শোক দিনের কথা

'৭৫ এর ১৫ আগস্ট রচিত হয় এক কলঙ্কিত অধ্যায়। এ দিন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন ঘাতকের নির্মম বুলেটে। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতা দখল করেন খন্দকার মোশতাক। দুঃসময়ের দিনগুলোতে ঘাতক-কুশীলবেরা অনেক অসত্য তথ্য ছড়িয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন তাদের নিজেদের প্রয়োজনে। ব্যবহার করেছেন সরকারি সংস্থাগুলোকে। স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারনা চালাতেও তারা কার্পণ্য করেনি।

দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে এলেন মওলানা ভাসানী। পূর্বে তিনি আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। অন্যদিকে দেশভাগের পরপরই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ আবদ্ধ হয়ে পড়লো আহসান মঞ্জিলে। সাধারণ সদস্য গ্রহণ এক প্রকার নিষিদ্ধ। পাকিস্তানের নানা কার্যকলাপে দেশবাসী বিক্ষুব্ধ। পাকিস্তান আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়ে শেখ মুজিবসহ যারা মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন সকলেই বিব্রত।

জনগণের মুক্তির দিশা দিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন হয়। চল্লিশ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে মওলানা ভাসানী হলেন সভাপতি আর জেলে থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভাসানী তরুণ মুজিবকে সাথে নিয়ে ঘুরেছেন বাংলার পথে প্রান্তরে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার পক্ষে আদায় করেছেন সমর্থন। সময়ের পরিক্রমায় এভাবেই ভাসানী-মুজিব গুরু-শিষ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। শেখ মুজিবকে ভাসানী দেখতেন পুত্রসম অধিকারে। শেখ মুজিবও শ্রদ্ধা করতেন একেবারেই ভেতর থেকে।

স্বাধীনতার পর সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন ভাসানী। আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সম্পসারণবাদী অধিপত্যের বিরুদ্ধে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অনশন করেছেন এবং তাঁকে গ্রেফতার ও গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়েছে।

'৭৫ সালে বাকশাল গঠন হলে তৎকালীন সরকার মাত্র চারটি ছাড়া দেশের সকল দৈনিক বন্ধ করে দেন। চারটির মধ্যে আগে থেকেই সরকারি মালিকানাধীন ছিলো দৈনিক বাংলা। বাকশাল গঠন হলে বাকী তিনটিও সরকারি মালিকানায় চলে আসে। হক কথা বন্ধ করে দেওয়া হয় তারও অনেক আগে। বড় দাগে গণমাধ্যম সরকারি মুখপত্রে পরিণত হয়।

১৫ আগস্টে সকালের খুব কাছাকাছি সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাসঘাতক লোকদের ষড়যন্ত্রে শাহাদাত বরণ করলেন। সারাদেশে বেতারে প্রচারিত হলো। বেতার এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো কাজে লাগালো ষড়যন্ত্রীরা। বুলেটের চেয়ে প্রচার যন্ত্রটা খুব দ্রুত কাজে লাগলো তাদের পক্ষে। এই সময়ে মওলানা ভাসানী ছিলেন টাঙ্গাইলে তাঁর সন্তোষের বাড়িতে। তাঁর মজিবরকে কেউ মেরে ফেলেছে শুনেই তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। কখনো মসজিদের ভিতরে যাচ্ছেন, আবার কখনো বাইরে উঠোনে আসছেন। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী মসজিদের ভিতরে অবস্থান নিয়ে ভেঙে পড়লেন কান্নায়। মোনাজাত করেছেন তাঁর মজিবরের মঙ্গলের জন্য। 

ক্ষমতায় এলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকারের অনেকে যোগ দিলেন খন্দকার মোশতাকের সরকারে। সারাদেশে কোথাও প্রতিবাদী আন্দোলন হলো না। দুঃসময়ের  দিনগুলোতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লন্ডনে একটি প্রতিবাদী বিবৃতি দিতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি রাজি হননি। ক্ষমতা পেয়ে  মওলানা ভাসানীর কাছে দোয়া এবং সমর্থন চাইতে সন্তোষে ভাসানীর দুয়ারে হাজির হলেন খন্দকার মোশতাক। উত্তেজিত ভাসানী জানিয়ে দিলেন ওরা আমার এক পোলা মজিবরকে মেরে আবার আমার কাছেই আসছে সমর্থন নিতে! খন্দকার মোশতাক সেদিন সমর্থন পাননি, কিন্তু ক্ষমতার শেষ দিন পর্যন্ত ভাসানীর অপেক্ষায় ছিলেন। তার আশা পূরণ হয় নি কখনো।  

১৫ আগস্টের পরপরই জাতীয় দৈনিকে মোশতাক সরকার সমর্থনে ভাসানীর নামে বিবৃতি প্রকাশ হয়। কয়েকদিন পরেই অসুস্থ হয়ে ঢাকার পিজি হাসপালে ভর্তি হলে চিকিৎসাধীন ভাসানীকে ২২ সেপ্টেম্বর দেখতে যায় প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক। পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়। খন্দকার মোশতাকের এই সাক্ষাৎ 'প্রমাণ' হিসেবে চাউর হতে থাকে যে মওলানা ভাসানী মোশতাক সরকারকে সমর্থন জানিয়েছেন। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় এসে ভাসানীকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছেন এটা সত্য। তবে ভাসানী কখনোই তাকে প্রশ্রয় দেননি।

মোশতাক সরকারের সমর্থন প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীর বিবৃতি এবং সাক্ষাতের খবর যখন প্রকাশ হয় তখনো বাকশালের সেই চারটি পত্রিকাই বহাল। এমনকি ১৫ আগস্টের পরে মোশতাক সরকারকে ভাসানীর সমর্থন বিষয়ক আলোচ্য প্রতিবেদনে মওলানা ভাসানীর বিবৃতি উদ্ধৃত করা হয়েছে 'বিশ্বস্ত সূত্রের' বরাত দিয়ে। সরাসরি ভাসানীর কোন বক্তব্য সেখানে নেই। সুতরাং খন্দকার মোশতাক গণমাধ্যমকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেছেন এটা স্পষ্ট।  দ্বিতীয়ত পাকিস্তান আমল থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী খানের পর এমন কোন গভর্নর, জেনারেল, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রাদেশিক গভর্নর নেই যিনি কোন না কোন সময়ে মওলানা ভাসানীর সাথে সাক্ষাৎ করেননি। রাজনৈতিক বিরোধীতা স্বত্তেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নানা সমস্যায় শেখ মুজিবুর রহমানও ছুটে গেছেন এই লাল মওলানার কাছে। দলীয় রাজনৈতিক কারণে সব সময় প্রকাশ্যে যাননি। তবে প্রকাশ্যে যখন গেছেন, সকলের সামনে মওলানার পায়ে হাত দিয়ে কদমবুচি করেছেন।

বর্তমান সময়ে অনেকে দাবি করেছেন  ফারাক্কা লংমার্চে নেতৃত্ব দেওয়া মওলানা ভাসানী মোশতাক সরকারকে যদি সমর্থন না করবেন '৭৫ এ বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন না কেন? শেখ মুজিবের নিজের অনুসারীরা যখন পালিয়ে গেছেন, দেশের কোন আড়ালেই যখন সামান্য প্রতিবাদী আন্দোলন হয় না, শেখ হাসিনার অনুরোধে লন্ডনে বসেও যখন বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামান্য প্রতিবাদী বিবৃতি পাঠাতে নারাজ, তেমন পরিস্থিতিতে জনমানুষের কাছে মুজিববিরোধী হিসেবে পরিচিত এবং গোয়েন্দা নজরদারিতে গৃহবন্দী মওলানা শেখ মুজিবের পক্ষে কিভাবে দাঁড়াবেন? 

মওলানা ভাসানী সব সময় জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিঁনি ছিলেন আপসহীন। মওলানা ভাসানী কখনোই হত্যার ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। শিষ্য শেখ মুজিবকে সতর্কও করেছিলেন একবার। অথচ পুত্র শোকে বিহ্বল তাঁর নামেই প্রচার হলো শোক দিনের কলঙ্কিত অধ্যায় সমর্থনের।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ভাসানী পরিষদ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //