অসাম্প্রদায়িক মওলানা ভাসানী

মওলানা ভাসানী তাঁর জীবদ্দশায় কেবল বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশের নয়, দীর্ঘকাল ধরে খ্যাত ছিলেন আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মজলুম মানুষের সংগ্রামে প্রেরণার দীপশিখা হিসেবে। গণমানুষের সেই কালজয়ী মহান নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে পশ্চিমী দুনিয়ার গণমাধ্যম ‘ফায়ার ইটার’ বা অগ্নিভূক, ‘রেড মওলানা অব দ্য ইস্ট’ অর্থাৎ প্রাচ্যের লাল মওলানা ইত্যাকার বিশেষণে চিত্রিত করলেও তিনি স্টকহোমে আফ্রো-এশীয় শান্তি-সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছেন।

বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে যৌথবিবৃতি দিয়েছেন যুদ্ধবাদিতার বিরুদ্ধে। টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে; দিয়েছে ‘প্রোফেট অব ভায়োলেন্স’ বা সহিংসতার পথপ্রদর্শক তকমা। তবে নির্যাতিত মানুষ বরাবরই তাঁকে শ্রদ্ধা করে এসেছে উৎপীড়নবিরোধী সংগ্রামের মহানায়ক হিসেবেই। 

মওলানা ভাসানী ছিলেন সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক একজন নেতা। তিনি যে শ্রেণি-স্বার্থে রাজনীতি করেছেন, সে ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার লেশ ও রেশ কোনোটিই থাকার অবকাশ নেই। কৃষক, শ্রমিক, ভূমিহীন, দিনমজুর, কামার, কুমার, জেলে, মাঝি, তাঁতি- যাদের পক্ষে সাম্প্রদায়িক আচরণ করা সম্ভব ছিল না। বেঁচে থাকাটাই যাদের একমাত্র যুদ্ধ, ধর্ম তাদের কাছে নিতান্ত সংস্কার মাত্র। আর তাদের যিনি নেতা, তিনি তো পরীক্ষিত, ত্যাগী। তাঁর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। অতি সাধারণ জনতার কাঁধে সওয়ার হয়ে যিনি নেতা হবেন, প্রভুর কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করবেন, আমলার উচ্ছিষ্টভোগী হবেন। তিনি কখনো এদের নেতা হতে পারবেন না। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আম জনতার কল্যাণে উৎসর্গীকৃত নেতৃত্বই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূলমন্ত্র হওয়ার কথা। মওলানা ভাসানী ছিলেন তেমনই একজন নেতা। তাইতো সন্তোষে তাঁর মাজার প্রাঙ্গণে লেখা আছে এক বাণী, ‘আমার দরগায় যে-ই আসবে তাকে রুটি দাও। তার বিশ্বাস-আচার কি তা জিজ্ঞেস করবে না। কারণ আমার প্রভুর কাছে যার জীবনের মূল্য আছে, তার তুলনায় আমার রুটির মূল্য অত্যন্ত নগণ্য ও তুচ্ছ।’ 

ব্যক্তিজীবনে মওলানা ভাসানীর মুসলিম সুফি সাধক ও দার্শনিকদের প্রতি ছিল গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং একই সঙ্গে অমুসলমান মহাপুরুষ যেমন চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি ছিল অসামান্য শ্রদ্ধা। তিনি তাঁর ভক্তদের সঙ্গে তাঁদের বিষয়ে আলোচনা করতেন।

তিনি এতটাই ধর্মকর্মে ব্রতী ছিলেন যে, সাধারণ মানুষ তাকে পীর মনে করত। তবে তার মধ্যে কোনো ছুৎ-মার্গের ব্যাপার ছিল না। তিনি নির্দ্বিধায় অমুসলিম বাড়িতে পানাহার করতেন। এ বিষয়ে আজ এই নিবন্ধে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত আচরণের উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৪৭ সালে তিনি একবার গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের জমিদার গোপেশ্বর সাহা রায়চৌধুরীর বাড়িতে। বলাবাহুল্য যে, জমিদার গোপেশ্বর রায় প্রজা-বৎসল ছিলেন। তারা গরিব-দুঃখীদের সাহায্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। এর মধ্যে মাগরিবের আজান হলে তিনি গোপেশ্বর রায় চৌধুরীর কাছে নামাজের জায়গা চাইলেন।

গোপেশ্বর বাবু হেসে বললেন, ‘হিন্দুবাড়িতে নামাজ পড়লে নামাজ হবে কি মওলানা সাহেব?’ মওলানা জবাব দিলেন, ‘আমরা জানি আল্লাহ সব জায়গায় বিরাজমান। তবে কি তিনি হিন্দু বাড়িতে থাকেন না?’ মওলানার জবাব শুনে জমিদার অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘হুজুর আপনার মতো উদার মনের মানুষ যদি সবাই হতেন, তাহলে কেউ সাম্প্রদায়িকতার আগুনে জ্বলত না’। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয় সীমাহীন রক্তের পথ বেয়ে। স্বাধীনতার পরও দাঙ্গা-হাঙ্গামা অব্যাহত ছিল। তা ছাড়া সে বছর ঈদ ও পূজা প্রায় কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় নেতারা সহিংসতার আশঙ্কা করেন। যাতে দাঙ্গা না হয় সেজন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হিন্দু-মুসলমান নেতারা পূর্ববাংলার বিভিন্ন এলাকা সফর করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন কংগ্রেস নেতা কিরণশংকর রায়, লীগ নেতা মওলানা ভাসানী, হাবিবুল্লাহ বাহার প্রমুখ।

নেতাদের সঙ্গে একদল সাংবাদিকও থাকতেন। সেবার কলকাতা দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্টার অমিতাভ চৌধুরী ছিলেন সে দলে। মওলানা ভাসানী তখন শান্তিপূর্ণভাবে যাতে পূজা হতে পারে সেজন্য হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ঘুরছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন মওলানা; কিন্তু তিনি জিন্নাহর দ্বিজাতি-তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের পক্ষে। পাকিস্তান শুধু মুসলমানের আবাসভূমি হবে এ নীতির তিনি ছিলেন ঘোরবিরোধী। পূর্ববাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বাঙালি, আদিবাসী সবার দেশ হবে পূর্ববাংলা; এই ছিল তার প্রত্যয়। সেজন্য সিলেটকে পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য তিনি হিন্দু বাঙালিদেরও ভোট দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান কোনো ইসলামি রাষ্ট্র বা ধর্মরাষ্ট্র হবে না। পাকিস্তান হবে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।’ পাকিস্তান থেকে সে সময়ে দলে দলে হিন্দুরা ভারতে চলে যাচ্ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার থেকে মুসলমানরা আসছিলেন পাকিস্তানে। এই প্রবণতা তিনি রোধ করার জন্য প্রচার চালাচ্ছিলেন। পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুদের চলে যাওয়া তাঁর একেবারেই কাম্য ছিল না। এমতাবস্থায় তিনি রিপোর্টার অমিতাভ চৌধুরীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুরা চলে গেলে বাঙালি কালচারটা নষ্ট হয়ে যাবে। ’

সভ্যতার ক্রমপর্যায়ে ধর্মের আবির্ভাব থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যায় পর্যন্ত মানুষকে নিপীড়নের অন্যতম মাধ্যম হলো ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনাপর্ব থেকেই দল গঠনের হাতিয়ার হিসেবে ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়গত পরিচয়কে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃত শিক্ষিত এবং মানবিক গুণসম্পন্ন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা কখনো কাউকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করেন না। মওলানা ভাসানী আজীবন ধর্মান্তরের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলতেন, ‘আমার শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু আছে, মুসলমানও আছে। আমার অনেক শিষ্যই ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য আমার কাছে এসেছে। আমি ধর্মান্তর পছন্দ করি না। অনেক মুসলমান নেতা আমাকে ধর্মান্তরের জন্য পরামর্শ দিতেন। আমি রাজি হইনি। আমি তাদের বলতাম, পৃথিবীতে কোনো ধর্ম খারাপ না। ১৯৩৫ থেকে ৪৭ পর্যন্ত বারো বছরে যদি আমি চাইতাম তবে লাখ লাখ আদিবাসী ও হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারতাম। আসামকে পূর্ববাংলার মতোই মুসলমান মেজরিটি প্রভিন্স বানাতে পারতাম; কিন্তু জীবনে একজন হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীকে আমি এই পরামর্শ দিইনি। আমি আমার হিন্দু শিষ্যদের ঠিকমতো তাদের ধর্ম-কর্ম করার পরামর্শ দিতাম। ’

তার অনেক শিক্ষিত, সচেতন শিষ্যও এ কথা বলেন যে, তিনি কখনো তাদের ধর্ম-কর্ম পালনের জন্য বাধ্য করতেন না। তিনি নিজে নামাজ পড়তেন কিন্তু অন্যদের নামাজ পড়ার জন্য প্ররোচিত বা বাধ্য করতেন না। মওলানা ভাসানীর মতে, ‘দুনিয়ায় মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত, জালেম আর মজলুম। ’

১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত মি. ফ্লাড সন্তোষে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার একপর্যায়ে তাকে সেইন্ট সম্বোধন করলে মওলানা বলেন, আমি সেইন্ট নই। আমি শোষিতের পক্ষে এবং অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি। যে সাধুতা বা স্পিরিচুয়্যালিটি থাকলে কেউ মানুষ ছেড়ে আকাশে বিচরণ করে, সে আধ্যাত্মিকতা আমার নয়।’

লেখক- কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //