সামাজিক কল্যাণের উন্নয়ন

মুক্তিযুদ্ধ সাধারণ মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক মঙ্গলের ধারণাকে এড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক কল্যাণের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে। সংবিধানে প্রদত্ত অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হবে। দেশের মানুষের দারিদ্র্য দূর হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে হবে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ জনকল্যাণে ব্যবহৃত হবে। রাষ্ট্র সন্ত্রাস ও দুর্নীতি মুক্ত হবে। বিদেশের খবরদারি বন্ধ হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।

কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো জনগণের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে ২২ পরিবারকে ২২ লাখ পরিবারে রূপান্তর করা কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত। সামাজিক কল্যাণের ধারণাকে অবজ্ঞা করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক মঙ্গলের ধারায় বীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। যার ফলস্বরূপ রাজনীতি ও তার অংশ প্রশাসন দেশের মূল সমস্যা সমাধানকে পাশ কাটিয়ে অনক্ষর অনাহারী দেশবাসীর জন্য প্রকল্পনির্ভর উন্নয়নের প্রেসক্রিপশনের ব্যবস্থা করেছে।

সরকারি ব্যবস্থাপত্রে কিছু মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রকল্পের পেছনে ছুটছে। সবাই প্রকল্পের পেছনে ছুটছে। একটা প্রকল্প পাওয়া গেলেই মুক্তি। দেশে শিশুশ্রম নিরসন করতে হবে, নারীর ক্ষমতায়ন করতে হবে, শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে হবে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে, দুর্নীতি থামাতে হবে, শিশু মৃত্যুর হার কমাতে হবে, বনায়ন করতে হবে,  জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে হবে, দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে, পুষ্টিমান রক্ষা করতে হবে, পাচার প্রতিরোধ করতে হবে, যৌতুকপ্রথার বিলোপ করতে হবে, সাক্ষরতা বৃদ্ধি করতে হবে, স্যানিটেশনের আওতায় আনতে হবে, সুপেয়পানির ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, দলিতদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে- এমনই হাজারো প্রকল্পের ভিড়ে বাংলাদেশ। বিদেশিরাও বসে নেই, ডালি সাজিয়ে বসে আছে। দেশের কোটি কোটি অনক্ষর অনাহারী মানুষের সেবায় লক্ষ লক্ষ মানুষ নিয়োজিত। দেশি-বিদেশি হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সারাদেশে প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে।

বাংলাদেশে উন্নয়নের কোনো মডেল নেই। দেশব্যাপী পরিচালিত প্রকল্পগুলোর কোনো মনিটরিং নেই। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আশা করা বৃথা। ফলে দেশে হাজার হাজার প্রকল্প ক্রিয়াশীল থাকার পরও কি উন্নয়ন হচ্ছে? কার উন্নয়ন হচ্ছে, কোথায় উন্নয়ন হচ্ছে, তা কেউ জানে না। জানাটা যে কারও জন্য প্রয়োজন তা কেউ মনে করে না। প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের মজাটাই এখানে। সারাদেশের ১০টা জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের জন্য ২০/২৫টা প্রকল্পে কাজ শুরু হয়। প্রশাসন, সুশীল সমাজ আর এলাকাবাসীকে তা জানানো হয়। ৩ বছর, ৫ বছর কাজ করার পর প্রকল্প শেষ হয়েছে। অর্জন নিয়ে বিশাল প্রচারণা করা হয়। সর্বশেষ প্রাপ্তির সাথে প্রচারে কোনো মিল পাওয়া যায় না। কারণ সরকারের কোনো মডেল নেই এবং অর্জনটুকু ধরে রাখার কোনো প্রক্রিয়া নেই। ফলে পূর্বের অবস্থা বা তার থেকে আরো খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আপেক্ষিক প্রাপ্তির আনন্দ উবে যেতে সময় লাগে না। এতে সরকার বা প্রকল্প গ্রহণকারীদের কোনো দুঃখবোধ কাজ করে না। বরং আবার এই প্রকল্প বা নতুন প্রকল্প গ্রহণের কাজে নেমে পড়ে।

সরকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকার অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদানে সক্ষম হলে আমাদের দেশের কোনো অভিভাবক তাদের সন্তানকে শিশুশ্রমে নিয়োজিত করতো? বাবা-মা মাত্রই কামনা করে আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। এখানে টান পড়লেই বাধ্য হয় সন্তানকে শিশুশ্রমে নিয়োজিত করতে। আমদের নীতি নির্ধারকরা যদি এটা বিশ্বাস করে তাহলে সাধারণ মানুষের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সরকার জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মূল সমস্যা সমাধানের নৈতিক দায়িত্ব স্মরণ করতে পারে। এক একটার সমাধানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে পারলে অনেক ছোট ছোট বিষয়ের সমাধান হয়ে যেতো। সরকারের কাছে এমন উদ্যোগই সাধারণ মানুষ কামনা করে।

বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় একটা দল বা জোট সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতাসীন হয়ে থাকে। আমাদের রাজনীতির হিংস্রতা ও বৈরিতার কারণে এই ক্ষমতাসীনরা পাঁচ বছর শান্তিপূর্ণ থাকে না। সরকারের পক্ষে একাগ্রচিত্তে কোনো কাজ করাও কঠিন। তারপরও সরকার নিশ্চুপ থাকতে চায় না বরং জীবনও থেমে থাকতে পারে না। সরকারকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজ করতে হয়। তবে সরকার কাজ করে কিন্তু তেমন কোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে সব কাজ করতে গিয়ে রিলের সুতার মাথা হারিয়ে গেলে তা বের করতে গেলে যেমন জট

পাকিয়ে যায়, সরকারের তেমন অবস্থা হয়। সবকিছু জট পাকিয়ে অগ্রগতির ঘরে শূন্য পড়ে থাকে। সত্যি কথা বলতে মাত্র পাঁচ বছর সময়ে সবকিছু করা সম্ভব নয়। সরকারের নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়টা অনুধাবন করা জরুরি। স্বাধীনতার ৪২ বছরে আমাদের সরকারগুলো যদি তাদের সময়কালে একটা করে মূল সমস্যার সমাধান করতো তাহলে আজকের বাংলাদেশের চেহারাই পরিবর্তন হয়ে যেত। আমাদের জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, শিল্পায়ন, কৃষি ইত্যাদির একটা পর্যায় দেখা সম্ভব হতো।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যানের লীলাভূমি। কত বিচিত্র সব পরিসংখ্যানের খেলা দেখা যায়। তা শুধু দেশের মানুষকে নয়, বিদেশিদেরও চমক দিতে সক্ষম। বাংলাদেশ এখনই এই পরিসংখ্যানের উপর ভরসা রেখে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। অথচ দেশের মানুষ সেই উন্নয়নে আস্থা রাখতে পারছে না। দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে যে কার্যক্রম চলছে তাতে সংখ্যাগতভাবে মানুষের দারিদ্র্যতা কমলেও শতকরায় কোনো প্রভাব পড়ছে না। 

দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের মতে দেশে এখন ৮০ ভাগের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বাস করছে। এখানে প্রকৃত দরিদ্র ও বিত্তহীন মানুষের সংখ্যা ৬৬ ভাগ হলেও বিগত কয়েক বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও প্রকৃত আয় হ্রাসের যে প্রবণতা তা দেখে বলা যায় দরিদ্র-বিত্তহীন মানুষ আরো দরিদ্র হয়েছে। এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ দরিদ্র বিত্তহীনদের কাতারে যোগ দিয়েছে। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করছেন যে গত চার বছরে তার সরকার পাঁচ কোটি দরিদ্র-বিত্তহীন মানুষকে মধ্যবিত্তের কাতারে নিয়ে গিয়েছেন। বাঙালি এখন ড. বারাকাতের গবেষণাকে, না প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে সম্মান করবে? তবে প্রধানমন্ত্রী নিজে একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে থাকেন তবে তিনিই সম্মান পাওয়ার যোগ্য।

স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম ২৫ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। যার মাত্র ১২ ভাগ প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হয়েছে। তবে এই ১২ ভাগ প্রকল্প শেষ করতে গিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থের ৯২ ভাগই খরচ করা হয়েছে। ২৫ বছর ধরে গৃহীত সাড়ে ২৬ হাজার প্রকল্পের মাত্র ১২ ভাগ প্রায় ৩ হাজার শেষ করা গেছে। বাকি প্রকল্পের খবর আজ অনেকেই দিতে পারবে না। কিছু হারিয়ে গিয়েছে। কিছু থেমে গিয়েছে। কিছু থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দকৃত দেশ-বিদেশের অর্থ ঠিকই ব্যয় করা হয়েছে। এমন মজার প্রকল্প কে না চায়? তাই একটা প্রকল্প পেতে এবং তার পরিচালক হতে প্রতিযোগিতার শেষ নেই। জাতীয়ভাবে গৃহীত প্রকল্পের ভাগ্য যদি এমন হয় তবে অন্যদের প্রকল্পের অবস্থা কি তা দেখার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। জবাবদিহিতা নেই, দায়বদ্ধতা নেই, আছে শুধুই প্রাপ্তি। 

দেশে প্রকল্প মানেই ব্যক্তিগত প্রাপ্তি। সে কারণে প্রকল্প প্রণয়নে তেলেসমাতি দেখা যায়। বাঙালিকে স্বপ্ন দেখাতে চাঁচের ভাঙা বেড়ার ঘরে রঙিন টিন লাগানোর প্রকল্প তৈরি করে। নিজেদের কৃতিত্ব ফুটিয়ে তুলতে হাজামজা ভৈরবে কোটি টাকা দামের বোট (নৌকা) ভাসানোর কিম্ভুৎকিমাকার প্রকল্প তৈরি করে। সাধারণ জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্য, সহনশীল ও উপযোগী দেশি নৌকার কথা কারো চিন্তা চেতনার মধ্যে থাকে না। সব সরকারের আমলেই বিশাল বিশাল প্রকল্পের মধ্যেই সমস্যার সমাধান থাকে। রাজধানীর ঠাণ্ডা ঘরে বসে তৈরি করা প্রকল্পের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা না থাকার কারণে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রকল্পের ধারণাকে রূপ দিয়ে চলেছে। স্থানীয় পর্যায় থেকে সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণে প্রকল্প প্রণীত হলে সামাজিক কল্যাণের ধারণাকে রূপ দেওয়া সম্ভব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //