‘হবে জয়... ওহে বীর নির্ভয়’

শ্রমিকদের লোহার ছাঁচ ভাঙতে হবে

শ্রমিকদের বেতন লোহার ছাঁচে ঢেলে এমনভাবে নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে যাতে শ্রমিকরা কোনো রকমে শুধু শুকনো রুটি খেয়ে কেবলমাত্র সন্তান বৃদ্ধি করে যেতে পারে। বেতন যদি খুব কমে যায় তাহলে শ্রমিকরা ক্ষুধায় মরতে থাকে শ্রমিকের অভাব দেখা দেয়। শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে। আর যদি বেতন বাড়ে তাহলে শ্রমিকের যোগান বেড়ে যায়। আর শ্রমিকের যোগান বাড়লেই বেতন কমবে। এইভাবে শ্রম আর বেতনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা হয়।

‘ক্ষুধার কারাগারে শ্রমিকরা চিরবন্দী, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত।’ শতবর্ষ পার করা মে দিবস এমিলি জোলার অঙ্কুরের শ্রমিকদের জীবন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের শ্রমিকদের বের করে আনতে পারেনি। আগামী কততম মে দিবসে দেশের শ্রমিকদের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। আমাদের শ্রমিকরা কি লোহার ছাঁচ ভেঙে বের হয়ে আসবে?

শ্রমিকদের বাজারদর অনুপাতে মজুরি নির্ধারণের দাবি সর্বত্র। কিন্তু মালিকরা শ্রমিকদের শ্রমশক্তি সস্তায় কিনতে চায়। ন্যায্য মজুরি দিতে চায় না। যুগযুগ ধরে শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে আর মালিকরা মজুরি নির্ধারণে টালবাহানা করেই চলে। শ্রমিকরা ব্রিটিশ আমলে সংগ্রাম করেছে পাকিস্তানি আমলে সংগ্রাম করেছে আজ স্বাধীন বাংলাদেশেও সেই সংগ্রামই চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের সরকারগুলো সব সময় মালিকদের পক্ষে থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে চলেছে। কোনো সরকারই শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ করেনি বরং পদে পদে বিরোধিতা করেছে। প্রাপ্তি হিসেবে এই আন্দোলন সংগ্রামের মাঝে যা জুটেছে তাকে প্রাপ্তি বলা চলে না। অথচ দেশের শ্রমিকদের চাহিদা ছিল খুবই সামান্য। জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার মতো মজুরি যাতে দুবেলার অন্ন জোটে, আব্রুরক্ষার বস্ত্র জোটে, মাথা গোঁজার ঠাঁই জোটে আর চিকিৎসার সুযোগ পায়। আর এই সামান্য দাবি পূরণের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার।

স্বাধীন দেশে একজন মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রয়োজন হয়। শ্রমিক এবং মালিক সবার জন্য এগুলো প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের দুর্দশার হাত থেকে বাঁচার সংগ্রামে জীবনপাত করে চলায় মুক্তি অর্জনের কথাই চিন্তা করতে পারে না। তাই সমমনাদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংঘ করতেও অনীহা। দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত আছে মাত্র ২০/২১ লাখ। এই পরিসংখ্যান শ্রমিক স্বার্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলেও মালিক পক্ষের জন্য প্রচণ্ড লাভজনক। শ্রমিকশ্রেণির এই অনীহাই তাদের বঞ্চিত থাকার প্রধান কারণ। শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ যে কোনো অসাধ্য সাধন করতে পারে। নিজেদের রূপান্তর করতে পারে। বদলে দিতে পারে শোষণের সব বেড়াজাল। কিন্তু মালিকশ্রেণির পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শ্রমিকশ্রেণিকে বিভক্ত করে রেখেছে। শ্রমিকশ্রেণি রাজনীতির পাশাপাশি সংগঠনিকভাবে নেতৃত্বের কোন্দলে, অঞ্চলগতভাবে এবং ধর্মগতভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। সাথে সাথে একে অন্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত থাকছে।

শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে ফেলার কারণে দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে নিয়োজিত থাকতে পারছে না। তারা রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে। এরা কোনো শ্রমিক আন্দোলন সফল করতে দেয় না। সরকার পক্ষের শ্রমিক সংগঠন আন্দোলন সংগ্রামের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বা দায়সারা সমর্থন দিয়ে আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেয়। সাধারণ শ্রমিকদের সাথে সরকার সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্দোলন আন্দোলন খেলা চালিয়ে যায়। যা কিছু নেতার ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়তা করে। দেশে এখন এমন অসৎ নেতৃত্ব এমনভাবে জাঁকিয়ে বসেছে যা সাধারণ শ্রমিকদের গলায় ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে। শ্রমিক নেতৃত্ব রাজনীতির হাতে, সরকারের হাতে, প্রশাসনের হাতে, আমলাদের হাতে শ্রমিক স্বার্থ বিক্রি করে দিচ্ছে। এরা শ্রমিক আন্দোলন নষ্ট করে চলেছে। শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে নিজেরা কোটিপতি শ্রমিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। 

আমাদের শ্রমিক সংগঠনগুলো যতদিন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে ততদিন শ্রমিক স্বার্থ বা শ্রমিক কল্যাণ কঠিন। নিজেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সচেতনভাবে কাজ করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি শুধুমাত্র শ্রমিকদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাই না। সমগ্র জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত পাট, সুতা, বস্ত্র, ইস্পাত ও চিনি ইত্যাদি শিল্পকে ধ্বংস এবং বন্ধের প্রক্রিয়ায় সরকারের সাথে সরাসরি যুক্ত থেকে সরকারদলীয় শ্রমিক সংগঠন কিভাবে দেশ ও জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে তা জনগণ জানে এবং দেখেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বিদেশি অর্থের আশায় সরকার একের পর এক বৃহৎ শিল্পগুলো ধারাবাহিকভাবে বন্ধ করে চলেছে এবং নীরবে তা দেখা ভিন্ন অন্য কোনো ভূমিকাই পালন করতে দেখা যায়নি ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের শ্রমিক সংগঠনের। 

বাংলাদেশে বর্তমানে গার্মেন্ট সেক্টর খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হওয়ায় গার্মেন্ট মালিকরা সরকারের সহযোগিতায় আইন-কানুনের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার মূল কারিগরদের প্রতি ন্যূনতম করুণা মালিকদের যেমন নেই, সরকারেরও তাই। শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হয় সরকারের বোধকরি কোনো করণীয় নেই। অথচ শ্রমঘন এই শিল্পে ১৮/২০ লাখ শ্রমিক নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে যাদের মধ্যে নারী শ্রমিকদের প্রাধান্য দেখা যায়। শুধু নারী প্রাধান্য নয়, এদের মধ্যে শিশু-কিশোরের একটা বড় অংশ রয়েছে। এরাই হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পের মুনাফা অর্জনের প্রধান হাতিয়ার। এদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুনাফা অর্জন করলেও এই শ্রমিকদের জন্য সরকার মালিক ও শ্রমিক সংগঠন সম্মিলিতভাবে সামান্য খুদ-কুড়ার অঙ্গীকার করে তারও কার্যকারিতা দেখা যায় না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করার বিনিময়ে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারে না। এই শ্রমিকরা মালিকদের নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি সংগ্রহ করতে না পারলে কি হবে, মালিক পক্ষ দ্বিধাহীন চিত্তে প্রায়শই এই শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারছে।

দেশের কৃষি খাত সবচেয়ে নাজুক যা দিনে দিনে অবহেলিত খাতে রূপান্তরিত হচ্ছে। কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে জনঘনত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি খাতের প্রধান নিয়ামক কৃষক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা। ১৯৪৭ সালে ৪ কোটি মানুষের খাদ্য ঘাটতি হলেও বর্তমানে ১৫ কোটি মানুষের খাদ্য ঘাটতি প্রকৃত অর্থে নেই বললেই চলে। আমাদের কৃষক রেকর্ড পরিমাণ তিনগুণ খাদ্য উৎপাদন করার সুফল সরকার ভোগ করছে। অথচ সরকারি নীতির কারণে কৃষি খাতে জাতীয় বরাদ্দ শতাংশের হিসেবে তলানিতে ঠেকেছে, জনসংখ্যা ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির কারণে কৃষি জমি কমেছে, কৃষি উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য না পাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তি হ্রাস পেয়ে চলেছে। এই চক্রের মধ্যে গ্রামে এক শ্রেণির শহুরে জমিদার সৃষ্টি হচ্ছে।

কৃষি বলতে এখন তারাই, কৃষকদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সরকারি যত সুযোগ সুবিধা এদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত। আর ক্ষুদ্র কৃষক বিভিন্ন প্রতিকুলতার মধ্যে নিজ জমিতে দু’মুঠো অন্নের আশায় শ্রম দিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তার নিজের শ্রমের কোনো মূল্য উৎপাদন মূল্যের মধ্যে রাখে না। তারপরও ফসলের উৎপাদিত মূল্যের সাথে বাজার দামের সামঞ্জস্য পায় না। ফলে ঋণের জালে জড়িয়ে কৃষক ক্ষুদ্র থেকে প্রান্তিক এবং প্রান্তিক থেকে ভূমিহীন হয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। অসংঘটিত কৃষকদেররক্ষা করা না গেলে জাতির খাদ্য নিরাপত্তা কঠিন।

শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। জীবন মানের সংকট থেকে দূরে থাকা যাবে না। নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে নিজেদের সতর্ক হতে হবে। জাতির সিংহভাগ মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে হবে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। নিজেদের সকল দুর্বলতা দূরে সরিয়ে রেখে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করতে পারলেই মুক্তির পথ পাওয়া যাবে। দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে কোনো সাফল্য পাওয়া যাবে না। ঐক্যের অসীম শক্তি দিয়ে লোহার ছাঁচ ভাঙতে হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কায়িক শ্রমদানকারীর ঘণ্টাপ্রতি মূল্য নিম্নে ৪০ মার্কিন ডলার তা বাংলাদেশে মাত্র ৬ সেন্টের মতো। দেশের শ্রমিকশ্রেণি এখান থেকেই নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তির জন্য লোহার ছাঁচ ভাঙায় উদ্যোগী হতে পারে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়-

‘হবে জয়, হবে জয়, হবে জয় রে,

ওহে বীর নির্ভয়।

ছাড় ঘুম, মেলো চোখ, অবসাদ দূর হোক,

আশার অরুণালোক হোক অভ্যুদয় রে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //