প্রতারিত হতে ও করতে যখন দু’পক্ষই রাজি

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য বা ভেটো সদস্যপদ পাওয়া ভারতের বহুদিনের শখ, উদগ্র বাসনা বা কামনা। মানুষ বা কোনো দেশের শখ বা কামনা নিয়ে খুব কিছু বলবার কী আছে; কিন্তু বলাই বাহুল্য স্বপ্নটা অর্জনযোগ্য হতে হবে অবশ্যই। কোনো রাষ্ট্রের উন্নত হবার কামনা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু সমস্যা হলো কী হওয়া যায় আর কী যায় না এসবের অবাস্তব (মিথ্যা না) অবস্থা না বুঝে যখন ষোলআনা লোভের চোখে অলীক সব কামনা পোষণ করেই যায়! ভারতের ভেটো সদস্যপদ হাসিলের শখটা সেরকম। 

সম্প্রতি ভারতের মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে, ভেটো সদস্যপদের ব্যাপারে আমেরিকা ‘নন-কমিটাল’, অথবা ‘আমেরিকা প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছে’। এসব শব্দ দিয়ে রিপোর্ট হয়েছে গত ৬ আগস্ট। কারণ আগের দিন আমেরিকান পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র নেড প্রাইসকে এ নিয়ে প্রশ্ন রাখায় তিনি ভারত আস্থা রাখতে পারে এমন কোনো জবাব দেননি। ভারতের দ্য হিন্দু এ নিয়ে নিজ-রিপোর্টে লিখেই বসেছে, ‘ইউএস ডাস নট সাপোর্ট এক্সপানশন অব ভেটো’। মানে ভারত এখন পুরাই হতাশায়।

তবে দেখে শুনে ব্যাপারটাকে মনে হয়েছে - বোকা প্রেমিকাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে ওস্তাদ প্রেমিকের ডায়লগ, যে বলেছিল প্রেমিকাকে তাজমহল এনে দেবে।

এখন দোষটা কার? আপনি যদি নাই জানেন তাজমহল এনে দেওয়া সম্ভব কিনা, সেক্ষেত্রে বেকুব আর লোভী প্রেমিকার কপালে তো এটাই হবে! তবে অনেকে অনেক কিছু খেয়াল করে না, সেটা হতে পারে; কিন্তু আপনার নাম যখন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু যিনি চাইলে দুটি নামকরা প্রফেসর বা একাডেমিককে নিয়োগ দিতে পারেন, যার কাজ হবে নেহেরুকে জাতিসংঘের জন্ম-বৈশিষ্ট বুঝিয়ে বলবে; তখন আর এই অজুহাত খাটবে না যে আপনি আসলে জাতিসংঘের জন্ম বৈশিষ্ট্য তাৎপর্য বুঝেনই না! 

অথচ ব্যাপারটা তাই ঘটেছে শুধু না, সেই নেহেরুর আমল থেকে এই শতকে প্রণব মুখার্জি যখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, সে পর্যন্ত নেহেরুর না বোঝাটা একালেও কন্টিনিউ করেছে, জাতিসংঘ কী আর কী-না তিনিও বোঝেননি। ফলে আমেরিকা তাকে ভেটো সদস্যপদ পাইয়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, প্রণব মুখার্জিও কথাটা বিশ্বাস করেছেন।

২০১০ সালের ১০-১৩ জানুয়ারি ছিল সে সময়ের হাসিনা সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় ভারত সফর। ওই সফর শেষে ৫০ দফার এক যৌথ ঘোষণা বেরিয়েছিল, তাতে ৪৬ ও ৪৭ নম্বর দফায় ভারতের ভেটো সদস্য পাওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে সমর্থন করানো হয়েছিল। এখন শেখ হাসিনার এই সমর্থন করার গুরুত্বটা কী? বাংলাদেশের সমর্থন পেলে কী ভারতের ভেটোসদস্যপদ পাওয়াটা এগোবে? এই কি ভারতীয় ফরেন অফিসের জাতিসংঘ-প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বোঝা! অদ্ভুত না? এমন আরও অজস্র উদাহরণ আছে। ২০০৬ সালে বুশ আর ২০১০ সালের ওবামা এরা দু’জনেই (দুবারই কংগ্রেসের মনমোহন সিং-প্রণব মুখার্জি সরকারে ছিলেন) ভারতকে একই সদস্যপদ পাইয়ে দেবার ভুয়া ‘বুঝ’ দিয়েছিল আর মনমোহন-প্রণব তা বিশ্বাসও করেছেন। 

তাহলে এটা কি বারবার আমেরিকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস? ভারতের মিডিয়া সবসময় এভাবেই ইস্যুটি ছেপে এসেছে এবং গত সপ্তাহ পর্যন্ত এভাবেই তা ব্যাখ্যা করেছে। এই দাবি ভিত্তিহীন। তার মানে নেহেরু থেকে একাল পর্যন্ত মন্ত্রী-রাজনীতিবিদরাই নয়, ভারতের মিডিয়াকর্মীরাও আমেরিকার একটি প্রতারণাকে সদলে বিশ্বাস করে এসেছে। আমেরিকা চাইলেই কি তার কোনো পছন্দের রাষ্ট্রকে ভেটো সদস্যপদ পাইয়ে দিতে পারে? ব্যাপারটা কি আমেরিকান সম্পত্তি ধরনের? ভারতের মন্ত্রী-রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়াকর্মীরাও কেউ নিজেকে এই প্রশ্ন করেনি। কড়া এবং খুবই তিতা সত্য কথাটা হলো নেহেরুসহ এরা কেউ তা জানে না, জানাও হয় নাই।

জাতিসংঘ দাঁড়িয়ে আছে এই ভিত্তিমূলক ধারণার ওপর যে কেউ কাউকে কলোনি করতে পারবে না, এটি নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় অপরাধ। কারণ যে কোনো ভূখণ্ডের বাসিন্দারাই একমাত্র নির্ধারক যে ওই ভূখণ্ড কে শাসন করবে, কার দ্বারা সে শাসিত হতে চায়। আর এমনকি ওই ভূখণ্ডের কথিত কোনো রাজাও এই সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। বলাই বাহুল্য বাসিন্দারা নিশ্চয় কলোনিদখল হবার পক্ষে রায়-ম্যান্ডেট দেবে না। অথচ নেহেরুর এই ভিত্তিমূলক অবস্থানের কথা জানা ছিল না। কীভাবে এত সরাসরি বললাম তিনি জানতেন না? কারণ, কাশ্মীরের রাজার চিঠির ভিত্তিতে কাশ্মীর ভারতের হয়ে গেছে ধরে নিয়ে এর পক্ষে জাতিসংঘের সিল-ছাপ্পর পেতে ইস্যুটি জাতিসংঘে পাঠিয়েছিলেন। স্বভাবতই জাতিসংঘ সেটি অনুমোদন না দিয়ে গণভোট আয়োজন করে বাসিন্দাদের ম্যান্ডেট নিতে রায় দিয়েছিল। অর্থাৎ জাতিসংঘ ভারতের কাশ্মীর দখলের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। এ ঘটনাটিই প্রমাণ করে যে নেহেরু যদি জাতিসংঘের জন্মভিত্তি জানতেন, তাহলে নিজের বিরুদ্ধে রায় চাইতেন না। যে রায় আবার তিনি ও ভারত আজও বাস্তবায়ন করেনি। 

ভারতের এই অজ্ঞতা ও বেখবর থাকার এটিই শেষ নয় বরং শুরু। মনমোহন-প্রণব এর ধারণা আমেরিকা চাইলে ভারতকে ভেটোক্ষমতা পাইয়ে দিতে পারে- এই অনুমানটিই প্রমাণ করে যে তারা জাতিসংঘের জন্মভিত্তি ও গঠন সম্পর্কে কী পরিমাণে অজ্ঞ।

একথা সত্যি জাতিসংঘের জন্ম, এমন প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন ও আইডিয়া এবং সেকালের সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট স্তালিন ও ব্রিটেনের চার্চিলকে এর পক্ষে রাখা এসবই করেছিলেন ওই বিশ্বযুদ্ধের প্রধান ক্ষমতাধর নায়ক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট; কিন্তু এর মানে আজ অথবা কখনই জাতিসংঘ আমেরিকার সম্পত্তি নয়। 

তবু এককথায় বললে, জাতিসংঘের জন্ম হতে পেরেছিল কারণ ওই সময়ে প্রথম গ্লোবাল নেতা হিসাবে আমেরিকান উত্থান ঘটেছিল। ওই যুদ্ধের প্রধান খরচ রুজভেল্টের আমেরিকারই একমাত্র একা বইতে সক্ষমতা ছিল ও তিনি সেটা করার সুযোগ নিয়েই গ্লোবাল নেতা হয়েছিলেন। এখান থেকে বোঝা যাবে কেন ভেটোমেম্বর পাঁচ সদস্যের করা হয়েছিল- আমেরিকা সোভিয়েত ব্রিটেন, ফ্রান্স ও এক পঞ্চম রাষ্ট্র। অর্থাৎ আমেরিকা ছাড়া বাকি তিন রাষ্ট্রের আমেরিকাকে সমর্থন করা ছাড়া উপায় নাই। তা সত্ত্বেও রুজভেল্ট তাদেরকে ভেটো মেম্বার হিসাবে পদ দিচ্ছেন এটা তাদের জন্য ছিল বিশাল বড় পাওনা। আর একথা বোঝা যাবে যদি আমরা ভেটোসদস্য কথাটার তাৎপর্য বুঝি। ভেটো মেম্বার মানে জাতিসংঘের গৃহীত হবু যে কোনো সিদ্ধান্ত ওই দেশ তার একটি ভেটো-ভোট দিয়ে রুখে দিতে পারেন। অর্থাৎ ভেটো-সদস্যরা একলাই যথেষ্ট তিনি রাজি না হলে ওই সিদ্ধান্ত পাশ হবে না। তাতে কাউকে এমনকি অন্য ভেটী-সদস্যদেরকেও পাশে পাবার দরকার নাই। তাই এটি এক বিরাট ক্ষমতা। 

এ কারণেই সোভিয়েত, ব্রিটেন আর ফ্রান্স ভেটো মেম্বরশিপ হাসিলের পর আর দেখতেও যায় নি রুজভেল্ট পঞ্চম সদস্য কাকে নিচ্ছেন। রুজভেল্ট একক সিদ্ধান্তে নেন চীনকে!

কোন চীন? কেন চীন? যে চীন তখন এশিয়ার কলোনি মাস্টার জাপানের অধীনস্ত এক কলোনি মাত্র। অথচ একেই রুজভেল্ট তুলে এনে ভেটোসদস্য করেছিলেন কেন? মূল কারণ, এশিয়ায় হিটলারের সহযোগী জাপানকে ডুবিয়ে দেবার পর হবু শক্তি হিসেবে সে জায়গায় চীনকে উঠিয়ে আনতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সাবধান সেটা কমিউনিস্ট মাওয়ের চীন নয়। মাও তখনো কেউ নন। তাই আরও চার বছর পরে ১৯৪৯ সালে মাওয়ের বিপ্লব ঘটলে সেটাকে বলা যায়, অজান্তে মাওয়ের আমেরিকার পরিকল্পনার বাইরে চীনকে নিয়ে চলে যাওয়া। সে প্রসঙ্গের দিকে এখন আর বাড়ব না। 

কারণ, আমাদের প্রাসঙ্গিক বিষয় হল আলাদা। রুজভেল্টের একচ্ছত্র ক্ষমতার সেই আমেরিকা আর এখনকার আমেরিকা এক নয়। সময়টাও তা নয়। সব ভারসাম্য বদলে গেছে। কাজেই এখন কেবল আমেরিকার ইচ্ছায় কাউকে নতুন ভেটো-মেম্বর করার সুপারিশের কোনো দাম নেই। একক ক্ষমতা এখন নেই। 

আসলে বটম লাইনটা হল, দুনিয়ার প্রথম গ্লোবাল নেতা আমেরিকার হাতে জাতিসংঘ কেমন হবে, কেন পাঁচ ভেটো সদস্য সম্পন্ন হবে সেসব সাব্যস্ত হয়েছিল। তাই, একমাত্র আগামী গ্লোবাল নেতার উত্থান সমাপ্ত হওয়ার পরেই জাতিসংঘের পরিণতি কী হয় তা সাব্যস্ত হতে পারে। এর আগে আমেরিকা যদি যে কাউকে নতুন ভেটোসদস্যের জন্য সুপারিশ করে তবে সেটা চীনের এক ভেটোর ক্ষমতাই যথেষ্ট। এই পাওয়ার দিয়ে সে সবকিছু রুখে দিতে পারে। এই সরল কথা ভারতের রাজনীতিক, একাডেমিক বা মিডিয়া কেন বুঝতে পারছে না সেটা এক বিস্ময়! তার মানে, ভেটো ক্ষমতা সম্পন্ন কাঠামোর জাতিসংঘ কেন গঠন করা হয়েছিল সেটা নিয়ে চিন্তা করা, বোঝা ও আমল করার মত কোনো লোক যেন ভারতে কেউ নাই! তাই কী? সেটাইবা হয় কীভাবে!

তাহলে সারা ভারত আমেরিকার অনুগ্রহ লাভে ব্যস্ত কেন? সদস্যপদ না হওয়ার জন্য আমেরিকার প্রতিশ্রুতির ওপর তাদের এত নির্ভরশীলতা কেন? প্রতিশ্রুতি খেলাপের জন্য দায়ী করা কেন - যেটার কার্যত কোনো মূল্য নাই, এসবের জবাব মেলে না!

লেখক- রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //