সোনালি আঁশের সোনালি অতীত ও দিশাহীন ভবিষ্যৎ

পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয়ে থাকে। এটি একটি অর্থবহ বিশেষণ। পাটের আঁশের রঙ সোনালি হওয়ার কারণে ও অবিভক্ত ভারতের এ অংশে প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় একে সোনালি আঁশ বলা হয়।

অতীতের জিডিপিগুলো পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। পাট বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে জন্মালেও বাংলাদেশ ও ভারতেই প্রায় মোট ৯৮ শতাংশ পাট উৎপাদিত হয়। এককভাবে বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ ভাগ উৎপাদিত হয় এবং এগুলো শ্রেষ্ঠ মানের। এর প্রধান কারণ হচ্ছে জমির গুণাগুণ, ধরন ও আবহাওয়া।

পাটের আঁশ দিয়ে সব ধরনের কাপড় বোনানো যায়। বলতে গেলে ঘরের ব্যবহার্য প্রায় সব ধরনের জিনিস যেমন- পর্দা, বিছানার চাদর, টেবিল ক্লথ, ঢাকনি, ম্যাট, কার্পেট পাট দিয়ে তৈরি হয়। পাট দিয়ে দড়ি, রশি, ব্যাগ, চট, প্যাকেজিং কভার ও জুটেক্স (বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে পানি প্রবাহ রোধে ও কৃষিতে ব্যবহারযোগ্য) তৈরি করা ছাড়াও পাটের আঁশ দিয়ে ঘরের ফার্নিচার, দরজা, জানালা, গাড়ির বডি, বিমানের প্যানেল নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণতায় অ-জীবাণুবিয়োজ্য জিনিস ব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যয়ে যে হুমকি দেখা দিয়েছে পাট ও পাটজাত জিনিস ব্যবহারে তা থেকে মুক্তির বার্তা এক প্রশান্তির অনুরণন বয়ে এনেছে। গ্রিন প্রডাক্ট হিসেবে পাট ও পাটজাত জিনিস মানুষ লুফে নেবে নিঃসন্দেহে। 

পাটশাক মানবদেহের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর, উপাদেয় ও জনপ্রিয় খাদ্য। এশিয়াতে শাক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পাটশাকের ভেষজ গুণের কারণে এর স্যুপ আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কিছু কিছু দেশে ওষুধ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রোটিন সমৃদ্ধ পাট শাকে রয়েছে- ভিটামিন-সি, বিটা-ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ও লৌহ জাতীয় খনিজ। রোগ নিরাময়ে পাটশাক ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২২০০-১৯০০ খ্রিস্টপূর্ব সাল থেকে ভারতবর্ষে পাট চাষ হয়ে আসছে। পাট প্রধানত দুই প্রকার, যথা- সাদা পাট ও তোষা পাট। এ দুটো জাতের পাটের সংমিশ্রণে আরেকটি হাইব্রিড পাটের জাত তৈরি করা হয়েছে যেটি ‘মেসতা’ নামে পরিচিত। 

সাদা পাট

সাদা পাট প্রথম দিকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কালক্রমে বিভিন্ন ফ্যাব্রিক্স, ইয়ার্ন, বস্ত্র, ঘরের আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরিতে এর গুণাগুণ তোষা পাটের দ্বারা নির্মিত জিনিসের তুলনায় মানসম্মত না হয়ে ওঠার দরুণ পিছিয়ে পড়তে থাকলো। বর্তমানে এ জাতটি জনপ্রিয়তা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

ইতিহাস ঘাটলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, সাদা পাট বাংলার এতদাঞ্চলের গণমানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরিতে এগিয়ে থাকার কথা ছিল। সাদা পাটের আঁশ অন্যান্য পাটের আঁশের চেয়ে শ্বেতকায়, তবে তুলনামূলকভাবে শক্ত কিংবা টেকসই নয়। এশিয়ার এ অঞ্চলে মালপত্র বাঁধতে দড়ি বা রশি, থলে, প্যাকিং ও ব্যাগ তৈরিতে এ পাটের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।

তোষা পাট

হাল্কা মেরুন রঙের লম্বা আকৃতির তোষা পাট বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত এবং খুবই জনপ্রিয়। প্রকৃত অর্থে তোষা পাট অর্থ উপার্র্জনকারী ফসল হিসেবে চিহ্নিত ও অধিক সমাদৃত। তোষা পাট শুধু টেকসই ও মজবুতই নয়, এটি বেশ লম্বা আকৃতির বিধায়, সব ধরনের কাজেই একটি বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। 

তোষা পাটকে দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব উৎপাদিত ফসল হিসেবে গণ্য করা হয়। এটা শুধু বস্ত্র, দড়ি বা রশি, থলে, প্যাকিং ও ব্যাগ তৈরিতেই ব্যবহৃত হচ্ছে না, এসব দেশে পাট খড়ি হিসেবে রান্নার কাজেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ কারণে জ্বালানির উপকরণ হিসেবে বৃক্ষ নিধন ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে।

বাংলাদেশের সাদা পাট ও অন্যান্য জাতের পাটের চেয়ে তোষা পাট মসৃণ, দীর্ঘ, টেকসই ও মজবুত। এ ধরনের পাট বদ্বীপ এলাকায় বেশি জন্মায় বলে বিশ্বে উৎপাদিত তোষা পাটের সিংহভাগই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। তবে পশ্চিম বাংলার কিছু কিছু এলাকায়ও এ পাট জন্মায়। গুণগত মান বিবেচনায় তোষা পাট শ্রেয়তর। 

মেসতা পাট 

এটি একটি হাইব্রিড জাতের পাট। এটি সাদা পাট ও তোষা পাটের সংমিশ্রণে উৎপাদন করা হয়েছে। দুই বাংলায়ই এটি চাষ হতো। এ জাতের পাট কখনো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কালে উপমহাদেশে রাজনৈতিক ডামাডোলের সময় এ বাংলা থেকে ও বাংলায় পাট চলাচলে বিপত্তি হওয়ায় এ জাতের পাট স্বল্প সময়ের জন্য ভারতের মিলগুলোতে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। 

ভালো মানের পাট উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন পলল জমি, যেখানে পানি স্থির বা একেবারে স্বল্প স্রোতে বাহিত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া পাট চাষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পাট ভালো জন্মানোর জন্য তাপমাত্রা ২০০ থেকে ৪০০ সেলসিয়াস এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাট জন্মানোর সময় ৫ থেকে ৮ সেন্টিমিটার বৃষ্টি ভালো মানের পাট প্রাপ্তিতে বেশ উপযোগী। পাটের গুণগত বৈশিষ্ট্য অর্জনে মিঠা পানি একটি প্রয়োজনীয় বিষয়।

পাটের ভঙ্গুরতা, নমনীয়তা, শক্ত আঁটুনী, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে সারাবিশ্বে মালামাল পরিবহন, স্থানান্তর, প্যাকেজিংসহ মালামাল গুদামজাত করতে এর প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য; কিন্তু অল্প কয়েকটি দেশে বিশেষ করে আমাদের মতো বিদেশ-নির্ভর দেশগুলোর ওপর পাটের উৎপাদন-সক্ষমতা পুঁজিবাদী ও ধনী দেশগুলোর কাছে একটা বিড়ম্বনা ও অসহনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে এখানকার প্রতিটি সরকারই জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে অসচেতন এবং পাট উৎপাদন এবং এর বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে উদাসীন থাকায় দেশে পাট উৎপাদন হ্রাস পায়। সেই সুযোগে ধনী দেশগুলো পাটের বিকল্প বের করতে জোর প্রচেষ্টা চালায়। ফলশ্রুতিতে পাটের বিকল্প হিসেবে পলিথিন ও প্লাস্টিকের থলে, নাইলনের দড়ি তথা পরিবেশবিনাশী, অদ্রবীভূত, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী এসব জিনিসের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। পাশাপাশি আমাদের দেশে সোনালি আঁশ হিসেবে ভূষিত হলেও বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর অদূরদর্শিতা, পরিকল্পনাহীনতা এবং গণবিরোধী নীতির ফলে পাটের ওপর বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করার কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। 

পাট আঁশ থেকে উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগ করে বুনন, বয়ন ও উন্নত যন্ত্রপাতির উদ্ভাবনের চিন্তা তিমিরেই থেকে গেছে। উন্নত মানের সুতা, বস্ত্র, আসবাবপত্র ও নানাধরনের নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র তৈরিতে প্রশিক্ষিত কারিগর গড়ে তোলা এবং উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আধুনিক পাটকল স্থাপনে কোনো রকমের উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি।

বিশ্বব্যাপী তুলার পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আঁশ হিসেবে পাট সমাদৃত। সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে পাট শিল্প বাংলাদেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক সময়ে এতদাঞ্চলে পাটকে কেন্দ্র করে বৃহৎ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল। যদিও পরবর্তীতে যথাযথ প্রকল্প ও পরিকল্পনার অভাবে ক্রমশ এ শিল্প ম্রিয়মান হতে থাকে। 

পাট ও পাট শিল্প প্রস্তুতকৃত দ্রব্যাদি ১৯৭০ পর্যন্ত এদেশের বৃহত্তর বিদেশি মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ ছিল। স্বাধীনতা ও তৎপরবর্তী সময় থেকে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের অভাবে পাটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশ দূষণকারী প্লাস্টিকসহ উৎপাদন শুরু হয়। কয়েকটি দেশ পাট উৎপাদনে এগিয়ে আসার কারণেও বাংলাদেশে পাটের বাজার মন্দা হতে শুরু করে। 

ঐতিহাসিকভাবে বাংলায় পাট থেকে দড়ি, ব্যাগ ও কাপড় তৈরিতে এর ব্যবহার ছিল। ইউরোপে নেপোলিয়ানের শাসনামলে ১৮০৩-১৮১৫ সাল অব্দি, রাশিয়া স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে বস্ত্র বুননের জন্য তিসি বা শন গাছের ফ্লাস্ক সরবরাহ করত। ইংরেজরা একটি নতুন উৎসের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল। পাট পেয়ে তাদের এ আকাক্ষা পূরণ হলো; কিন্তু পাট অনেক মোটা ও শক্ত থাকায় প্রচলিত বুননের যন্ত্রপাতিতে এটি ব্যবহার করা দুঃসাধ্য ছিল। সে কারণে যুক্তরাজ্যের বালফোর ও মেলভিল মিল কর্তৃপক্ষ পাটের মোটা আঁশকে তিমির চর্বি, পানি দিয়ে নরম ও চিকন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ব্যবহার করা শুরু করলো। ১৮৩০ সনে ডান্ডির মিল কর্তৃপক্ষ ডাচ নিয়ন্ত্রিত ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে আখ চাষের জন্য পাটের বস্তা সরবরাহের কার্যাদেশ পেলো। তারা বালফোর ও মেলভিলের পদ্ধতি অনুসরণ করে পাটের বস্তা সরবরাহ করতে শুরু করলো।

সামগ্রিকভাবে পশ্চিম বাংলা ও পূর্ববাংলায় পাট চাষ ও শিল্প কারখানার অবস্থার বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে ১৮৭৩ সনে ব্রিটিশ সরকার এইচ সি কারের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। পাট চাষের অবস্থা ও পাটের ব্যবসা সম্পর্কিত কমিশনের প্রতিবেদনটি ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, পাটের ব্যাপক চাষাবাদ ১৮৪০ সাল থেকে শুরু হয়। ১৮৫৫ সালে শ্যামসুন্দর সেন নামে একজন বাঙালি ব্যবসায়ীর সঙ্গে যৌথভাবে একজন ইংরেজ বেনিয়া জর্জ অকল্যান্ড হুগলী নদীর তীরে রীসরা নামক স্থানে প্রথম জুট মিল স্থাপন করেন। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলাকালে তন্তুর কোনো ভালো বিকল্প বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা খুব তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। আমেরিকানদের কাছে সাশ্রয়ী ও একটি ব্রিটিশ পদানত উপনিবেশিক দেশে উৎপাদনকৃত ফসল হিসেবে পাটই সবচেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে নির্ধারিত হলো। ফলে কলকাতায় ব্যাপক পাট মিল গড়ে উঠল। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে যার সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেল। ১৮৮২ সালে যেখানে ১০টি পাটকল ছিল, তা ১৯০১ সালের দিকে এসে বৃদ্ধি পেয়ে ৫১তে দাঁড়াল। এসব কারখানাতে ১৯০১ সাল অব্দি প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরির সুযোগ হলো। এসব পাটকলে প্রস্তুতকৃত পাট দ্রব্যাদির অধিকাংশ অংশই তখন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হতো। এ সব কারণে ক্রমশ বস্ত্রশিল্পের পরে পাট শিল্প ব্রিটিশ শাসিত উপনিবেশিক ভারতে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো এবং কলকাতা পাট সংক্রান্ত ব্যবসার মূলকেন্দ্র হয়ে উঠল। অধিকাংশ পাট কারখানাই কলকাতার আশপাশে গড়ে উঠল। এসব কারখানার অধিকাংশ মালিকই ছিলেন মূলত ইংরেজ বেনিয়ারা। 

১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে পাক-ভারত কথিত স্বাধীনতার নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। তখন পাট উৎপাদন বেশি হচ্ছে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলায়; কিন্তু পাটকলগুলো গড়ে উঠছিল ভারতের পশ্চিম বাংলায়। পাক-ভারত আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার ফলে ব্যাপক পাট উৎপাদন এলাকা পূর্ব-বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলার পাটকলে পাট সরবরাহের সংকট দেখা দিল। যদিও ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্য অনকেটাই অবাধ ও মুক্ত ছিল। ফলে এই দুই বছর পাট সরবরাহে তেমন কোন অসুবিধা না হলেও, পরবর্তীতে ভারত যখন পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আলাদা রাষ্ট্র ঘোষণা করে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বিধি চালু করল, তখন পূর্ব বাংলার পাটের ব্যবসা এক মহাসংকটে নিপতিত হলো। সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় নতুন নতুন পাটকল স্থাপনের কাজ শুরু করল। দেশ বিভক্তির আগে সমগ্র বাংলা অঞ্চলে সর্বমোট ১০৮টি পাটকল ছিল, যার সবকটিই ভারতের পশ্চিম বাংলায় অবস্থিত ছিল। বিপুল পরিমাণে উন্নত জাতের পাট উৎপাদিত হলেও, পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কারণে পূর্ব বাংলা কোনো পাটকলই পেল না। 

পূর্ব বাংলার পাট উৎপাদনের ওপর ভরসা করে পাকিস্তান এবং পশ্চিম বাংলার পাটের ব্যবসার ওপর নির্ভর করে ভারত- উভয় দেশ অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী ভারত পাট উৎপাদনে এবং পাকিস্তান পাটকল স্থাপনে মনোযোগী হয়ে উঠল। 

১৯৫১ সালের দিকে পূর্ব বাংলায় সর্বপ্রথম বাওয়ানী জুট মিল্স, আদমজী জুট মিল্স এবং ভিক্টরি জুট প্রডাক্টস লিমিটেড নামে পাটকলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পাটকলগুলো স্থাপনে পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা (Pakistan Industrial Development Corporation- PIDC) নামে একটি সরকারি সংস্থা অর্থায়ন করে। ১৯৬০ সাল অবধি বাংলাদেশে প্রায় ১৪টি মিল গড়ে ওঠে, যার ১২টিই উক্ত প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে হয়। এসব মিলের অধিকাংশেই মালিকই ছিলেন অবাঙালি; কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিক-কর্মচারী ছিল বাঙালি। বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব বাংলায় অবাঙালি মালিক নিয়ন্ত্রিত পাটকলে বাঙালি শ্রমিকদের আচার-আচরণ নিয়ে সরকার উদ্বেগ ও আশঙ্কা অনুভব করতো। তাই তারা এ সংকট নিরসনে বাঙালি ধনী ব্যবসায়ীদের কারখানা স্থাপনে প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে। এরই কৌশল হিসেবে পাকিস্তানের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী জনাব আবুল কাশেম খান ‘পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা’ ভেঙ্গে দু’ভাগ করার পরিকল্পনা করেন। একটিকে ‘পশ্চিম পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা’ নাম দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ও আরেকটিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা’ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করেন। যা পরবর্তীতে পূর্ব-বাংলায় অনেক বড় বড় পাট কারখানা স্থাপনে এক বিরাট প্রণোদনা হিসাবে কাজ করে। 

‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা’ পূর্ব-বাংলায় পাটকল স্থাপনে প্রয়োজনীয় তাঁতকলের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে পাট কারখানা স্থাপনকারী উদ্যোক্তাদের আরও প্রণোদনা দিল। তাতে বাংলাদেশে পাটকলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো। ১৯৭০ সাল অবদি পূর্ব পাকিস্তানে পাট কারখানার সংখ্যা দাঁড়াল ৭৭টি, যাতে প্রায় ১৭০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হলো। পাকিস্তান পাট রপ্তানি করে ১৯৭০ সালে ৭৭ মিলিয়ন রুপি আয় করে এবং বিশ্বে পাট রপ্তানিতে শীর্ষস্থান অধিকার করে। বিদেশি মুদ্রা অর্জনে পাকিস্তানের জিডিপিতে পাটের অংশ যেখানে শতকরা ছিলো ২ শতাংশ, তা ১৯৭০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ শতাংশে। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে পাট কারখানার পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকরা বাংলাদেশে স্থাপিত পাটকলগুলো পরিত্যক্ত করে এদেশ ছেড়ে চলে যায়। (চলবে)

লেখক: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //