স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি সর্বগ্রাসী নয় কী?

বাংলাদেশে যিনি দু’পাতা পড়তে পারেন বা পড়ে বুঝতে পারেন তিনিও জানেন দেশে বিভিন্ন খাতে ব্যাপক দুর্নীতি চলছে। আজকেই চলছে এমন নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এখন সেই চলাটা ‘মহামারি’ রূপ নিয়েছে। 

সাধারণত টিআইবি প্রতি বছর দুর্নীতির যে খতিয়ান দেয়, সেখানে পালাক্রমে তিনটি বিভাগ ভাগাভাগি করে দুর্নীতিতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়। কোনো বছর আইন বিভাগ, কোনো বছর পুলিশ বিভাগ, কোনো বছর স্থানীয় সরকার বিভাগ তো কোনো বছর শিক্ষা বিভাগ। তবে যে বিভাগের দুর্নীতি অনেকেরই অগোচরে পড়ে থাকে, সেটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতির ‘সর্বগ্রাসী’ রূপ ধরা পড়ে গত বছর করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর পরই। এর আগে এই মন্ত্রণালয় ও এর অধিদফতরগুলোর দিকে সাধারণ মানুষের নজর সেভাবে পড়ত না। 

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর দেখা গেল এই স্বাস্থ্য অধিদফতরের খোল-নলচে, কড়ে-বর্গাসমেত পুরোটাই দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন। ২০২০ সালেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতি নিয়ে দিনের পর দিন পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। চ্যানেলগুলোতে লাগাতার প্রতিবেদন, টকশো হয়েছে। করোনা সংক্রমণের ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ, জেকেজির সিইও আরিফুল হক চৌধুরী ও চেয়ারম্যান সাবরিনা চৌধুরীকে আটক করা হয়েছে। পরীক্ষা না করে করোনা সংক্রমণের ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ ওঠা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে আটক করা হয়েছিল। ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানায় র‌্যাবের করা মামলায় বলা হয়েছে, ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রায় ছয় হাজার লোকের কাছ থেকে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আদায় করেছে রিজেন্ট হাসপাতাল। পরে সাহেদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৯০০ কোটি টাকার পিপিই ও মাস্ক দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিইসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ১৫ জুন দুদক কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন শিবলীকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছিল।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও পিছিয়ে ছিল না। মন্ত্রণালয়ের এক নথিতে দেখা যায়, গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু নামে একজন এই সিন্ডিকেটের (সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী যার কথা বলেছেন) মূল নেতৃত্বে রয়েছেন। নথিতে সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে একজন সাবেক মন্ত্রী, একজন বর্তমান মন্ত্রী, তার পিএস ও তার ছেলের নামও রয়েছে। বর্তমান মন্ত্রী, তার পিএস ও ছেলে এই সময়ে নানা অর্ডার ও কেনাকাটায় প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে নথিতে বলা হয়। এসবই বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট আকারে ছাপা হয়েছে। তারপরও এই ক্ষেত্রগুলোতে দুর্নীতি এতটুকু কমেনি বরং এ বছর করোনার টিকা নিয়ে দুর্নীতি, অযোগ্যতা, অব্যবস্থা চরমে পৌঁছেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হয়েছিল। 

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মাস্ক, পিপিইসহ সুরক্ষাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও তদন্ত করে কেনাকাটায় দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপরই জড়িতদের ধাপে ধাপে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে গত ২২ মে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার স্থলে বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) আবু হেনা মোরশেদ জামানকে পদায়ন করা হয়। সিএমএসডির পরিচালকের বদলির পর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার গুঞ্জন ওঠে’ (সমকাল, ০৫ জুন ২০২০)।

পরিস্থিতি একটু অনুকূল হলেই ফের তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে দুর্নীতি শুরু করেন। সিএমএসডির ৯০০ কোটি টাকার কেনাকাটার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তার বরাতে সে সময় জানা যায়, করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকাটা নিয়ে একাধিক গ্রুপ সক্রিয় হয়ে মাঠে নামে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের দুটি গ্রুপ নিজেদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়-সংক্রান্ত আদেশ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ বিরোধে সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় পিপিই, মাস্কসহ সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে দেরি হয়। পরে দুই গ্রুপ এক হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিবি ল্যাপ্রোসি ও এসটিডি এইডস কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম এবং পরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবিরকে ক্রয় প্রক্রিয়ার সার্বিক বিষয় দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সামিউল ইসলামকে করোনা-সংক্রান্ত সিএমএসডি ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্রয় প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব করা হয়। তবে তিনিই ছিলেন মূল সমন্বয়কারীর ভূমিকায়। ডা. ইকবাল কবিরকে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এডিবির দুটি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দুই কর্মকর্তাই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বিদায়ী সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জরুরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পটির আওতায় এক লাখ সাত হাজার ৬০০ পিপিই ক্রয় করা হয়। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। প্রত্যেকটি পিপিই ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল চার হাজার ৭০০ টাকা। এক লাখ সেফটি গগলস ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০ কোটি টাকা। প্রতিটি গগলসের দাম ধরা হয় পাঁচ হাজার টাকা করে। ৭৬ হাজার ৬০০ জোড়া বুট ক্রয়ের জন্য ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। এতে প্রত্যেকটির দাম ধরা হয় এক হাজার ৫০০ টাকা করে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রত্যেকটি পণ্যের দাম দুই থেকে পাঁচগুণ বাড়তি দেখানো হয়েছিল।

গবেষণার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ইনোভেশন খাতে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। ভ্রমণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। মাত্র ৩০টা অডিও-ভিডিও ফিল্ম তৈরির ব্যয় দেখানো হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৮০টি সেমিনার ও কনফারেন্স করে খরচ ধরা হয়েছে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। মাত্র চারটি ওয়েবসাইট উন্নয়ন করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। পাঁচটি ডাটাবেস তৈরিতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি কম্পিউটার সফটওয়্যার কেনায় খরচ ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। এছাড়া ৩০টি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে আরও ৪৫ কোটি টাকা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা। অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা (প্রাগুক্ত)। দুর্নীতির খতিয়ান এত সংক্ষিপ্ত নয়। আরও আছে। এ মাসের ১৯ তারিখে টিআইবি এক প্রতিবেদনে বলেছিল-‘করোনাভাইরাস মহামারিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির মহোৎসব।’

স্বাস্থ্য খাতে গত তিন মাসে নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য, কেনাকাটায় দুর্নীতি আর অনিয়মের অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে, যেসব খবরের কোনো প্রতিবাদও আসেনি সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে। 

দরকারি উপকরণের অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাসপাতালে সেবার অভাব, নিয়োগ আর কেনাকাটায় একের পর এক দুর্নীতির খবর যেন এই খাতের বেহাল দশাকেই তুলে ধরেছে; কিন্তু এসব অভিযোগ আমলে নেয়নি স্বাস্থ্য খাতের কর্তাব্যক্তিরা। 

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি মিলিয়ে দুর্নীতি বেশি হয়, এমন ১১টি খাত চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন; কিন্তু ওই তদন্ত পর্যন্তই হয়েছিল। এর পরে কী ঘটল, কার সাজা হলো বা কাকে দায়ী করা হলো, সরকারের টাকা পয়মাল করবার জন্য কার কি শাস্তি হলো তা অজানাই থেকে যায়। এই ‘অনিয়মটাই’ এখন যেন ‘নিয়ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। করোনাকালে আরেক আলোচিত নাম আবদুল মালেক ওরফে বাদল। তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক। পেশায় গাড়িচালক হলেও অঢেল সম্পদের মালিক তিনি। সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকায় তার দুটি সাত তলা ভবন, নির্মাণাধীন একটি দশ তলা ভবন, জমি, গরুর খামার খুঁজে পায়। দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে ঢাকার একটি মৌজাতেই মালেক ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের সাতটি প্লটের সন্ধান পায়। গত ২০ সেপ্টেম্বর তুরাগের বামনারটেক এলাকার একটি সাত তলা ভবন থেকে মালেককে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

এবার সাংবাদিক রোজিনা চান বা না চান সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে এই আওয়াজ উঠতে পারে- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আগাপাশতলা তদন্ত করে ক্রনিক দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনা হোক। করোনা মহামারির চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এই খাতের অমানবিক সীমাহীন দুর্নীতি, যা চিকিৎসাপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা অধিকারবঞ্চিত করছে। এখনই সময় এই দুষ্টচক্র ভেঙে ফেলার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //