ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের প্রাণের ইতিহাস। এ ইতিহাস যেমন ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে- তেমনিভাবে গ্রামাঞ্চলেও এর একটি বিরাট ঢল নেমেছিল। গ্রামে গ্রামে গিয়ে যদি আজকের দিনে যারা বয়স্ক রয়েছেন- তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তবে তারা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। যেমনটি আমাদের মফস্বল শহর নেত্রকোনায়ও ঘটেছিল।
তখন ১৯৪৮ সালে আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাই স্কুলে পড়ি। সম্ভবত মার্চের দিকে একদিন আমাদের ক্লাসে নাইন-টেনের ছাত্ররা এসে জানায়, ‘আমাদের মাতৃভাষা বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের কথিত জাতির পিতা জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে বলেছেন- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে চলেছে, সেখানে আমাদের সকলেই না না জানিয়ে দিয়েছেন। আমরা কিছুতেই সেটা মেনে নেবো না। আমাদের যে মাতৃভাষা বাংলা, সেই মাতৃভাষাই রাষ্ট্রভাষা হতে হবে। পুলিশ অত্যাচার করেছে ছাত্রদের ওপর, আমরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় বের হবো।’
আমরা তখন ছাত্ররা মিলে বেরিয়ে গেলাম স্কুল থেকে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্য মানি মানি না,’ ‘পুলিশের জুলুম বন্ধ করো’- এরকম আরো স্লোগান দিতে দিতে আমরা সারা শহর সেদিন প্রদক্ষিণ করি। পরের দিন ভোরে নেত্রকোনা শহরের মুক্তাঙ্গণের মাঠে একটি সভায় মিলিত হই। সে সভায় তীব্র নিন্দা জানায় বক্তারা। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে তা আমরা কখনো ভাবিনি। ফলে আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। মানুষকে সচেতন করতে শুরু করি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠকও করি।
পরে আমি গ্রামের স্কুলে চলে যাই। ১৯৫২ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ি। হঠাৎ খবর পেলাম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাওয়ার জন্য- ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। কিছু ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সেই সময়ে রেডিও ছিল না, টেলিভিশনও ছিল না গ্রামে। এজন্যই খবরটার বিস্তারিত পৌঁছেনি তখন। কেবলমাত্র তমদ্দুন মজলিশের ‘সৈনিক’ পত্রিকা ছিল। ফলে এ পত্রিকার মাধ্যমেই খবর পেতাম। এরপর ৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খবর পাই এ হত্যাকাণ্ডের, তারপর বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। পাশের বাজার ছিল বসুর বাজার, সেদিন হাটবারও ছিল। আমরা হাটে পৌঁছে হাটুরেদের বলি- ‘আমাদের ভাষার ওপর পাকিস্তান সরকার উর্দুকে চাপিয়ে দিচ্ছে। এ প্রতিবাদে আমাদের ছাত্র ভাইদের ওপর ওরা বর্বরভাবে গুলি চালিয়েছে, হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে। আমরা এর প্রতিবাদ করব, মানব না আমরা ভাষার বঞ্চনা।’ আমাদের বক্তব্যের আবেগে হাটের অনেক মানুষ কেঁদেছিল সেদিন।
তারপর আমরা বললাম, আজকে এর প্রতিবাদে গ্রামের এই বাজারে হরতাল পালন করবো। হরতাল শব্দটির সঙ্গে তারা আগেই পরিচিত ছিল। ফলে তারাও একবাক্যে মেনে নিয়ে সব দোকান-পাট বন্ধ করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। এভাবেই গ্রামের সাধারণ মানুষ ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়েছিল। এরপর আরো কয়েকদিন আমরা হরতাল পালন করি।
ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত সাংস্কৃতিকভাবে একটি বড় আন্দোলন। কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য তার ভাষার ওপরে আঘাত করলেই তার পুরোটা শেষ হয়ে যায়। একটা জাতির ভাষার ওপরে যখন চাপিয়ে দেয়া হয় অনৈতিক বোঝা, তখন সে মরে যায়। মরে যায় তার কৃষ্টি। আর বাংলা ভাষা এমন এক ভাষা যে ভাষায় গান করেছেন- লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল। এ এক শক্তিশালী ভাষা সারা পৃথিবীর মধ্যে। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি সরকার এ ভাষাকেই আঘাত হেনে দ্বিখণ্ডিত করতে চেয়েছিল আমাদের। আমরা সেই দ্বিখণ্ডিত হতে দিইনি ভাষাকে, আমাদের সংস্কৃতিকে; কিন্তু আজও তারা যেন সক্রিয় হয়ে রয়েছে। তারা আজও বাংলা বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এক শ্রেণির অসচেতন মানুষেরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পাঠিয়ে তৃপ্তি পায়। তারা ভাবে না যে ভাষার জন্য সারা বাংলা একদা কেঁপেছিল- প্রাণ দিয়েছিল আমাদের ভাইয়েরা, গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মতো খেটে মানুষেরাও পিছিয়ে ছিল না, তারাও এ আন্দোলনে সাহায্য করেছিল। তারা একাত্ম হয়েছিল আমাদের মিছিলে।
তাদের বিবেকের কাছে আমার প্রশ্ন ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষায় কতটুকু উন্নত হবে, যদি না সে নিজের ভাষাটা ঠিক মতো জানে? তার সংস্কৃতির কৃর্তিমানদের জীবন না জানে সে কী করবে এই শিক্ষা দিয়ে? আমি মোটেই অন্য ভাষার বিরুদ্ধে না। তবে নিজের ভাষাকে তো সম্মান করতে হবে, জানতে হবে সংস্কৃতির পুরোটাই।
এ কারণে ইংরেজি ভাষা আগে নয়, আগে আমার মায়ের ভাষা শিখতে হবে। রেডিও টেলিভিশনে আজকের দিনে যেমন করে বাংলাকে ইংরেজির সাথে গুলিয়ে বলা হয় তা সত্যিকার অর্থে দুঃখজনক। প্রতিটি মিডিয়ার দিকে খেয়াল করলে এগুলি চোখে পড়ে। এখন লোকমুখে শুনতে পারি- বাংলা চর্চার জায়গা ধীরে ধীরে কমছে। আর যা চর্চা হচ্ছে, সে অবস্থাও যে সঠিক তা নয়। ফলে আমার মতে, সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন জরুরি হয়ে পড়েছে। কেবল আইন করে নয়- তা বাস্তবে প্রয়োগের মাধ্যমেই চর্চায় অগ্রসর হতে হবে; না হলে বাংলা ভাষা তার সে পূর্বের মতো বিদেশি ভাষার কবলে পড়বে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে আজকের যে প্রাপ্তি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ, আলাদা মানচিত্র, আলাদা সংবিধান- এর প্রথম প্রেরণা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। আর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রথম আমরা বুঝতে পারি, বাঙালি দৃঢ়তায় পৌঁছাতে পারে। আর ৫২-র একুশ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা এগিয়েছিলাম বলেই পেয়েছি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে। এ ভাষার কবি, গায়ক, বাউল আর ভিন্ন ভাষার কবলে পড়বে না। আর কোনো বিদেশি শক্তি পাড়বে না খণ্ডিত করতে আমার প্রিয় বাংলাভাষার সুমিষ্ট বুলি। তাই সর্বত্র বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। শিশুদের জন্য মায়ের ভাষাই যেন হয় প্রথম ভাষা সে চেষ্টাই করা বাঙালি হিসেবে প্রথম দায়িত্ব। কেননা, গর্ব ভরে তাই বাংলা ভাষার সন্তান বলে আমি মাথা উঁচু করে বিশ্বের মাঝে দাঁড়িয়ে আজ।
বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানার প্রতিবাদে একুশে ফেব্রুয়ারি যে দিন শোক প্রকাশ করি আমরা শহীদ দিবস রূপে। এই দিনটিই সারা বিশ্বের মানুষও পালন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ আমাদের আরো বড় প্রেরণা হয়ে থাকুক- সবার অন্তরে।
লেখক: প্রগতিশীল চিন্তক ও লেখক
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh