স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিগত ৪৯ বছরে যত কাজ হয়েছে, যুদ্ধের ব্যাপ্তি আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচারে সেই কাজ খুবই সামান্য। যেখানে ৭৫ বছর আগে শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার শিল্প-সাহিত্যসহ ডকুফিকশন আর চলচ্চিত্রে যত কাজ হয়েছে, তার সিকিভাগও হয়নি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। 

পৃথিবীর এমন কোনো মান্য ভাষা নেই, যে ভাষাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, ঘটনাবলি, তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশে সে সবের কিছু তো হয়নি, উল্টে কারা যুদ্ধ করেছে আর কারা করেনি, কারা রাজাকার আর কারা মুক্তিযোদ্ধা, কোন কোন ক্যাটাগরিতে কে কে মুক্তিযোদ্ধা, সেসব নিয়ে বিতর্ক চলছে অর্ধ শতাব্দীজুড়ে। এক একটি সরকার এসেছে আর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। এমনো ঘটেছে যে, স্বাধীনতার পরে জন্ম নেওয়া মানুষও মুক্তিযোদ্ধার খেতাব বাগিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেদারছে। 

এসব আরোপ-উপারোপে সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগ উঠেছে, তা হলো- বাংলাদেশের বামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধ করেনি! এ অভিযোগের ভাঙা রেকর্ড কে বাজায়নি? শেখ মুজিবের সরকার থেকে জিয়া, এরশাদ, খালেদা হয়ে হাসিনা সরকার, সবাই। অথচ বাস্তবতা হলো বামপন্থীরাই সবার আগে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল। তারাই ‘স্বাধীন পূর্ববাংলার’ দাবি তুলেছিল ও স্বপ্ন দেখেছিল। 

আমরা এ লেখায় ধারাবাহিকভাবে সেই সব গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে আনব।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা ক্রমেই পর্দার অন্তরালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অথচ একাত্তরের সেই যুদ্ধ ও শরণার্থীদের সহায়তায় তারা প্রথম থেকেই গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিল। সেই ইতিহাস সামনে আনা দরকার।

কয়েক বছর আগে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতীয় বামপন্থীদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনাসভা ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলোচনা সভার প্রধান অতিথি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম) পলিটব্যুরোর সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছিলেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হলে, এর প্রতিবাদে ২৯ মার্চ কলকাতায় শহীদ মিনার ময়দানে সিপিএম এক জনসভার আয়োজন করে। সেখানে সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের প্রতি দলের সর্বাত্মক সমর্থন ঘোষণা করেন। একইসাথে তিনি ভারত সরকারকে এই সংগ্রামের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। এরপর থেকে সিপিএম বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তার জন্য সারা ভারতে জনমত গঠন, অর্থ সংগ্রহ, শরণার্থী ক্যাম্প স্থাপন, শরণার্থীদের চিকিৎসা, খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ প্রভৃতি কাজে যুক্ত হয়, যা যুদ্ধের পুরো সময়কাল ব্যাপৃত ছিল।

বাংলাদেশের খণ্ড খণ্ড বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারেও সিপিএম ভূমিকা পালন করেছে উল্লেখ করে বিমান বসু বলেন, ‘এ কাজে ওই সময়ে যেমন, তেমনি পরবর্তীকালেও দুই দেশের বামপন্থীরা সফল হতে পারেনি’।

এ তো গেল ভারতের বামপন্থীদের ভূমিকা। এবার দেখে নেয়া যাক, যে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে শাসকশ্রেণি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নেয়ার অভিযোগ তোলে, তাদের বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বলা দরকার। অভিযোগ ওঠে প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এ-এল), পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও অপরাপর কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের বিরুদ্ধে। অথচ এসব পার্টির প্রত্যেকটি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এসব পার্টির শত শত নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন। যেহেতু শাসকশ্রেণি কখনো এদেরকে পদক প্রদানের ঔদার্য দেখাতে পারেনি, তাই জনসাধারণের মধ্যেও অনেকে বিশ্বাস করেন; এরা বুঝি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ করেননি!

আজ আমরা তুলে ধরবো পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা কমরেড সিরাজ সিকদারের অবদান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সিরাজ সিকদার অকুতোভয় এক বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই অংশ নিয়েছিলেন ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। 

কমিউনিস্ট বিপ্লবের লক্ষ্যে ১৯৬৭ সালে তিনি ‘মাও সেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগার’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর পরই মাও সেতুঙ চিন্তাধারা অনুসারী একটি নতুন ধরনের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রাথমিক কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও বিপ্লবের প্রস্তুতিমূলক সংগঠন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাক বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের পরই তিনি ঢাকা ছেড়ে বরিশাল চলে যান ও পেয়ারা বাগান এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা ঘাঁটি গড়ে তোলেন। 

১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের ‘বিপ্লবী পরিষদ’ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানি প্রশাসন ও শ্রেণি শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহে স্বাধীন পূর্ববাংলার পতাকা ওড়ান। ওই বছরই ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এর চার নম্বর দফাটি ছিল পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ বা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করা প্রসঙ্গে। 

সিরাজ সিকদার ও তার সংগঠন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন রাজনৈতিক অবস্থান নেয় পাকিস্তানের উপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেন, উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলা। পরদিন ২ মার্চ পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন শেখ মুজিবকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার আহ্বান জানায়। একই সময় সংগঠনটি সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অস্থায়ী বিপ্লবী জোট সরকার গঠন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিষদ গঠনের অনুরোধ জানায়।

সিরাজ শিকদার যে চিঠি লেখেন তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় তিনি ও তার দল স্বাধীন পূর্ব বাংলার রূপরেখা নিশ্চিত আঁকতে পেরেছেন। যেমন- ‘পূর্ববাংলার কৃষক-শ্রমিক, প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ববাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি-সংবলিত স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন। পূর্ববাংলাব্যাপী এ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। এ উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের আহ্বান জানান।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পর সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে ৩০ এপ্রিল তারিখে গড়ে তোলেন জাতীয় মুক্তিবাহিনী। বরিশাল থেকে শুরু করে দেশের কয়েকটি অঞ্চল- বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বহারা পর্টির গেরিলারা পাক-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সর্বহারা পার্টির বহু সদস্য নিহত হয়।

বরিশালের বানারীপাড়া অঞ্চলে অবস্থান নেয় শ্রমিক আন্দোলন, ৩০ এপ্রিল গঠন করে জাতীয় মুক্তিবাহিনী, যা দখলমুক্ত করে পেয়ারা বাগানের খানিকটা। এ মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করতে সিরাজ সিকদারকে প্রধান করে সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনামণ্ডলী গঠন করা হয়। বরিশালের পেয়ারা বাগান বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম ঘাঁটি ও মুক্তাঞ্চল। এ অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক বড় অপারেশন চালাতে হয়েছিল। আবার সর্বহারা পার্টি পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখত। সর্বহারা পার্টি এ অঞ্চলে অজস্র সফল হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর। এ ছাড়াও ১৯৭০ সালের মে ও অক্টোবর মাসে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা ঢাকাস্থ পাকিস্তান কাউন্সিল, বিএনআর ভবন ও মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে যে বোমা হামলা পরিচালনা করেছিল, সেটি ছিল পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সশস্ত্র হামলা।

সিরাজ সিকদার যখন বরিশালের পেয়ারা বাগানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই করে যাচ্ছেন, সেই সময়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা-কর্মীরা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করছেন। তারা দেশের অভ্যন্তরে থেকেই যুদ্ধ করেছিলেন বলে ভারতে যাওয়া ও ভারতে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করা দলগুলোর মেনে নিতে কষ্ট হয় যে, দেশের অভ্যন্তরে বিপদসংকুল অবস্থায়ও প্রতিরোধ যুদ্ধ করা যায়। লড়াই করে টিকে থাকা শুধু নয়, একের পর এক অঞ্চল শত্রুমুক্ত করা যায়। সিরাজ সিকদার ও তার দল পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি সেই কাজটিই করে দেখিয়েছিল। তারপরও শাসকশ্রেণি আর তাদের পোষ্য বুদ্ধিজীবীরা সেই আদিকালের ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলছেন- বামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধ করেনি! অথচ ইতিহাসের নির্মম পরিণতি হলো সর্বহারা পার্টিসহ অপরাপর কমিউনিস্টদের যে শত শত নেতা-কর্মী মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তাদের নাম-গন্ধও কোথাও থাকতে দেয়নি শাসকশ্রেণি। 

আজকে যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তখন ইতিহাসের সেই সব সূর্য সন্তানদের অবদানকে কী অবজ্ঞা-অবহেলায় বিস্মৃত করা সম্ভব? যদিও তা করে সেই সব শহীদদের অবদানকে কোনোভাবেও মুছে ফেলা যায় না, যাবেও না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //