মুসা ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য

দুই হাজার বিশ সালটা ছিল দেশের মানুষের জন্য বড় বিয়োগান্তক। এই এক বছরের ব্যবধানে আমরা বহু মানুষকে হারিয়েছি। বছরজুড়েই এই মৃত্যুর মিছিল বেশ দীর্ঘ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, যারা বিদায় নিয়েছেন করোনার কারণে, তাদের অনেককেই যথাযথভাবে বিদায় দেওয়া যায়নি। ঝিনাইদহের মুসা ভাই সেদিক দিয়ে কিছুটা সৌভাগ্যবান। করোনার অভিশাপ নিয়ে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়নি। এ কারণে ঝিনাইদহে তাঁর জানাজাতেও ছিল বিশাল উপস্থিতি। মাঠ ছড়িয়ে রাস্তা-ঘাট উপচে পড়েছিল মানুষ। আর এটা হয়েছিল তাঁর সুদীর্ঘ ঊননব্বই বছরের জীবনে ঝিনাইদহ অঞ্চলের মানুষের সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, সংগ্রাম-আন্দোলনে তাঁর গভীর সম্পর্কের কারণে। জীবনের শেষ ভাগে ঝিনাইদহের মানুষ তাঁকে দেখেছে অভিভাবক হিসেবে। সেখানে দল-মতের বিবেচনা ছিল না। আর সে কারণেই তাঁর জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতি ঘটেছিল। জীবনের শেষভাগে অবশ্য তিনি ঢাকাতেই তাঁর ছেলের পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তবে প্রতি ঈদে সব ছেলে-মেয়ে জড়ো হতো ঝিনাইদহের বাসায়। আর ওই পরিবারিক মিলন মেলায় তিনি থাকতেন মধ্যমণি।

মুসা ভাই সৌভাগ্যবান, তাঁর ছেলেরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে শাহরিয়ার রেডিয়েন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে এদেশের ফার্মাসিটিউক্যাল শিল্পে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। অন্য ছেলেরাও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ছেলেদের এই ব্যবসায়ের উপদেষ্টা হিসেবে থাকলেও তাঁর মূল কাজের ক্ষেত্র ছিল সমাজসেবা। প্রতিষ্ঠা করেছেন জাহেদী ফাউন্ডেশন। আর এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঝিনাইদহ ও যশোরের শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি রেখে গেছেন বিশাল আবদান। বিশেষ করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলে-মেয়েদের জন্য তিনি অটিস্টিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, যা দৃষ্টান্ত হিসেবে বিরল। 

তবে মুসা ভাইয়ের মূল কর্মক্ষেত্র ছিল রাজনীতি। ছাত্রজীবনে তিনি যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনে এবং সেখানে থেকে পাকিস্তান আমলের প্রথম যুুগেই বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সংগঠনে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেন। পরে মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করলে তিনি ন্যাপেরও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই ন্যাপের নেতা হিসেবে ষাটের দশকে আয়ুব শাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর যুক্ততা কেবল নয়। নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল। আর এই ন্যাপ নেতা হিসেবে মওলানা ভাসানী ঝিনাইদহে এলে তাঁর বাড়িতে উঠতেন, তেমনি অন্য সব স্তরের নেতাকর্মীরাও তাঁর বাসাকে কেন্দ্র করে প্রথমে মহকুমা, পরে জেলার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন।

মুসা ভাইয়ের সঙ্গে সেই পাকিস্তান আমলের সংগ্রামমুখর সময়ে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আমার পরিচয়। ঝিনাইদহে ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠিত করতে এসে তাকে সরাসরি কাছে পাই, যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ের সংগ্রাম আন্দোলন ও সংগঠন গড়ার কাজের মধ্য দিয়ে ঘনিষ্ঠতা রূপ নেয়। বস্তুত, মুসা ভাইয়ের নিরন্তর সাহায্য-সহযোগিতা পরামর্শে ঝিনাইদহে ছাত্র ইউনিয়ন একক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ আমলে ভাসানী ন্যাপের প্রচার সম্পাদক হিসেবে ন্যাপ পুনর্গঠনে ঝিনাইদহ জেলায় তাঁর প্রধান সাহায্য পেয়েছি। এই সময়কালে যশোর-ঝিনাইদহ অঞ্চল সমস্ত গোপন সংগঠনের প্রভাবাধীন ছিল। এ অবস্থায় সবদিক সামাল দিয়ে সংগঠনকে তিনি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়েছেন। 

চুয়াত্তর-পরবর্তীতে ন্যাপের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলে মুসা ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক কমে যায়। তবে যখনই ঝিনাইদহে গেছি, তখনই তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা করে এসেছি। 

মুসা ভাই চলে গেছেন পরিণত বয়সেই; কিন্তু তাঁর চলে যাওয়াটা ঝিনাইদহসহ সমস্ত অঞ্চলেই বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করবে। তবে যেসব কর্মপ্রতিষ্ঠান তিনি তৈরি করে গেছেন, এ ছাড়াও রমজান, ঈদ, কোরবানিতে সাধারণ মানুষকে নানা সহায়তা দেওয়ার জন্য জাহেদী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে যেসব উদ্যোগ তিনি চালু করে গেছেন, সেসবই তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখবে। সেসব কাজের মধ্য দিয়ে ওই শূন্যতা কিয়দংশে হলেও পূরণ হবে। আর সেটাই হবে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

মুসা ভাই নেই। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

উল্লেখ্য, ঝিনাইদহের কৃতি রাজনীতিবিদ ভাষাসৈনিক মো. জাহিদ হোসেন মুসা ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন রেডিয়েন্ট গ্রুপ অব কোম্পানিজ ও সাম্প্রতিক দেশকালের উপদেষ্টা। তাঁর চলে যাওয়ায় সাম্প্রতিক দেশকাল হারিয়েছে এক পরম অভিভাবক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //