ইংরেজির জয় হোক!

১৯৫২ সালের যে দিনটিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকার রাজপথ আজ সেই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রূপান্তরিত। বাংলার ভাষা শহীদদের ও বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের জন্য এ এক বিরাট সম্মান। ভাষার অধিকারের জন্য পৃথিবীতে আজও যারা যুদ্ধ করে চলেছেন তাদের জন্যও এ স্বীকৃতি প্রেরণাদায়ক। একুশে ফেব্রুয়ারির এমন অনেক গৌরবের আমরা তালিকা তৈরি করতে পারি। কিন্তু সেদিনের ভাষা শহীদেরা আজ অকল্পনীয় উপায়ে জীবিত হয়ে উঠলে কি খুশি হতেন এখন বাংলা ভাষার দশা দেখে? দেখে শুনে তাদের কি মনে হতো না যে তারা উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে জীবন দান করেছিলেন ইংরেজি ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য? এবং তারা কি পুনরায় শহীদ হতে চাইতেন না?

সালাম বরকত রফিক জব্বারের জীবনোৎসর্গ সবচেয়ে গৌরবময় পরিণতি পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের স্বপ্ন পূর্ণতা পাওয়াই ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু হলো উল্টা। বাংলা ভাষাকে প্রতিদিন পথ ছেড়ে দিতে হচ্ছে ইংরেজির দৌরাত্মের কাছে। বাঙালির আরেক অংশ পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা আরো সঙ্গীন- তাকে পথ ছেড়ে দিতে হচ্ছে হিন্দি ও ইংরেজি দুইয়েরই কাছে। বাংলাদেশে আবার আরেক সংকট। এখানে বাংলা কেবল পথই ছাড়ছে না, ক্রমাগত বিকৃত হচ্ছে। একদিকে সকল আঞ্চলিক ভাষার জাতীয় স্বেচ্ছাচার প্রমিত বাংলা ভাষাকে নিয়মিত প্যাঁদাচ্ছে নানারকম উচ্চমার্গীয় দার্শনিক মার্কা ফতোয়ার আবরণে। অন্যদিকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার, গণমাধ্যমের একাংশে ইংরেজি ঢঙে বাংলা কথা বলার নোংরা ফ্যাশন এবং সর্বোপরি এক ‘বাংলাটা-ভাল-জানি-না’ শ্রেণির উদ্ভব।

এ অবস্থা নিয়ে হাহুতাশ বহুকাল ধরে চলছে। বাংলা ভাষা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কান্নাকাটি হচ্ছে ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে। শিক্ষিত একটি শ্রেণি মাতৃভাষার প্রতি গদগদ হয়ে উঠছি এ মাসে। চলে কবিতা, গল্প, গান ও লেখালেখি। এরপর এগারো মাস সব ভুলে থাকি। সেই সাথে ইংরেজি ভাষার কাছে নতি স্বীকার বজায় থাকে সারা বছরই। ইংরেজিপ্রীতির পারদ প্রতিদিন উপরে উঠতেই থাকে। এই যে চক্র যা নিয়ম করে ঘুরছে তার কারণ কি? সুরাহা হচ্ছে না কেন?

কারণ ভাষা বিষয়ে আমাদের মূল আলোচনা এখনো তরল রোমান্টিক আবেগনির্ভর। বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগি কথাবার্তার মূল সুর হচ্ছে এ আমাদের মায়ের মুখের ভাষা। মাকেও যেমন আমরা আকাশে তুলে দিয়ে আড়ালে নিয়মিত নারীর অমর্যাদা করছি, আত্মপ্রতারণা করছি, ভাষার বেলায়ও তেমনই হচ্ছে। মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা সব ছেড়ে রোজ বিদেশে পাড়ি দেয়ার ও বিদেশি হওয়ার পাঁয়তারা করছি। হিসাবটা মিলছে না- ভিতরে অপরাধবোধ কাজ করছে বা নিজেকে চালাক মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করছি। তাই আবার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে ও লোকভুলানোর ছলে মা ও মাতৃভাষাকে মাথায় তুলে নাচছি- ফেলে দেয়ার আগে। এই আবেগি কুঁড়েঘরটি সামান্য পার্থিব যুক্তির হাওয়াতেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে, শূন্যে উড়ে যায়। সেই হাওয়া হচ্ছে- ইংরেজি ছাড়া কি আজকের দুনিয়ায় টেকা সম্ভব? উন্নতি সম্ভব? ইংরেজি হলো আন্তর্জাতিক ভাষা!

এরকম উন্নতি ও টিকে থাকার মত আবেগময় যুক্তির সাথে লড়াই করা সম্ভব? দরকারই বা কি? ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ইংরেজির ভাষার বিরুদ্ধে কিছু বলেনি, উর্দুর বিরুদ্ধেও কিছু বলেনি, কারো ভাষার বিরুদ্ধেই না। সেটা হলে তো ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনাই বিপথগামী হয়। বায়ান্নর সেই আন্দোলন পৃথিবীর সকল জাতির সকল ভাষার প্রতি সমান সম্মান জানায়। যেমন বৈশ্বিক মানবাধিকারের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষ সমান, তেমনি প্রত্যেক ভাষাও অধিকারের বিচারে সমান। এই আন্দোলন সামরিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ভাষিক সকল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আমার ওপরে যেমন অন্য ভাষা চাপিয়ে দেয়ার অধিকার কারো নেই, আমার ভাষাও কারো ওপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার আমার নেই। একই সাথে আমার যেমন মাতৃভাষা ছাড়াও যেকোনো ভাষা শেখার অধিকার আছে, অন্যেরও তেমনি আছে। একাধিক ভাষা শেখা মানুষের দুর্বলতা নয়, শক্তির দিক।

তাহলে বাংলাদেশে ইংরেজির আধিপত্য নিয়ে আবার কী কথা থাকে? আসল কথাটা তো এখনই শুরু। আমাদের দেশে ইংরেজি ভাষাটি অন্যায্য আধিপত্য বিস্তার করে আছে। আসলে ইংরেজ নয় বটে, ইংরেজিই আমাদের শাসক ও বাংলা শাসিত। আর সেই কারণে আমাদের স্বাধীনতা যৌক্তিক পথে হেঁটে মুক্তির দিগন্তে পৌঁছাতে পারেনি।

অবস্থাটা একটু মনের চোখে দেখি। রাষ্ট্রকে যদি একটা পিরামিড হিসেবে কল্পনা করি আর এর ভিতরে কোন স্তরে কী ভাষায় কথা হচ্ছে দেখি, তবে একেবারে নিচের দিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কক্ষে আঞ্চলিক ভাষা শুনবো। তার একটু উপরে ক্ষুদ্রতা ভেঙ্গে বিরাট কক্ষে সমগ্র পিরামিড জুড়ে প্রমিত বাংলায় কথা হচ্ছে। আর পিরামিডের অর্ধেক থেকে যতই উপরে কান পাতবো তত বেশি ইংরেজি কিচিরমিচির শুনবো। উপরের দিকে বাংলা উধাও হচ্ছে, সংখ্যায় কিচিরমিচিরকারীরা সামান্য বটে, কিন্তু তারাই শক্তিমান, শাসক, পিরামিডের ভিতর বাকি সবার ভাগ্য নির্ধারণকারী।

ভাষার উৎপত্তি নিয়ে বাইবেলে বেবেলের টাওয়ার ঘিরে একটি গল্প আছে যার গুরুত্ব এখনো অপরিসীম। বলা হয় শুরুতে মানবজাতির একটিমাত্র ভাষা ছিলো। এতে তারা একত্রিত ও শক্তিমান ছিলো। ঈশ্বর এতে নাখোশ হলেন। তখন তিনি অনেক ভাষা তৈরি করে একেক দলকে একেকটা দিলেন। যাতে নিজের দলে তারা একে অপরকে বুঝলেও অন্যদলের কেউ তা বুঝতে না পারে। মোট কথা ঈশ্বর ভাষা তৈরি করলেন মানুষের মনের কথা গোপন করার জন্য।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের এক ভাষা- বাংলা। এর ফলে পিরামিডের উপর থেকে নিচে সবার একে অপরকে বুঝতে পারার কথা। কিন্তু আমাদের রোগী ডাক্তারের কথা বোঝেন না, ছাত্র শিক্ষকের কথা বোঝেন না, মানুষ আমলাদের কথা বোঝেন না- আগেও যেমন এদেশের সাধারণ মানুষ মুঘল, ইংরেজ ও পাকিস্তানি শাসকদের কথা বুঝতেন না- তাদেরকে রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারী মনে করতেন, এখনো করেন। স্বাধীনতার পর আমাদের সুবিধাভোগী শোষক-শাসক শ্রেণির সমস্যা হলো যে, সবাই তাদের কথা বুঝে ফেলবে। কিন্তু অন্যায্য সুবিধাভোগ, শোষণ ও শাসন টিকিয়ে রাখতে হলে যে, তাদেরও মনের কথা গোপন রাখা প্রয়োজন। ভাষা তৈরির ক্ষমতা তো আর এদের নেই। তবে এদের আছে ভাষাকে বিকৃত করার ক্ষমতা আর পুরনো প্রভুর একটি পুরনো অস্ত্র- ইংরেজি ভাষা।

এই ভাষিক দেয়ালের ফলে পিরামিডের উপরিভাগে কী কথা, পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ড হচ্ছে ও কেন হচ্ছে তা বোঝার সাধ্য নিচের ভাগের অর্ধেকের কারো নেই। মঙ্গল থেকে বহু দূরের কোনো অচেনা গ্রহ থেকে হঠাৎ এলিয়েনরা এসে পৃথিবী শাসন করলে মানবজাতির যে অবস্থা হতো আমাদের অবস্থা যে অতখানি খারাপ একথা কিছুতেই বলা যাবে না। মনের কথা আমার গোপন করার জো নেই, যেহেতু আমি একটা ভাষাই জানি। পিরামিডের উপরের দিকে যারা আছেন তাদের সুবিধা হচ্ছে তারা নিচের তলার সব কথাই বোঝেন, তদুপরি নিজেদের আছে মনের কথা গোপন করার আরেকটা ভাষা। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষা, ইংরেজিতে ডাক্তারি, কাজীর দাওয়াই ও দণ্ড সবই মনের কথা গোপন করার একেকটা প্রকল্পমাত্র। বাঁচতে হলে আমাকে ও তোমাকেও একটু ইংরেজি ফুটানো শিখতে হবে, আসল ইংরেজের কাছে তা যতই হাস্যকর মনে হোক।              

লেখক:  আলমগীর খান

সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //