স্বজাতির শাসনের ৫০ বছর : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্র মুক্তিকামী মানুষ দলে দলে বের হয়ে পথে নামা। রাজনৈতিক মিমাংসার পাশাপাশি চলা অসহযোগিতা। উত্তাল সারাদেশ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে প্রস্তুত মানুষ আর প্রস্তুতির প্রধান হাতিয়ার লাঠি! 

প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে মানুষ সেদিন দলে দলে তৈরি হয়েছিল সংগ্রামের জন্য। অসহযোগের মধ্যেই রাজনৈতিক আলোচনা ভেঙ্গে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের উপর। ঘোষিত হয় স্বাধীনতা, শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। অমিতবিক্রমে সারাদেশের মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসে স্বয়ংক্রিয় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের সামনে। ছোট ছোট দল যতই এগিয়ে চলে সেনানিবাসের দিকে ততই তা জনসমুদ্রের আকার ধারণ করে। বেশ কিছু বিদ্রোহী বাঙালি সেনার সাথে যোগ দেয় জনগণের বিশাল বহর। অস্ত্র ৩০৩ রাইফেল, লাঠি আর মরিচের গুড়া!

দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। এক কোটি মানুষের দেশ ত্যাগ করে পাশ্ববর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ, ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন দান আর ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বাঙালি দাঁড়ায় বিজয়ীর বেশে। ‘রক্তে বাংলা লাল করার’ কবির বক্তব্যকে বাস্তবে প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত দেশের স্বাধীনতার পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল অতীতের ঘুণে ধরা সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। সব রকমের শোষণের হাত থেকে মুক্তি হবে তাদের। অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত হবে। জনগণভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে। এসব প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই রচিত হয় ৭২-এর সংবিধান। 

জন্মাবধি আন্দোলন সংগ্রামে নিপীড়িত দেশের সাধারণ মানুষের অনেক ছোট ছোট প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনতাকে ঘিরে। বিদেশি শাসনের অবসানে দেশে স্বজাতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবারে সম্মিলিত কর্মকাণ্ডে গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি হবে। সবার মৌলিক চাহিদা পূরণের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থী তৈরিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আন্তরিক হবে। রাস্তা-ঘাট, অবকাঠামো শিল্প-কারখানা সবকিছুরই প্রসার ও উন্নতি হব। দেশে বেকার সমস্যা থাকবে না। গ্রাম আর শহরের মধ্যে বৈষম্য দূর হবে। কৃষক-শ্রমিকের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। নারীর অধিকার নিশ্চিত হবে। চিকিৎসা সেবার উন্নতি হবে। আমলাতন্ত্র দায়িত্ব সচেতন হবে। জনগণের সেবক হবে। যুব সমাজ আত্মপ্রতিষ্ঠায় নিবেদিত হবে। বাংলাদেশ বিশ্বসমাজে যোগ্যতার প্রমাণ রেখে স্থান করে নেবে। রাজনীতি জনকল্যাণে নিবেদিত হবে। মানুষের মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা বাড়বে। সাম্প্রদায়িকতা অঙ্কুরিত হবে না। ঘুষ, দুর্নীতি সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ হবে। বাংলাদেশ হবে স্বনির্ভর । 

এইসব স্বপ্ন বুকে নিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী পালন করেছে। রক্তস্নাত ও কঠিনতম মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন দেশের এই যে পথচলা, এই পথ চলা খুব সহজ ছিল না। বিপদসংকূল পথে নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করেই ৫০ বছরের বিজয়ের আনন্দ পালন।  এ আনন্দ সাধারণ জনগণ মুক্ত বিহঙ্গের মতো জীবন উপভোগ করবে সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এসব আনন্দ কতটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সেটা বিচার্য্য। বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে। এখন উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ায় দৌড়ে আছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, মানুষের আয়ু বেড়েছে। গ্রামের মানুষ বিদেশে শ্রম বিক্রি করে নিজের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে। পোষাক শিল্পে কাজ করে নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আধুনিকতার সুবাতাসে কৃষির উৎপাদন বেড়েছে। জনসংখ্যা বেড়েছে। হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট এখন লক্ষ কোটি  টাকার বাজেটে রূপান্তর হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। শতভাগ পাশের টার্গেট অর্জনের পথে দেশ জোর কদমে এগিয়ে চলছে। দেশের সর্বত্র এখন উন্নতির ছোঁয়া। অনেকেই দাবী করে থাকেন দেশের এ অগ্রগতি অভুতপূর্ব, অভিনব। দেশ এখন বিশ্বে বহু কিছুরই রোল মডেল। 

বাংলাদেশের চরম উৎকর্ষ ও অগ্রগতির এ যাত্রা স্বাধীনতা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে কিনা তা আজ বিশাল প্রশ্ন। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজ বহুদূরে পড়ে আছে। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা মানুষদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া, সম্পদের পাহাড় তৈরি করা, নিজেদের রাজা মনে করা, এক শ্রেণীর মানুষের কোটি কোটি টাকা নিজেদের ভোগবিলাসের নামে অপচয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিপরীতে আর এক শ্রেণীর মানুষের তিন বেলা অন্ন সংস্থান করতে জীবনপাত করতে হচ্ছে । দেশের মানুষের মাথার উপর থেকে ছাদ সরিয়ে নিয়ে বিদেশে ‘বেগম পাড়া’ তৈরি হচ্ছে, কখনও দেশে আশ্রয় দেবার নামে প্রস্তুতকৃত ছাদ ভেঙ্গে পড়ছে সাধারণ মানুষেরই মাথায়। ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ার ধ্বস, রিজার্ভ চুরি, খেলাপি ঋণ, সিণ্ডিকেট ব্যবসা. চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি দেখছে দেশের মানুষ। দেখছে স্বাধীন দেশে কীভাবে স্বাধীনতা ভোগ করছে এক শ্রেণীর জনগণ। তারা হাজার টাকা দিয়ে বালিশ কিনছে, ৩৭ হাজার টাকা দিয়ে পর্দা কিনছে, লাখ-লাখ টাকা দিয়ে কিনছে নারকেল কিংবা কলাগাছ। খিচুড়ি রান্না আর পুকুর কাটা শিখতে যাচ্ছে বিদেশে। 

কী বিচিত্র চেতনার মধ্যে আমাদের বসবাস। 

একশ্রেণীর ক্ষমতাবান তাদের সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে, স্থায়ী বসবাস নিশ্চিতই শুধু করেনি। অনেকে পরিবারকে বিদেশে রেখেছেন। এই ক্ষমতাবানদের সামান্য ঠাণ্ডা লাগলে তারা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য ছুটছেন। দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি যদি ন্যূনতম বিশ্বাস আর ভরসা থাকতো তবে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তারা নিজ ও পরিবারের জন্য বিদেশ নির্ভর হয় কিভাবে? অথচ এদের হাতেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির চাবিকাঠি। মানসম্মত শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা এই বিদেশমুখী ব্যক্তিরা কিভাবে নিশ্চিত করবে তা সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে। স্বপ্নে পাওয়া বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থাকে হাতিয়ার করে এরা সাধারণ মানুষের উপর দেশপ্রেমের আস্ফালন চাপিয়ে দিচ্ছে। 

দেশের এমন কোনো পেশাজীবী নেই যারা রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়নি। সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করার ফলে পেশাজীবীদের পেশার প্রতি যেমন উদাসীনতা সৃষ্টি হয়েছে, পাশাপাশি তারা অবৈধ আয় এবং তা ভোগের লালসায় উচ্ছিষ্টভোগীতে পরিণত হয়েছে। আমলা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকদের সাথে ব্যবসায়ী শুধু নয়, ছাত্রনেতারা পর্যন্ত দলে ভিড়েছে। নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সকলেরই অনীহা। সাধারণ মানুষ সেবা চাইতে গেলে তখন এদের স্পিড মানির প্রয়োজন পড়ে। শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ায় আর কোচিং বাণিজ্য করে, চিকিৎসকরা প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে আর ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও ওষুধ কোম্পানীর সাথে কমিশন বাণিজ্যে যুক্ত হয়, প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের সাথে যোগসাজশ করে আর ভুল পরিকল্পনা করে। তারা আবার কোনো প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে ও ব্যয়ে শেষ না করার বাণিজ্যেও লিপ্ত। ব্যবসায়ীরা সিণ্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ায় আর ভেজাল মেশানোর বাণিজ্য চালায়, ছাত্র নেতারা তাদের ঐতিহাসিক ইতিবাচক ইমেজকে পিছনে রেখে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস ও অর্থপাচারের বাণিজ্যে নিবেদিত। আমলা একাই সব দায়িত্ব নিতে চায়। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সবার মাথার উপর লাঠি ঘোরাতে চায়। পুলিশ ও আইনজীবীদের কাছ থেকে সেবা পেতে গিয়ে সাধারণ মানুষ বলে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার দাবী করলে শুরুটা যে তাদের দিয়েই করতে হয়। 

দেশের প্রতিটা সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন না করার সংস্কৃতি তৈরির ফলে আর দুর্নীতি, দালালি, তেলবাজি করার অবাধ স্বাধীনতায় দেশ-বিদেশে অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর এভাবেই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি চলমান। মুক্তিযোদ্ধারা যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে গিয়েছিল, আজকের গাজীরা তা ভুলে আত্মস্বার্থ পূরণে নিবেদিত। নিজেদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য ধরে রাখতে না পারায় দিনে দিনে তাঁরা লক্ষ্যের যোজন যোজন দূরে চলে গিয়েছেন। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ভিত শক্ত হয়েছে তাই শুধু নয়, সনদের ভাগীদারও হয়েছে। দেশে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিদের হত্যা করা হয়েছে। ৭২-এর সংবিধানকে গুলি করে ফুটো করে দেয়া হয়েছে। আত্মস্বার্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ক্ষমতাবানরা আজ শুধু নিজের জীবনেরই নয় দেশের সকল অর্জনই বিসর্জন দেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। 

তবে এত অপ্রাপ্তির মধ্যেও প্রত্যাশার ফুল ফুটছে। যুদ্ধ করে বাঁচানো ফুলটি আজ ম্লান হয়ে গেলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে উন্নয়ন হয়নি একথা সর্বৈব মিথ্যাচার। উন্নয়ন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় হওয়া তা কেউ রোধ করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আন্দোলনের মধ্যে আটকা পড়ে থাকলেও  প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার মৃত্যু হয়নি। এসবের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে নতুন প্রজন্ম। যারা স্বজাতির শাসনে নিজেদের মাটি, নিজেদের দেশ নিজেদের ফসল, নিজেদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে আমাদের আশ্বস্ততার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে । 

জয়তু বাংলাদেশ।


লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //