গ্রামবাংলার পরিবহন

দেশে উন্নয়ন বৈষম্যের কারণে শহর ও গ্রামের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। অনেক গ্রামেই এখনো ন্যূনতম আধুনিক সুবিধা পৌঁছায়নি। অতীতে গ্রামের মানুষের জীবনে গতি ছিল না। গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে গতি এনে দিয়েছে চায়নার তৈরি শ্যালো মেশিন। শ্যালো মেশিনের যে কত বিচিত্র ব্যবহার দেখা যায় তা এককথায় কল্পনাতীত। দেশি নৌকায় শ্যালো ইঞ্জিনের ব্যবহার দিয়ে গতির যাত্রা শুরু। তারপর আর গ্রামের সাধারণ মানুষ থেমে থাকেনি। গ্রামে ঘরের বারান্দায় বসেই ধান ভেঙ্গে নিচ্ছে, মসলা গুড়া করে নিচ্ছে, গম বা চালের আটা তৈরি করে নিচ্ছে। আরো কত কী!

সর্বশেষ গ্রামবাংলার মেঠোপথে যাতায়াতের রিকশা-ভ্যানে এই ইঞ্জিন সংযোগ করে জীবনের গতি ফিরিয়ে এনেছে। আজ গ্রামবাংলার পরিবহন হিসেবে শ্যালো ইঞ্জিনের নসিমন, করিমন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, সমাদৃত হয়েছে। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পরিবহনটি জনপ্রিয় হলেও শহরের এলিট শ্রেণির মানুষের জন্য সমস্যার পাহাড়। শহরের মানুষ তাদের ব্যবহৃত সড়ক-মহাসড়কে এই যানটি দেখতে চায় না। প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেই চলেছে। যেভাবেই হোক যানটির চলাচল বন্ধ করেই তবে শান্তি।

গ্রামবাংলার পরিবহন হিসেবে নসিমন-করিমন অল্পদিনেই নিজের স্থান পাকা করে নিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই পরিবহনে যাতায়াত করছে। গ্রামে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী নিয়মিত শহরে এসে অফিস করতে পারছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ার সহজ সুযোগ নিতে পেরেছে। রাত-বিরাতে গ্রামের অসুস্থ মানুষটাকে শহরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসতে পারছে। কর্মজীবী মানুষ দূরে কোনো জায়গায় শ্রমবিক্রি করে সন্ধ্যায় নিজ বাড়ি ফিরে আসতে পারছে। গ্রামের উৎপাদিত ফসল কম সময়ে শহরে এনে বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে। গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে সাইকেল-রিকশা-ভ্যানের পরিবর্তে এই ইঞ্জিনচালিত যানটি যে বিস্ময়কর গতি এনে দিয়েছে তা আমাদের গ্রামের দিকে না তাকালে বোঝা যাবে না। 

বাংলাদেশের পরিবহন খাতে এলিট শ্রেণির পেশাজীবীদের অবদান বলতে রাজধানী ঢাকাতে চলাচলকারী মিশুক। দেশের এতগুলো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তার বিশাল বিশাল ডক্টরেটধারীদের অবদানের কথা যত কম বলা যায় ততই নিজেদের সম্মান রক্ষা হয়। বিপরীতে নসিমন-করিমনের বিপ্লব শহরের এলিট শ্রেণির মানুষের লজ্জা দেয়। এই যানটির উদ্ভাবনে শ্রমজীবী মানুষের ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়। মাটির কাছাকাছি থেকে গ্রামবাংলার মানুষের জন্য পরিবহন গড়ে তুলেছে। শুধু তাই নয়, দেশের সরকারি-বেসরকারি যে কোনো পরিবহনের তুলনায় যাত্রী ভাড়া কয়েকগুণ কম। স্বল্প ব্যয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ এখন যাতায়াত করতে পারে, মালামাল পরিবহন করতে পারে। গায়ে ঘামের গন্ধ ও অল্প দূরত্বের কারণে, যে পরিবহনগুলো গ্রামের শ্রমজীবী মানুষকে তাদের পরিবহনে তুলতো না আজ তারাই আন্দোলন করছে। লাইসেন্স নেই, রুট পারমিট নেই, দুর্ঘটনা ঘটায় দাবি তুলে সড়ক-মহাসড়কে চলাচল বন্ধ করার জন্য মিটিং-মিছিল-ধর্মঘট করছে। পেশীশক্তি ব্যবহার করতে পিছপা হচ্ছে না।

দেশের প্রশাসন এলিট শ্র্রেণির পথ নির্বিঘ্ন করে থাকে। তাই তারাও গ্রামবাংলার পরিবর্তন হিসেবের মধ্যে নিতে চায় না। তারা প্রতি মাসে সভা করে নসিমন-করিমন বন্ধের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত করে যাতে পাকা রাস্তায় যাতে করে এই যানটি না আসতে পারে। মাঝে যেসব কারখানায় যানটি তৈরি করা হয় তা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রাত-বিরাতে অভিযানও চালানো হয়। প্রশাসনের এমন উদ্যোগ দেখে আশান্বিত হতে হয় যে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য কত? দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রশাসনের কত চিন্তা! দেশের সড়ক দুর্ঘটনার একমাত্র কারণ- যেন গ্রামবাংলার এই যানটি। তাই এই যানটি এলিট শ্রেণির দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখতে চায়। তাহলেই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। 

নসিমন-করিমন শুধু গ্রামীণ জীবনে গতি দিয়েছে তাই নয়, বহু বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। গ্রামের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক সম্মানজনক আয়ের পথ পেয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হয়েছে। দেশের এলিট শ্রেণির মানুষের এই যানটির জন্য কোনো অবদান না থাকার কারণেই চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। গত ২৫ বছরে গ্রামবাংলার আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন বিবেচনায় নিলে বর্তমান প্রশাসনের কার্যক্রমকে গণবিরোধী আখ্যায়িত করা যায়। বরং দেশের সাধারণ মানুষ আশা করেছিল এতগুলো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত একটি এই যানটির পাশে এসে দাঁড়াবে। তারা প্রায়োগিক বিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহার করে যানটির কিছু পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে ত্রুটিমুক্ত করতে সহযোগিতা করবে। গ্রামের মানুষকে নিরাপদে চলাচলের সুযোগ করে দেবে। পরিচালনা ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা করে আরো সুলভ করে দেবে। দৃষ্টিনন্দন, আরামদায়ক ও মসৃণ চলাচলে আরো উন্নত করার উদ্যোগ থাকবে।

কালের বিবর্তনে হয়তো অনেক কিছুই হবে কারণ প্রস্তুতকারীরা নিরলস চেষ্টা করে চলেছে। সাধারণ জনগণ রাস্তার অভিজ্ঞতার পাশে শিক্ষাকে চেয়েছিল মাত্র। কিন্তু সবকিছুকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাধররা প্রগতির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করে চলেছে। এখন যানটি প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যে চলাচল করছে। আর এই হুমকি একশ্রেণির মানুষের আয়-রোজগারের পথ করে দিয়েছে। চাঁদাবাজির ভাগ না মিললেই ভাংচুর, মারামারি, নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। 

বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে বর্তমানকালে চলা সম্ভব নয়। আমরা দেশে সেই অসম্ভব কাজটা করতে চাই। দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা মানুষকে টেনে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চাই। বিজ্ঞানের পরিশীলিত ব্যবহার জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তা অনুভব করলেও স্বার্থের টানে অস্বীকার করার প্রবণতা আমাদেরকে আজ বাধ্য করছে নসিমন-করিমন বন্ধ করার উদ্যোগী হতে। দেশের ক্ষমতাবানদের ভাবা প্রয়োজন দেশ ও জনগণের কল্যাণের কথা। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে অন্ধ হয়ে প্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থান কাম্য নয়। গ্রামবাংলার মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে তৈরি নসিমন-করিমনকে জাতির সামনে নিয়ে এসেছে। গ্রামবাংলার আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় এসেছে জাতি যানটির পাশে দাঁড়াবে না কি বিরুদ্ধাচরণ কর। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //