নূর হোসেন এবং দিশাহীন গণতন্ত্র

প্রতি বছর ১০ নভেম্বর আসে শুধু সময়ের হিসাব দেখিয়ে দিতে নয়, আকাঙ্ক্ষা ও অর্জনের পার্থক্য দেখিয়ে দিতেও। জনগণ প্রতিবাদ করে, লড়াই করে পরাজিত করেছিল যে স্বৈরাচারী শক্তিকে, ক্ষমতায় থাকার কিংবা যাওয়ার স্বার্থে যখন তারই সঙ্গে শাসকগোষ্ঠী মিত্রতা করে, তখন কি প্রতিবাদী মানুষ অপমানিত বোধ করেন না? পতিত স্বৈরাচারকে বুকে তুলে নেওয়া আর গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করার এই সময়ে মানুষ কি বিপন্ন বিস্ময়ে বলছেন না, এই অবস্থা দেখবার জন্য আমরা কি লড়েছিলাম? 

যে ক্ষমতা অর্জনের জন্য স্বৈরাচারী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, সে ক্ষমতায় জনগণের রাজনৈতিক অধিকার কিংবা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কতটুকু রক্ষা পায়, সে প্রশ্নের উত্তর আলোচনা করে খুঁজতে হয় না, বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই মানুষ বুঝতে পারে। স্বৈরাচার একটি ব্যবস্থার নাম আর তার প্রতীক হয়ে ওঠে একজন ব্যক্তি। সাধারণত ব্যক্তির তুলনায় ব্যবস্থার স্থায়িত্ব বেশি। তাই আন্দোলনের চাপে ব্যক্তি এরশাদ চলে যেতে বাধ্য হলেও স্বৈরাচারী কালাকানুন যেমন থেকে গেল রাজনীতিতে, স্বৈরাচারী সংস্কৃতির প্রভাব আর যুক্তি ও জবাবদিহির পরিবর্তে পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব চলমান থেকে গেল। 

গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের মানুষ লড়ছে বহুযুগ ধরে; কিন্তু লড়াইয়ের চেতনাকে জীবন্ত পোস্টার করতে কেউ দেখেছে কি? বুকে স্বৈরাচারের প্রতি ঘৃণা আর পিঠে গণতন্ত্রের দায়িত্ববোধ থেকেই নূর হোসেন বুকে লিখেছিলেন স্বৈরাচার নিপাত যাক আর পিঠে লিখেছিলেন গণতন্ত্র মুক্তি পাক। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদকে রক্ষায় পুলিশ বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল তার বুক। এত কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল যে, নূর হোসেনের গায়ে না লাগার কোনো কারণই ছিল না। যেহেতু লক্ষ্যবস্তু সুনির্দিষ্ট আর প্রশিক্ষিত বাহিনীর নিশানা অব্যর্থ, ফলে নূর হোসেনের মৃত্যু ছিল অনিবার্য। নূর হোসেনের আকাঙ্ক্ষা ছিল তার মৃত্যু যেন গণতন্ত্রকে মুক্ত করে সামরিক স্বৈরাচারের কবল থেকে। তার এই আকাঙ্ক্ষা যেমন উদ্দীপ্ত করেছিল প্রতিবাদী জনগণকে, তেমনি ক্ষিপ্ত করেছিল সামরিক স্বৈরাচারকে। খালি গায়ে বুকে পিঠে সে্‌লাগান লিখে নূর হোসেন যখন মিছিলের মধ্যে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিলেন তখন নজর কেড়েছিলেন অনেক নেতাকর্মীর। অনেকেই তাকে সাবধান করেছিলেন এই বলে, যে কোনো সময় গুলি হতে পারে এবং নূর হোসেন হয়ে যেতে পারেন সহজ টার্গেট। নূর হোসেন পরোয়া করেননি বরং এগিয়ে গিয়েছেন আরও সামনে। মুখোমুখি হয়েছেন নির্মম মৃত্যুর। নূর হোসেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশবাসী দেখলেন সামরিক স্বৈরাচারের নিষ্ঠুরতা আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনগণের আকুতি। 

একটি দেশ বা জাতির জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা, নৈতিক বল ও চরিত্রকে ধ্বংস করে স্বৈরাচার টিকে থাকতে চায়। গণতন্ত্র মানে যুক্তির শাসন আর স্বৈরাচার অর্থ যুক্তিকে হত্যা করে ব্যক্তি কর্তৃত্বের শাসন। ফলে যুগে যুগে যারাই গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তাদের সবাইকে দমন-পীড়নের মুখোমুখি হতেই হয়েছে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুবের স্বৈরশাসন, স্বাধীনতার পর সামরিক বেসামরিক, তত্ত্বাবধানকারী স্বৈরশাসন, নির্বাচিত অনির্বাচিত স্বৈরশাসন সব ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা কীভাবে জনগণকে শাসনে রূপ নিয়েছে, তা প্রতিটি আপাত বিজয়ের পরে দীর্ঘস্থায়ী পরাজয়ের মধ্য দিয়ে জনগণ প্রত্যক্ষ করছেন। 

আকারে ইঙ্গিতে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করলেও শাস্তি পেতে হবে এই ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে নেমেছিল। গড়ে উঠেছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগ্রাম পরিষদ, ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ নানা ধরনের সংগ্রামের সংস্থা। এমনকি প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদদের সমন্বয় প্রকৃতি আন্দোলনের মাঠে ছিল। আন্দোলন দমনে এরশাদ সরকার এমন কোনো পথ নেই, যা অবলম্বন করেনি। প্রলোভন এবং দমন দুই অস্ত্রকেই সমানভাবে কাজে লাগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বানিয়ে যেমন জনগণকে দেখিয়েছে, যে কাউকে কেনা যায়, তেমনি বছরের পর বছর কারাগারে রেখে বুঝিয়েছে যে, সে প্রতিবাদীদেরকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে পারে; কিন্তু অতীতের শিক্ষা হলো এই যে প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকতা এবং মৃত্যু আন্দোলনের শক্তি বাড়ায়। নূর হোসেনের মৃত্যুও তেমনি ছিল এক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। 

নূর হোসেনের মৃত্যু প্রতিবাদকে যেমন তীব্র করে তুলেছিল তেমনি সংশয়ের জন্ম দিয়েছিল। অতীতের অনেক আত্মদানের মতো এর সুফল যে রাজনৈতিক প্রতারণার ফলে হারিয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কি? এই ভাবনা কবি শামসুর রহমানকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তার ১৯৮৭ সালে রচিত ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ কবিতার একটি অংশে তিনি লিখেছিলেন- 

‘হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই

তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর

করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ

ওর নাম, হোমরা-চোমরা তারা, যারা

তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ

জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে

জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ, 

ওদের মুখোশ-আঁটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুড়ে থুথু, শুধু থুথু।’

কি নিদারুণভাবে এই পরিস্থিতি দেখছে দেশের মানুষ। হয়তো থু থু ছুড়ে দেবার মতো কেউ আসেনি এখনো; কিন্তু যারা স্বৈরশাসকের দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নতুন রূপে স্বৈরাচারী শাসন চালাচ্ছেন তাদের প্রতিও ক্ষোভ জমছে প্রতিদিন। 

নূর হোসেন শহীদ হওয়ার দু-তিন বছর পরেই যে স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আপোষ শুরু হলো, তা শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি। সমস্ত কালাকানুন বহাল রাখা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চ্যাম্পিয়ন দাবি করে রাষ্ট্র ধর্ম বহাল রাখা, তার সঙ্গে মিলে ক্ষমতায় যাওয়া, স্বৈরশাসককে বিশেষ দূতের মর্যাদা দেয়া, মন্ত্রিত্ব দিয়ে বিরোধী দলে রাখা, স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর তিন দশক ধরে কত কিছুই না দেখল দেশের মানুষ। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য হরতালও কম হলো না। নূর হোসেনের পর ডা. মিলনসহ কত মানুষের মৃত্যু হলো...; কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না শাসকদের আচরণে আর গণতন্ত্র এলো না সাধারণ মানুষের জীবনে। 

নূর হোসেনের পিতা একবার বলেছিলেন, নূর হোসেন যা চেয়েছিল, তা তো হলো। স্বৈরাচার নিপাত হলো। এখনো দেশে এত হানাহানি, সন্ত্রাস। গণতন্ত্র তো মুক্তি পেল না।’ সন্তান হারানো একজন সাধারণ মানুষের কী অসাধারণ উপলব্ধি! 

কাগজপত্রের হিসাবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে; কিন্তু বাস্তবে সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্দশা বাড়ছে। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন। এখন নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে; কিন্তু মানুষ দেখছে একে প্রহসনরূপে।


লেখক- কেন্দ্রীয় সদস্য, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //