মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা (৩য় পর্ব)

দেশে ও ভারতে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড বেড়ে গিয়েছিল একাত্তরের মাঝামাঝি থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের বিস্তার তখন প্রায় সারাদেশেই। কোথাও মুক্তিবাহিনী হামলা করে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সরিয়ে দিচ্ছে, কোথাও দেশের অভ্যন্তরে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। 

এর বাইরে বৃহত্তর পাবনা-সিরাজগঞ্জ-নাটোর-রাজশাহী অঞ্চলে ইপিসিপি (এম-এল) ও পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) অমিত তেজে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। একই সময় দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর যশোর-নড়াইল অঞ্চলে লড়াই করেছিল ইপিসিপির (এম-এল) নেতা-কর্মীরা। ওই দলেরই অন্যতম নেতা কমরেড নূর মোহাম্মদ তার আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- 

‘পার্টি নেতৃত্বের (ইপিসিপি-এম-এল) যে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি শেষ পর্যন্ত যশোর সীমানা অতিক্রম করে খুলনার ডুমুরিয়া গেলেন, তারা সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি। এই সময় তারা ঠিক করেন গোপনে যশোর শহরে ফিরে আসবেন। যেসব স্থানে তারা টিকতে পারেননি প্রায় সেই সব পথ ধরেই তাদের ফিরে আসতে হবে। তারা অনেক কৌশলে, দুই-তিন বার চরম বিপদের মুখে পড়তে পড়তে শেষ পর্যন্ত কেশবপুর ও চিনেটোলার মাঝামাঝি প্রধান সড়ক অতিক্রম করে লক্ষণপুর গ্রামে গোপনে এক শুভানুধ্যায়ীর বাড়িতে অবস্থান করেন। বিশ্বাসঘাতকতা করে এঁদেরকে রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। ২৩ অক্টোবর লক্ষণপুর থেকে এদেরকে ধরে নিয়ে আসা হয় চিনেটোলার রাজাকার ক্যাম্পে এবং ওই রাতেই তাদেরকে প্রথমে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, পরে ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

সারা জেলার এমনকি সমস্ত দেশের মধ্যে সেরাদের সেরার মধ্যে গণ্য করা যাবে এই শহীদদের। এই হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন- যশোর জেলার ১১ দফা আন্দোলনের আহ্বায়ক ও কলেজ ছাত্র সংসদের সভাপতি কমরেড আসাদুজ্জামান, যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি কমরেড আহসানউল্লাহ খান মানিক, গণসংগঠন বন্ধের আগে জেলা কৃষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কমরেড সিরাজুল ইসলাম শান্তি ও কমরেড ফজলু দফাদার, যিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে গ্রামে ফিরে এসে পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং আরো শহীদ হন- কমরেড মাশুকুর রহমান তোজো। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাবল অনার্সধারি ছিলেন গণিত ও পদার্থবিদ্যায়। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, কিছু দিন বুয়েটে শিক্ষকতাও করেন। পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। এ কারণে ২৩ অক্টোবর দিবসটি যশোরের কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ অদ্যাবধি নিয়মিত পালন করে আসছেন। শুধু যুদ্ধ নয়, পার্টি নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব ছিল জনগণের বিপ্লবী সরকার ও মুক্তাঞ্চল গঠন করা। ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের সক্রিয় করা ও নেতৃত্বের ভূমিকায় আনতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা।’

এর পাশাপাশি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও ন্যাপ (মোজাফফর) আওয়ামী লীগের পাশে থেকেই সর্বশক্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। সিপিবির ইকুয়েশন ছিল খুব সোজা। তারা জানত পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে প্রধানতম মিত্র দেশ হলো প্রতিবেশী ভারত, আর ভারতের পাশে ছায়ার মতো রয়েছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ‘মস্কোপন্থী’ কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি। 

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) যে সোভিয়েতপন্থী তথা ক্রুশ্চেভপন্থী তা নতুন করে বলার আবশ্যকতা নেই। তাই সিপিবি এবং ন্যাপ মনে করত তাদের কথাতেই ভ্রাতৃপ্রতিম সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করছে। আর সিপিবিকে সে কারণে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে মাথা ঘামাতেও হয়নি। বরং তারা মনে করত বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে, অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হলে সদ্য জন্ম নেয়া দেশটির শাসনব্যস্থা হবে সমাজতান্ত্রিক। এদিক থেকে বলা যায় সিপিবি নেতৃত্ব অলআউট ফাইটব্যাক করেছে শাসন কাঠামোতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। 

সিপিবি নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কোনো পার্থক্য রাখতে ব্যর্থ হয়। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অগ্রণী ভূমিকা থাকার পরও আওয়ামী লীগকে তোষণকারী দলের বদনাম হজম করতে হয়। এরা মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোর সাথে এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল যে, মুক্তিযুদ্ধ করার পরও তাদের গায়ে বামপন্থী নিধনের অভিযোগ আছে। 

ইপিসিপির (এম-এল) নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ যাদেরকে ‘চীনপন্থী’ বলা হতো তারা এবং সিপিবি, ন্যাপ (মোজাফফর)-এর নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন পার্টিসমূহ যাদেরকে ‘মস্কোপন্থী’ বলা হতো, এদের বাইরে বিভিন্ন নামে আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টি-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধকোষ বা এগারটি সেক্টরের যুদ্ধের ইতিহাস কোথাও ‘বামপন্থী’ নাম দিয়ে কোনো তথ্য মেলে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //