খন্দকার মাহমুদুল হাসান

আর হাঁটবেন না প্রাচীন বাংলার পথে-প্রান্তরে

তিনি আর হাঁটবেন না। তার পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না জয়পুরহাটের দুর্গম কালাই উপজেলার কাথাইল গ্রামের প্রত্নঢিবিতে। উঠবেন না আর সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। তাকে আর দেখা যাবে না মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার খালিয়ার রাজারাম রায়ের টেরাকোঠায় মোড়া মন্দিরের সামনে। তিনি খুঁজবেন না আর নওগাঁর ‘জগদ্দল বিহার’-এর ধ্বংসাবশেষ। তার উৎসুক মুখ আর দেখা যাবে না দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরে। তিনি আর বসবেন না নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলায় উয়ারি-বটেশ্বরে প্রত্ন-গবেষক হাবিবুল্লাহ পাঠানের সামনে। প্রাচীন কিংবা বর্তমান কোনো বাংলাতেই আমরা আর তাকে খুঁজে পাব না। হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে হেঁটে তিনি আর পা রাখবেন না তার প্রিয় বাংলাদেশে। তিনি মৃত্যুর করাল গ্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন ২৮ জানুয়ারি ২০২১, রাত ১১টায় ঢাকার একটি হাসপাতালে।

পিতা সরকারি কর্মকর্তা খন্দকার আজমল হক পাবনা জেলার লোক। মা রওশন আরা বেগম রংপুরের মেয়ে। পিতার কর্মস্থল রংপুরে খন্দকার মাহমুদুল হকের জন্ম ২৫ আগস্ট ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। লেখাপড়া কুষ্টিয়ায়, উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত। কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবন কেটেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। বেশির ভাগ বসবাস ঢাকা শহরেই। 

কীর্তিমান-দীপ্তিমান লেখক খন্দকার মাহমুদুল হাসানের বড় অসময়ে চলে যাওয়া। মাত্র ৬২ বছরের জীবন। ১৯৫৯ থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ- একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য এ জীবন-পরিধি খুবই কম। ৫৯ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবন শেষ করে ৬০ বছরে প্রায় ২০০ বইয়ের জনক ছিলেন; কিন্তু আরো বিশাল ক্যানভাসে যখন কর্মপরিধির ছক কাটছিলেন, ঠিক সেই সময়ে প্রকৃতির অমোঘ বিধান তাকে থামিয়ে দিল। কত অথর্ব-অকর্মণ্য মানুষ শত বছর বেঁচে থাকেন- এই বড়মাপের সৃষ্টিশীল মানুষটি কর্মক্ষম থেকে আরো ২০-৩০ বছর বেঁচে থাকলে প্রকৃতির কী এমন ক্ষতি হতো। 

নিভৃতচারী, নির্মোহ, শিকড়সন্ধানী, প্রচারবিমুখ খন্দকার মাহমুদুল হাসান ছিলেন একাধারে সৃজনশীল লেখক ও প্রজ্ঞাবান গবেষক। ভাস্কর্য, তাম্রশাসন, শিলালেখক, মুদ্রা, মৃৎশিল্প, টেরাকোটাসহ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় প্রত্নবস্তু, স্থাপনাসমূহ নিয়ে ছিল তার কাজ। ইতিহাস আর পুরাতত্ত্বের পাঠ নিয়েছেন অকুস্থলে গিয়ে। বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে তিনি যাননি। শুধু বাংলাদেশে নয় পশ্চিমবঙ্গেরও অনেক জেলায় গিয়েছেন প্রত্নসন্ধানে। ঘুরে এসে নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন। পরের মুখে ঝাল খাননি। এ বিষয়ে বাংলাদেশে তার জুড়ি মেলা ভার। এসব কাজ করতে গিয়ে কয়েকবার তার জীবন-সংশয়ও ঘটেছে। এইতো গেল তার গবেষণার ক্ষেত্র। 

এর বাইরে খন্দকার মাহমুদুল হাসানের সৃজনশীল সাহিত্যের কর্মপরিধিও ব্যাপক। যা যেকোনো লেখকের ঈর্ষার বিষয় হতে পারে। শিশুসাহিত্যে তার গ্রন্থ সংখ্যা ৯৪টি। যে কারণে দেশ-বিদেশে তার ব্যাপক পরিচিতি একজন প্রথিতযশা শিশুসাহিত্যিক হিসেবে। ভারত, সিকিম, ভুটান ও নেপালে তার শিশুসাহিত্যের ব্যাপক পাঠক সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দি, কামতাপুরি, কোচা, চাঙমা ইত্যাদি ভাষায় তার সাহিত্য অনূদিত হয়েছে। আর বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যের জন্য লেখক ‘অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার’ ও ‘এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন দু’বার করে। বাংলাদেশে এমন সৌভাগ্যবান শিশুসাহিত্যিক দ্বিতীয় আরেকজন আছেন বলে আমাদের জানা নেই। তার পুরস্কারের ঝুলিতে ১২টি পুরস্কার জুটলেও রাষ্ট্রীয় ‘স্বাধীনতা পদক’, ‘একুশে পদক’ বা নিদেনপক্ষে ‘বাংলা একাডেমি পদক’-এর জন্যও বিবেচিত হলেন না এই বহুপ্রজ লেখক। তার গ্রন্থরাজির বিপুলতায় চমকে উঠবেন যে কোনো সচেতন পাঠক। প্রত্নতত্ত্বের ১৯টি বই, ইতিহাসের বই ১১টি, কোষগ্রন্থ ৫টি, নৃতত্ত্ব গবেষণা ৩টি, চলচ্চিত্র ও সাময়িকী গবেষণা ৬টি, অভিধান ১টিসহ ভাষা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাধিক গ্রন্থ তো আছেই। তার বিপুল গ্রন্থরাজি থেকে মাত্র কয়টি আকর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি। প্রথম বাংলাদেশ কোষ (১ম ও ২য় খণ্ড), বাংলাদেশের পুরাকীর্তি কোষ, (প্রাচীন যুগ), বাংলাদেশের পুরাকীর্তি কোষ (মধ্যযুগ), ঢাকা অভিধান, হারানো দিনের পত্রিকা, বাংলাসাহিত্যে মুসলিম অবদান, চলচ্চিত্র, প্রাচীন বাংলার পথ থেকে পথে, প্রাচীন বাংলার ধুলোমাখা পথে, প্রাচীন বাংলার পথে প্রান্তরে, প্রাচীন বাংলার আনাচে-কানাচে, মুদ্রা ইতিহাস ও সংগ্রহ ইত্যাদি। তার শতাধিক সৃজনশীল বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করা গেল না। 

২০১৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ‘খন্দকার মাহমুদুল হাসানের ষাটতম জন্মোৎসব উদযাপন পর্ষদ’ এর সহযোগিতায় ‘সন্ধিৎসা’ নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা ঢাকা থেকে বহুমাত্রিক লেখক-গবেষক খন্দকার মাহমুদুল হাসানের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘দীপ্তিমান’ নামে ৫৩৬ পৃষ্ঠার বিশাল আকারের একটি ‘সংবর্ধনাগ্রন্থ’ প্রকাশ করে। যাতে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের শতাধিক বিশিষ্ট সাহিত্যবোদ্ধা, লেখক-পাঠক, শুভানুধ্যায়ী লেখকের সাহিত্য ও গবেষণাকর্মের মূল্যায়ন করে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা, চিঠিপত্র ইত্যাদি লিখেছেন। নিকট অতীতে বাংলাদেশে এ ধরনের সংবর্ধনাগ্রন্থের প্রকাশনার নজির নেই। 

বাংলাদেশকে জানতে হলে এদেশের প্রাচীন, মধ্য ও বর্তমান যুগের ইতিহাস জানতে হবে। এ ইতিহাস জানার জন্য যে একজন মাত্র লেখকের বই এ চাহিদা মেটাতে পারে তিনি হলেন সব্যসাচী লেখক-গবেষক খন্দকার মাহমুদুল হাসান। তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর ও মানুষের ইতিহাস লিখেছেন। তার অকালমৃত্যুতে এদেশের প্রত্ন ও ইতিহাস গবেষণার যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তেমনি ক্ষতি হলো বাংলা সাহিত্যেরও।

-লেখক: প্রাবন্ধিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //