাবে? জনগণের দুর্ভোগ একদল মানুষের মুনাফা অর্জনের সুযোগ তৈরি করে দেবে আবার। অজুহাত বিভিন্ন হলেও জনগণের দুর্ভোগ ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি চলতেই থাকবে।

 

লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //