ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ অন্য গ্রহের কেউ নন

রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক ফোরামের উপদেষ্টা মীর সাহাবুদ্দিন টিপুর ফোনালাপ ফাঁস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।

ফাঁস হওয়া ওই ফোনালাপে শোনা যায়, অধ্যক্ষ কামরুন নাহার লেখার অযোগ্য ভাষায় গালাগাল করছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি কিন্তু গুলি করা মানুষ। রিভলবার ব্যাগের মধ্যে নিয়ে হাঁটা মানুষ। আমার পিস্তল বালিশের নিচে থাকত।’ তদন্ত কমিটি করলে ‘দা দিয়ে’ কোপানোর হুমকির কথাও শোনা যায় ওই কণ্ঠে। এক সময়ে ‘রাজনীতি’ করার কথা বলে তিনি বলেন, ‘আমার ছাত্রলীগ, যুবলীগ আছে, আমার যুব মহিলা লীগ আছে।’

এই ঘটনার পরে ভিকারুননিসার গভর্নিং বডির সদস্য মনিরুজ্জামান খোকনের সঙ্গে অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের ২৭ মিনিট ৩ সেকেন্ডের আরেকটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। এটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই ফোনালাপে অধ্যক্ষকে বলা হয়, ‘...কোর্টের চিন্তা করলে ভিকারুননিসায় প্রিন্সিপালগিরি করতে পারবেন না।’

ফোনালাপ ফাঁসের আইনি ও নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও এর সঙ্গে জড়িত। বস্তুত সব ধরনের ফোনালাপ ফাঁসই অপরাধ, অনৈতিক; কিন্তু কিছু কিছু ফোনালাপ ফাঁস না হলে তো আমরা জানতেও পারতাম না, ওই লোকগুলো আসলে কতটা কদর্য। আমরা জানতে পারতাম না, শিক্ষক পরিচয়ের আড়ালেও কত ভয়ংকর, রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থার জন্য। ভয়াবহ ক্ষতিকর লোকজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে রয়েছেন! এই ফোনালাপটি ফাঁস না হলে জানা যেত না যে, রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বালিশের নিচে পিস্তল নিয়ে ঘুমাতেন! ভাবতে অবাক লাগে, এই ভদ্র মহিলা শ্রেণিকক্ষে কী পড়ান? তিনি তার ছাত্রীদের কী শিক্ষা দেন? কী নৈতিকতা শেখান?

প্রসঙ্গত, কামরুন নাহার শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর তাকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কামরুন নাহারের আগেও এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে ওই অধ্যক্ষকে প্রত্যাহার করা হয়। গণমাধ্যমের খবর বলছে, যোগদানের পর থেকে কলেজের বাসভবনে থাকলেও তিনি কখনো নিজ অফিসে বসেন না। অভিভাবকরা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেও, কারও সঙ্গে তিনি দেখা করেন না। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে অশালীন ভাষায় কথা বলারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ভিকারুননিসার অধ্যক্ষকে নিয়ে আমরা কেন এত কথা বলছি? তিনি কি অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছেন? তা আসেননি; কিন্তু এ কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, অন্য যে কোনো পেশার লোকদের চেয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে মানুষ একটু বেশি নীতি-নৈতিকতা ও শালীনতা প্রত্যাশা করেন। একজন পরিবহন শ্রমিক এমনকি একজন রাজনৈতিক নেতার মুখেও কোনো গালি শুনলে বা বাজে কথা শুনলে সাধারণ মানুষ সেটিকে যেভাবে দেখে; সেই একই গালি বা কথা একজন শিক্ষকের মুখ থেকে শুনতে চায় না। মানুষ মনে করে শিক্ষকের আচরণ হবে মার্জিত। তিনি হবেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। মানুষ প্রত্যাশা করে, একজন শিক্ষক বেতন যা-ই পান না কেন, তিনি যা-ই খান না কেন, তিনি পরিপাটি পোশাক পরে রাস্তায় বের হবেন। তার সঙ্গে অন্য মানুষ যে আচরণই করুক না কেন, তিনি সংযত থাকবেন। কোনো অবস্থাতেই তিনি খিস্তি করবেন না। এমনকি রিকশাচালক বা দোকানদারের সঙ্গেও বচসায় লিপ্ত হবেন না। অর্থাৎ তার সমস্ত কাজকর্মেই একটা শিক্ষকসুলভ ব্যাপার থাকবে- যার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজে আর দশজন মানুষের চেয়ে সহজেই আলাদা হয়ে যাবেন। যার মধ্য দিয়ে তিনি অন্য যে কোনো পেশার মানুষের চেয়ে সমাজে অনেক বেশি সম্মানজনক তথা সর্বজন শ্রদ্ধেয় হিসেবে বিবেচিত হবেন। মূলত এ কারণেই ফাঁস হওয়া ফোনালাপে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের মুখে যেসব অশ্লীল এবং লেখার অযোগ্য শব্দ শোনা গেছে- তা কোনোভাবেই, কোনো যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। 

টেলিফোনের অপর প্রান্তের লোকটি তাকে যতই প্ররোচিত বা উত্তেজিত করুন না কেন; অপর প্রান্তের লোকটি যতই খারাপ হোক না কেন; একজন অধ্যক্ষের মুখ থেকে, একজন শিক্ষকের মুখ থেকে এসব অশ্লীল শব্দ বের হতে পারে না। মুখ থেকে বেরিয়েছে মানে, এগুলো তার মগজে আছে। যে মানুষের মগজে এরকম অশ্লীল শব্দ আছে, তিনি কী করে শিক্ষক হলেন- সেই প্রশ্নটিই বরং সামনে আনা দরকার। 

কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন যে, একসময় তার বালিশের নিচে পিস্তল থাকত। বোঝাই যাচ্ছে এটা তিনি ভয় দেখানোর জন্য বলেছেন; কিন্তু একজন শিক্ষক কি এ কথা বলতে পারেন? তিনি এও বলেছেন যে, তিনি রাজনীতি করা মেয়ে। তিনি এত ভালো না। তার মানে কি এই যে রাজনীতি করা মেয়েরা ভালো হয় না? রাজনীতি করা মেয়ে মানেই তাকে বালিশের নিচে পিস্তল নিয়ে ঘুমাতে হবে? রাজনীতি করেছেন বলেই তাকে খিস্তি করতে হবে? রাজনীতি করেছেন বলেই তাকে সমাজে প্রচলিত সবচেয়ে খারাপ ভাষায় কথা বলতে হবে? বলা হচ্ছে, এই ফোনালাপ এডিট করা। তবে এটিই প্রথম নয়, এর আগেও যত ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, তার সবগুলোর ব্যাপারেই বলা হয়েছে যে, এগুলো এডিট করা। প্রশ্ন হলো, এডিট করে কি কারও মুখ দিয়ে গালি বের করা সম্ভব? এডিট করে হয়তো আগে পরের শব্দ বা বাক্য ফেলে দেওয়া যায়; কিন্তু তিনি যা বলেননি সেটি কী করে যুক্ত করা যায়? 

আবার এ প্রশ্নও উঠতে পারে, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় মানুষ অনেক সময় স্ল্যাং ব্যবহার করে এবং এগুলো নিয়ে কোনো কথা বলা উচিত নয়; কিন্তু এই শিক্ষক যা করেছেন সেগুলো শুধু স্ল্যাং নয়। তাছাড়া তিনি একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরেও যদি এসব শব্দ প্রয়োগ করে থাকেন, তাহলেও তিনি আর শিক্ষক থাকার অধিকার রাখেন না। কারণ ফোনালাপ ফাঁসের সুবাদে হোক আর যেভাবেই হোক, তার মুখ থেকে যেসব শব্দ বেরিয়েছে, তারপর থেকে তাকে আর শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়ার কোনো মানে নেই। নৈতিক কারণেই তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত এবং তার বিরুদ্ধে অন্য কোনো অভিযোগ থাকলে সেটিরও তদন্ত হওয়া উচিত। 

একজন ভিসি, একজন অধ্যক্ষ, একজন শিক্ষক সমাজের আর দশ জন মানুষের চেয়ে আলাদা; কিন্তু সেই সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্রদের নিয়ে দেশের গণমাধ্যমে এরকমও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে যে, রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে গেলেন ভিসি; পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়লেন গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য; ভিসির পদত্যাগে ক্যাম্পাসে উল্লাস; যুবলীগের চেয়ারম্যান হতে চান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি; ভিসি কলিমুল্লাহর দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ ইত্যাদি। সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত পেশার মানুষের ব্যাপারে এরকম সংবাদ শিরোনাম কি আমরা প্রত্যাশা করি? একজন ভিসি পদত্যাগ করবেন এবং সেই আনন্দে তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে উল্লাস করবে, মিষ্টি বিতরণ করবে, এটি ওই শিক্ষকের জন্য শুধু ভয়াবহ লজ্জারই নয়, বরং তিনি সারাজীবন যা পড়লেন, যা শিখলেন এবং ছাত্রছাত্রীদের যা শেখালেন, তার সবই তো ব্যর্থ হয়ে গেলো।

শিক্ষক এ কারণে যে, তিনি যতক্ষণ তার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকেন, ততক্ষণ তিনি আলোর পথ দেখান। ছাত্রছাত্রীদের তিনি জানিয়ে দেন আলোর মাঝেও বিদঘুটে অন্ধকার বিরাজ করে। শিক্ষক সেই আলো-অন্ধকারের ভেদ বুঝিয়ে দেন। তাকে সত্যের পথ দেখান এবং মিথ্যাকে চেনান। তিনি তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করেন না। এ কারণে তিনি শিক্ষক। এখন আপনি আপনার চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন, কতজন শিক্ষক আছেন।

এটিও বাস্তবতা যে, শিক্ষকরা সমাজের বাইরের কেউ নন। যখন একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সর্বত্র অনিয়ম ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকে শিক্ষকরা মুক্ত থাকবেন, সবাই হয়তো সেটি প্রত্যাশাও করেন না। তাছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কিংবা বড় স্কুল কলেজের অধ্যক্ষের পদগুলোতেও এখন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ শিক্ষকের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা যাই থাকুক না কেন, তিনি লোকদলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে ভিসি বা অধ্যক্ষ হতে পারবেন না। যে কারণে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলতে পারেন, ‘আমার ছাত্রলীগ, যুবলীগ আছে, আমার যুব মহিলা লীগ আছে।’ তবে সত্যিই তিনি এই কথাগুলো বলেছেন না কি তার দাবি অনুযায়ী এগুলো সুপার এডিট করা, সেটির তদন্তও জরুরি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //