ভারত কলোনি-সম্পর্ক চায়, করিডোর না

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ‘প্রথম আলো’ তাদের কলকাতা প্রতিনিধির একটি খবর ছেপেছে। খবরটি হলো, বিহারের ‘পাটনা থেকে আসাম ধুবরীও না, একেবারে পান্ডু পর্যন্ত জলপথে এখন পণ্য পরিবহন শুরু হলো’- যা উদ্বোধন করেছেন ভারতের কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-উপমন্ত্রী। মানে ভারতের পণ্য এখন ভারতেরই এক অংশ থেকে আরেক অংশে চলাচল করবে; কিন্তু এই পথের মাঝখানে তারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের  ভেতরের বিস্তর নৌপথ ব্যবহার করবে। আর তা একেবারে কলকাতা হয়ে বাংলাদেশের খুলনা-নারায়ণগঞ্জ-চিলমারী হয়ে আসামের ধুবরী-পান্ডু পর্যন্ত পরিবহন করবে।

কিন্তু এতে বাংলাদেশের কী লাভ? আসলে কোনো লাভই নেই, বরং ক্ষতি আছে। তবু সেটা ঢাকতেই যেন সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো একটা বাক্য আছে ওই প্রতিবেদনে। আর সেটি হলো, ‘এর ফলে এ বন্দর নিয়ে বাংলাদেশেরও পণ্য আমদানি-রফতানির এক নতুন পথ খুলে যেতে পারে।’ অর্থাৎ একটা কথার কথা, যা নিশ্চিত করে বলা কোনো বাক্য নয়। হলেও হতে পারে ধরনের বিষয়। আর বাস্তবে এমন হবার কোনো কারণই নেই। কেন?

৮৭ শতাংশ professionals can’t name all northeast India states.

কারণ ভারতের নর্থ-ইস্ট ভূখণ্ড, যার মধ্যে আসাম সবচেয়ে বড় রাজ্য। আর বাকি এখনকার আরও ছয় রাজ্য (যারা আলাদা রাজ্য হয়েছে ১৯৭২ সাল থেকে) এর আগে আসাম রাজ্যের অংশ ছিল অথবা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ছিল, যা কার্যত আসাম থেকে পরিচালনা করা হতো। আসামসহ এরা সবাই মোটামুটি আগে-পিছে ১৯৭২ সালের পরে আলাদা আলাদা সাত রাজ্য (সিকিমকে সঙ্গে ধরলে আট রাজ্য) হিসাবে ভারতের নয়া প্রশাসনিক রূপ পায়।

কিন্তু এই নর্থ-ইস্ট ভারতের অপর অংশ বা মূল ভারত ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত কেবল পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমে। এই সংযুক্তি কেবল জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি অঞ্চলের ১৮ মাইল করিডোর আছে, যা শিলিগুড়ি করিডোর নামে পরিচিত। সোজা কথা হলো, পশ্চিমবঙ্গ আর আসাম কেবল এই ১৮ কিলোমিটার অংশেই সরাসরি সংযুক্ত। বাকি সবখানেই পশ্চিমবঙ্গ আর নর্থ-ইস্টের  মাঝে বাংলাদেশ ভূখণ্ড আছে। 

মজার কথা হলো, ওই ১৮ মাইল দিয়ে সারা নর্থ-ইস্ট মূল ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হলেও, ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত তারা এ জন্য অখুশি ছিল না। যোগাযোগ নেই এই বোধ তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। তারা কখনই মূল-ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে আকুল- এমন কোনো বক্তব্য কোথাও ব্যক্ত করেননি। এমনকি উলটাভাবে বাংলাদেশি মুসলমানরা আসামে গিয়ে বসতি নির্মাণ করতেছে এই অভিযোগ প্রবলভাবে তুলতো। আর এর সমাধান হিসেবে নর্থ-ইস্ট বা আসামকে বাংলাদেশে থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং সীমান্তে কড়াকড়ি নজরদারি বাড়ানো ইত্যাদি ছিল তাদের প্রধান দাবি। আর আসামে মুসলমান মানেই তারা বাংলাদেশি। তাই তাদের বহিষ্কার করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরে ১৯৫১ সালে প্রথম কংগ্রেসের নেতৃত্বে এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। 

সার কথায় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই- এমন কোনো দাবি কোথাও ছিল না। এ ছাড়া যখন কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তখন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা এর বিরুদ্ধে কলাম ছেপেছিল। আর সেই কলামে বলা হয়েছিল, আসাম আসলে নিরিবিলি শান্তিতে থাকতে চায়। যার বিস্তারিত বাক্যগুলো ছিল- ‘এতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল চীনের সামনে হাট করে খুলে দিতে হবে। ওই এলাকার স্পর্শকাতরতার কথা মাথায় রেখে যা চায় না ভারত। বরং জাপান, সিঙ্গাপুরের মতো রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রকল্প উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এনে সেখানকার মানুষের মন জয়ের চেষ্টা হয়েছে গত পাঁচ বছরে। উদ্দেশ্য চীন যাতে সেখানে কোনো প্রভাব তৈরি করতে না পারে’।  

তাহলে এ কালের ভারত,  মানে ২০০৭ সালে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভারত বা আসামের জন্য সব ধরনের করিডোর দিতে হবে বলে জেগে উঠেছিল কেন? ভারতও তা হাসিল করার চেষ্টা করে গেল কেন? যে করিডোর লাভের আরও একটা আলাপ হলো, এখন বিহার থেকে বাংলাদেশ হয়ে আসাম নৌপথ হাসিল করা!

এক্সক্লুসিভ করিডোর : ছোট্ট করে বলা মূল কথাটা হলো, ভারতের চীন ভীতি। আসাম বা নর্র্থ-ইস্টের ওপারের উত্তরেই হলো চীনের তিব্বত অঞ্চল। মানে হলো ভারতের নর্থ-ইস্ট বা আসামের সঙ্গে আসাম-তিব্বত সীমান্ত। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আসাম সব ধরনের করিডোর নিতে গিয়ে সেসব সুবিধা আবার তারা কোনোভাবেই চীনের জন্যও উন্মুক্ত করে দিতে চায় না। চীন তিব্বত থেকে আসাম পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আসামের সেই করিডোর চীনও ব্যবহার করুক- এটা ভারত চায় না। অন্যভাষায় বললে, ভারত চায় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এক এক্সক্লুসিভ করিডোর। মানে চীনও না, কেবল একা ভারত হবে এর ব্যবহারকারী।

শুধু তাই না, এর জন্য যা যা অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, এর খরচ ভারত বাংলাদেশের ওপরে চাপিয়ে দেবে। কোনো সেতু, রাস্তা, বন্দর ইত্যাদি ব্যবহার করলে, সেই ফিও ভারত পরিশোধ করবে না। দুনিয়াতে যেখানে একদেশ থেকে অন্যদেশে গ্যাস বা তেলের পাইপ লাইন বসানোর সময় যদি, মধ্যখানে তৃতীয় কোনো দেশের ওপর দিয়ে যেতে হয়, তবে সেই দেশকে একটা ফি দিতে হয়। যেটিকে ‘হুইলিং চার্জ’ বলে। ভারত তার এক ভূখণ্ড থেকে আরেক ভূখণ্ডে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নৌপথ, সড়কপথ, বন্দর ইত্যাদি সব সুবিধাই ব্যবহার করতে চায় বিনা খরচে এবং তা এক্সক্লুসিভ করিডোর বাস্তবায়ন করে।

কাজেই বিহার থেকে আসাম, বাংলাদেশ হয়ে নৌপথ ব্যবহার এক্সক্লুসিভ করিডোর করে নেওয়া হলো। এ জন্যই বলেছি, কলকাতার আনন্দবাজারের একটা বাড়তি বাক্য জুড়ে দেওয়াটা ছিল এক  মিথ্যা সান্ত্বনা পুরস্কার। এখানে বাংলাদেশের জন্য কিছুই নেই, কোনো লাভালাভ নেই।

কানেকটিভিটি :  ২০০৭ সাল থেকে আমাদের আরেকটা শব্দ শিখানো হয়েছে। আর তা হলো- ‘কানেকটিভিটি’। বইয়ের ভাষায় এর আদর্শ ধারণাটি হলো, এটা গ্লোবাল বাণিজ্যের যুগ। তাই বাণিজ্যিক চলাচলে সব ধরনের সীমান্ত-বিষয়ক বাধা সহজ করে দিলে উলটা সবার বাণিজ্যিক লাভ আছে। এতে সব পক্ষের মধ্যে পণ্য বিনিময় সম্পর্ক ও বাণিজ্য আরও বাড়বে। তাই অবাধ পণ্য চলাচলের যুগে আমাদের প্রবেশ করা উচিত। তবে এতে সব ফি পরিশোধ করা সাপেক্ষে। আর এ নিয়ে পারস্পরিক যাদের স্বার্থ বাধাগ্রস্ত, দুয়ার খুলছে, খুলবে তারা একসঙ্গে বসে ফয়সালা বা শর্তগুলো ঠিক করে নেওয়া উচিত। নিজেরা দু’পক্ষ না পারলে ডব্লিওটিও-এর ফোরামের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে; কিন্তু কানেকটিভিটি বাড়াতেই হবে। 

আর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেক ধারণা হলো, বিদেশি পণ্য প্রবেশের ওপর শুল্ক আরোপ করে, সেই আয় দিয়ে অর্থনীতি পরিচালনা এ কালে ছেড়ে দিতে হবে। আর গড়ে ১০ শতাংশের নিচে আমদানি শুল্কের অর্থনীতি পরিচালনা করতে অর্থনৈতিক জোট গড়ে তুলতে হবে।  

প্রথম কথা হলো, ওপরে কানেকটিভিটি ধারণার উসিলায় যে দুই পয়েন্ট বললাম এটা প্রযোজ্য হবার প্রথম শর্ত হচ্ছে- সেই দেশকে ‘অর্থনীতিক জাতিবাদ’ ত্যাগ করতে হবে। মানে নিজ বাজার সংরক্ষণ বা কাউকে ঢুকতে দেব না- এই পুরনোা রক্ষণশীল ধারণা এমন জোট সংশ্লিষ্ট সবাইকেই ত্যাগ করতে হবে। কারণ আপনি কাউকে ঢুকতে না দিলে, সেও আপনাকে দেবে না। বরং এর বদলে যে পণ্য সবচেয়ে সস্তায় তৈরি হয়, সেটি নিজের বাজারে ঢুকতে দিয়ে আমি যা ভালো পারি তা নিয়ে অন্য সবার বাজারে প্রবেশের নীতি ও সুযোগ নিতে হবে।

সুতরাং রাজনৈতিক জাতিবাদ যেমন ভারতে হিন্দু বা হিন্দুত্বের জাতিবাদ, আর এরই ভায়রা ভাই হলো অর্থনৈতিক জাতিবাদ। ভারত আগাগোড়া এমনই এক জাতিবাদি রাষ্ট্র। কাজেই ভারতের সঙ্গে আমাদের ‘কানেকটিভিটি’ নিয়ে কোনো সম্পর্কই হতে পারে না। এটাই হলো মূল কথা; কিন্তু বুঝে না বুঝে বা প্রজেক্ট পাবার লোভে সিপিডির রেহমান সোবহান এই কানেকটিভিটি শব্দ ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের এক্সক্লুসিভ করিডোর পাবার পক্ষে প্রপাগান্ডা করে গেছেন। সেই সময়ের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা ভারতের নেতারা এই একই শব্দে তোলপাড় করেছিল। আর এই করিডোরের আয় থেকেই আমরা নাকি সিঙ্গাপুর হয়ে যাব- এই মিথ্যা প্রপাগান্ডার জন্ম এখান থেকেই। এমনকি যারা ভারতকে করিডোর দেবার বিরোধিতা করবে, তারা নাকি অশিক্ষিত- এমন মন্তব্য করেছিলেন রেহমান সোবহান। 

তাই সত্যিই যদি আমরা কানেকটিভিটি বিষয়টা নিয়ে অভিজ্ঞতা নিতে চাই, তবে আরেকটা ধারণা (কনসেপ্টে) আমাদের পরিচিত করতে হবে। সেটা হলো, ‘কমন ভ্যালু এডিশন প্রডাক্ট’- এর জোট। যার বাস্তবিক উদাহরণ হলো, এশিয়ার জোট- আশিয়ান এবং অন্য কিছু দেশ মিলে আরসিইপি (RCEP) জোটের দিকে তাকাতে পারি। গত ২০২০ সালে আরসিইপি বা ‘রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’- এ জোট স্বাক্ষরিত হয়ে কাজ শুরু করেছে। মজার কথা হলো, চীন এই জোট বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় পার্টনার; কিন্তু আবার এ জোটের সঙ্গে আছে- জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশ। মানে হলো, ভারত আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সবাই এ জোটে আছে। অর্থাৎ এখানে এসে ‘কোয়াড’ উলটে গিয়েছে। আর ভারত এতে যোগ দেওয়ার জন্য কেন যোগ্য নয় তা নিয়ে ভারতের মন্তব্য জেনে নেওয়াও জরুরি।  আর যারা আগামী দিনের অর্থনীতি বুঝতে চান, তাদের স্টাডির  জন্য এক ভালো বিষয় হতে পারে- কমন ভ্যালু এডিশন প্রডাক্ট বা আরসিইপি জোট!


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //