অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে

বিখ্যাত অভিধানকার হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় (১৮৬২-১৯৫৯ খ্রি.) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুণমুগ্ধ গুণী। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক। একদা তিনি ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতার চিত্র’ নামে এক নিবন্ধে তিনটি কবিতার আলোচনাও করিয়াছিলেন। একটি কবিতার নাম ‘শেষ শিক্ষা’। হরিচরণ মনে করেন এই কবিতার মূলসূত্র ‘অন্যায়’। আমরা আগাইয়া বলিব, ‘অন্যায় ও তাহার প্রতিকার’। একালের কবিরা রবীন্দ্রনাথের বড় সমঝদার নহের জানিয়াও আমরা তাহাদের বলিব পড়িতে দোষ কি!। কাহিনী বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধিলাভ হইয়াছিল।

‘শেষ শিক্ষা’ নামক শিখজাতির দশম ও শেষ শুরু গোবিন্দসিংহ (১৯৭৫-১৭০৮)। ইনি হলেন মারাঠাজাতির অধিপতি শিবাজির যুগে জন্মাইয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার কাহিনী হরিচরণ যেভাবে সংক্ষেপ করিয়াছেন আমরা এখানে তাহার মাত্র সারগ্রহণ করিতেছি। ‘বীর গুরু’ নামা নিবন্ধে ঠাকুর নিজও একবার কাহিনীটা গদ্যযোগে লিখিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, “গোবিন্দের মৃত্যুঘটনা বড়ো শোচনীয়”।

শিখগুরু গোবিন্দ একদিন নিভৃতে আপনার জীবনকথা- “অখন্ড ভারত অধিকারের সংকল্পিত বিষয়”- ভাবিতেছিলেন। তাঁহার মনে হইতেছিল এই প্রৌঢ় বয়সে সে বিষয় ‘শতধাবিকীর্ণ, সংশপ্রান্ন সংকটসংকুল”। তিনি ভাবিতেছিলেন তবে কি ইহা ভ্রম? জীবন কি ব্যর্থ? এমন সময় এক পাঠান আসিয়া বলিল,“কাল দেশে যাইব, আপনি যে ঘোড়া কিনিয়াছেন তাহার দাম চাহি”।

গুরু গোবিন্দ বলিলেন,“শেখজি, সেলাম, দাম কাল পাইবে, আজ ভাই যাও।” পাঠান জোর করিয়া বলিল, “আজই দাম চাহি।” বলিয়াই জোর করিয়া হাত ধরিয়া গুরুকে চোর বলিয়া গালি দিল। তৎক্ষণাৎ অসিঘাতে পাঠানের মুন্ড স্কন্ধচ্যুত, ভূমি রক্তসিক্ত হইল। নিজের কাজ দেখিয়া গুরু বলিলেন, অসি আজ অনর্থক রক্তপাতে লক্ষ্যচ্যুত হইল। এই পাপ দূর করিয়া যাইতে হইবে। জীবনের এই শেষ কাজ। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন, “এই অন্যায়কার্য করিয়া তাহার অত্যন্ত অনুতাপ উপস্থিত হইল।”

পাঠানের একটি শিশুপুত্র ছিল। নাম মাহমুদ। রবীন্দ্রনাথের বানানে ‘মামুদ’। গোবিন্দ তাহাকে আনিয়া পুত্রবৎ প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। ক্রমে যুবা হইল তাহাকে তিনি শাস্ত্রবিদ্যা শিখাইলেন। সেও গুরুজিকে পিতার মতো ভক্তি করে, তাহার সঙ্গে থাকিত, মৃগয়ায় সঙ্গী হইত। একদিন গুরু বলিলেন,“মাহমুদ, অস্ত্র লও, আমার সঙ্গে আইস”। বলিয়া গুরু ধীরে ধীরে বনে এক নদীতীরে উপস্থিত হইলেন। ইঙ্গিতে যুবা দাঁড়াইল। তখন আকাশ সন্ধ্যার তরল তিমিরে পরিব্যাপ্ত। গুরু বলিলেন, “এই স্থান খোঁড়”। একটু খুঁড়িতেই একখন্ড শিলা উঠিল। গুরু বলিলেন, “শিলায় এই যে লোহিত রাগ, তাহা তোমার পিতার রক্তধারা। ঋণ শোধ না করিয়া এইখানে তাহাকে কাটিয়াছিলাম। এক্ষণে প্রতিশোধ গ্রহণ কর।” রবীন্দ্রনাথের গদ্যে, “আমি তোমার পিতাকে বধ করিয়াছি, তুমি যদি তাহার প্রতিশোধ না লও তবে তুমি কাপুরুষ ভীরু।” অথবা পদ্যে :

“রে পাঠান, পিতার সুপুত্র হও যদি
খোল তরবার, পিতৃঘাতকেরে বধি
উষ্ণরক্ত-উপহার করিবে তর্পণ
তৃষ্ণাতুর প্রেতাত্মার।” 

গুরুর উত্তেজনার কথায় রক্তনেত্র পাঠান বীর হুংকার ছাড়িয়া পহিলা লাফ দিল। তাহার পরই গুরুর পায়ে পড়িল। কাঠের মূর্তির মত হইয়া গুরু স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রইলেন। মাহমুদ অস্ত্র ফেলিয়া দিল। বলিল :

“হে গুরুদেব, লয়ে শয়তানে
খেলো না এ কলঙ্কের খেলা ধর্ম জানে
ভুলেছিনু পিতৃরক্তপাত; একাধারে
পিতা গুরু বন্ধু বলে জেনেছি তোমারে
এত দিন। ছেয়ে যাক মনে সেই স্নেহ,
ঢাকা পড়ে হিংসা যাক মরে। প্রভো, দেহো
পদধূলি।”

এই কথা বলিয়াই যুবক উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া বন হইতে বাহির হইয়া গেল। ফিরিয়া চাহিল না। ফিরিয়াও আসিল না। পাপের প্রায়শ্চিত্তের আয়োজন ব্যর্থ হইল। তাই-রবীন্দ্রনাথ লিখিতেছেন-

“দুই বিন্দু জল
ভিজাইল গোবিন্দের নয়নযুগল।”

পরদিন হইতে মাহমুদ দূরে দূরে থাকে। গুরুর সঙ্গে মৃগয়ায় যায় না। ডাকিলে নিভৃতে গুরুর সঙ্গে দেখা করে না। একদিন গুরু মাহমুদের সঙ্গে শতরঞ্চ খেলা আরাম্ভ করিলেন। বার বার হারিয়া যুবা খেলায় মাতিয়াছে। রাত্রি ঝাঁ ঝাঁ করিতেছে, দৃকপাতও নাই, যুবা হেঁট হইয়া খেলিতেছে। তখন হঠাৎ শুরু শতরঞ্চের বল ছুঁড়িয়া যুবার শিরে আঘাত করিলেন। অট্টহাসিতে ফাটিয়া পড়িলেন। বলিলেন “আমি তোমার পিতাকে বধ করিয়াছি, তুমি যদি তাহার প্রতিশোধ না লও তবে তুমি কাপুরুষ ভীরু।”

পিতৃঘাতকের সাথে খেলা করে আসি
এমন যে কাপুরুষ, জয় হবে তার?
অমনি বিদ্যুৎ হেন ছুরি খর ধার
খাপ হতে খুলি লয়ে গোবিন্দের বুকে
পাঠান বিধিয়া দিল। শুরু হাস্যমুখে
কহিলেন, “এতদিনে হল তোর বোধ
কী করিয়া অন্যায়ের লয় প্রতিশোধ।
শেষশিক্ষা দিয়া গেনু-আজ শেষবার
আশীর্বাদ করি তোরে হে পুত্র আমার”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাহিনীটা পুরাপুরি বানাইয়া লেখেন নাই। ইহার পিছনের কিছু ঘটনা ইতিহাসের। কিছুটা তাঁহার আপন মনের। শিখ জাতির সামরিক শক্তির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া গুরু গোবিন্দসিংহের খ্যাতি। প্রথম জীবনে গোবিন্দজি ডাকাত ছিলেন। পাহাড়ি রাজা আর মোগল ওমরাহের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়া বেড়াইতেন। এইসব সংঘাতের এক অধ্যায়ে তাঁহার দুই পুত্রকে মৃত্যুদন্ড দিয়াছিলেন সরহিন্দের মোগল সুবাদার। এক পর্যায়ে তিনি মোগলদের অধীনে চাকরিও লইয়াছিলেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর শাহ আলম ওরফে বাহাদুর শাহ গোবিন্দকে পাঁচ হাজার অশ্বারোহীর অধিপতি (মনসবদার) করিয়া দেন। এসায়ি ১৭০৮ সালে দাক্ষিণাত্যের নন্দরে জনৈক আফগানের হাতে শুরু গোবিন্দ সিংহ নিহত হইয়াছিলেন। এই সত্য ঘটনার উপর কল্পনার রঙ্গ দেখচি চড়াইয়া রবীন্দ্রনাথ পাক ঘন্ট রাঁধিয়াছেন। সত্য প্রমাণ করিয়াছেন তাহারই প্রাণের বাণী :

“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে”।

রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন, গোবিন্দের অনুচরেরা সেই পাঠানকে ধরিবার জন্য চারিদিকে হইতে ছুটিয়া আসিল। গোবিন্দ তাহাদিগকে নিবারণ করিয়া বলিলেন, “আমি উহার কাছে অপরাধ করিয়াছিলাম। ও তাহার প্রতিশোধ দিয়াছে। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিবার জন্য আমিই উহাকে এইরূপ পরামর্শ দিয়াছিলাম। উহাকে তোমরা ধরিয়ো না।”

আর একটু: “অনুচরেরা গোবিন্দের ক্ষতস্থান সেলাই করিয়া দিল। কিন্তু জীবনের প্রতি বিরক্ত হইয়া গোবিন্দ এক দৃঢ় ধনুক লইয়া সবলে নোওয়াইয়া ধরিলেন, সেই চেষ্টাতেই তাঁহার ক্ষতস্থানে সেলাই ছিঁড়িয়া গেল ও তাঁহার মৃত্যু হইল।”

দোহাই
১. হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৪০৬)
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইতিহাস, পুলিন বিহারী সেন ও প্রবোধচন্দ্র সেন সংকলিত (কলিকাতা: বিশ্বভারতী, ১৩৯৫)
৩. Vincent A. Smith, The Oxford Of India, 3rd Ed. Percival (Oxford: Clarendon Press, 1961)

লেখক : অধ্যাপক, ইউল্যাব ইউনিভার্সিটি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //