ভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই থামেনি

একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে যখন বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বাস থাকে তখন ভাষা নিয়ে তাদের আবেগের, লড়াইয়ের বা সংগ্রামের জায়গাটা ঠিক কোন পর্যায়ে থাকে, এটি বাংলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস না পড়লে বোঝা যাবে না। 

বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির লড়াই ছিল এক দশক বা তারও বেশি সময়কালজুড়ে। কোনো একটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে শাসনে-শোষণে ও বশে রাখতে হলে প্রথমেই হরণ করতে হয় তার ভাষা-সংস্কৃতির স্বাধীনতা, আর চাপিয়ে দিতে হয় শাসক গোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি। বাংলা ভাষার ওপর এই আধিপত্যবাদ এসেছে বারবার।

১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন’-এর উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা।’ অথচ সেই অনস্বীকার্য বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ইতিপূর্বেই অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নামে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করেছিল। ফলে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তানের।

পূর্ববাংলার জনগণ ‘পাকিস্তান’ নামের নতুন রাষ্ট্র লাভের মধ্য দিয়ে তাদের আশা-আকাক্ষা পূরণের স্বপ্ন দেখছিল; কিন্তু একদিকে শ্রেণিবৈষম্যের তীব্রতা, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দ্বারা জাতিগত শোষণ ও ভাষাগত নিপীড়নের ফলে অচিরেই সে স্বপ্ন ভেঙে যায়। সেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাই প্রতিফলিত হতে থকে পরবর্তীকালের বিভিন্ন বিক্ষোভ ও গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এরই তীব্রতম প্রকাশ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। রাজনৈতিক তাৎপর্য ছাড়াও বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়কে ঘিরে যে অস্পষ্টতা ও অসচ্ছতার কুয়াশা তাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, এই আন্দোলনই প্রকৃতপক্ষে সেই কুয়াশাকে দু’হাতে সরিয়ে বাঙালি সত্তার উন্মেষ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার বহু রক্তাক্ত স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, এই নিরন্তর আন্দোলনের পরিণতিতেই ‘বাংলাদেশ’ নাম-পরিচয়ে মাতৃভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের জন্ম সম্ভব হয়েছে।

ভাষা শুধু মনের ভাব প্রকাশের বা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম বা প্রশাসন পরিচালনার অন্যতম হাতিয়ার নয়। ভাষা একটি সত্তার প্রতীক। একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে অবলম্বন করে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বিশ্বের কাছে তাদের জাতীয় অস্তিত্ব তুলে ধরে। তবে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, সেটি আসলে একটি বড় ভূখণ্ডের মানুষ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। বিশ্বের কোথাও লিখিত ভাষা আর মুখের ভাষা এক নয়। সম্প্রতি শিশুদের জন্য বিশেষায়িত একটি টিভি চ্যানেলের এক অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, তারা ঘোষণা করছেন ‘যাদের প্রমিত বাংলায় কথা বলতে অসুবিধা হয় না, তারা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।’ অর্থাৎ এ দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীরও বেশিরভাগ মানুষ সম্ভবত প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে, ভাষাজ্ঞান আর সাক্ষরতাজ্ঞান সব সময় এক সঙ্গে থাকে না।

এখন বাঙালির এক বিরাট সংকট মূলত ভাষার আগ্রাসন নিয়ে। বিশ্বায়নের যুগে কর্মক্ষেত্রে ভিন্ন ভাষার প্রায়োগিক প্রয়োজনীয়তা মুখ্য হয়ে উঠেছে। আমরা যেখানে উচ্চশিক্ষা ও আদালতের ভাষা হিসেবেও এখন পর্যন্ত বাংলা চালু করতে পারিনি, সেখানে বিশ্বায়নের কারণে আরো একটি ভাষা শেখা প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়ন মানে, যেখানে রাষ্ট্রগুলোর সীমারেখা আর খুব বড় কথা নয়। বৈশ্বিক অর্থনীতি অর্থনৈতিক উদারীকরণের নামে ও এর সাথে সঙ্গে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর আগ্রাসন মিলে এই ‘বিশ্বায়ন’ এখন রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। 

ফলে প্রাথমিক থেকে সর্বস্তরের শিক্ষায় একটি ‘বিশ্বভাষা’ হিসেবে ইংরেজির ভূমিকা ক্রমশ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে, যার ফলে অনেকের ভেতরে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে- যে ভাষা বেশি শক্তিশালী সেটিকে আমরা বেশি প্রাধান্য দেবো। নিজের ভাষা কম শক্তিশালী, তাই একে ততটা গুরুত্ব না দিলেও চলবে। বিশ্বায়ন এসে এই ব্যবস্থাকে আরো পাকাপোক্ত করে দিচ্ছে। মধ্যবিত্ত অভিভাবক তাদের সাধ্যের বাইরে গিয়েও বাচ্চাকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছেন। ঢাকাকেন্দ্রিক জনসংখ্যার চাপেরও এটি একটি কারণ। ঢাকার বাইরে কর্মক্ষেত্র; কিন্তু বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন ঢাকায়। 

এখন আমাদের উদ্বেগের কারণ এখানে যে, আমাদের ভাষাটা তাহলে বিপন্ন হয়ে উঠছে না তো! আমার ভাষায় অসাধারণ সাহিত্য আছে, গান আছে, চলচ্চিত্র আছে, আছে নাটক। এখন অন্য একটি ভাষার আগ্রাসন আমার ভাষাটিকে গৌণ করে দেবে না তো? এ বিষয়ে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ডেথ’ নামে একটি বই লিখেছেন ডেভিড ক্রিস্টাল। তিনি এই প্রশ্নটা সেখানে তুলেছেন। আবার তিনি ‘দ্য গ্লোবালাইজেশন অব ইংলিশ’ বলে একটি বইও লিখেছেন। তিনি একটি মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে বলেন, নিজের ভাষাকে আমার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আমি আরো শক্তিশালী করব। আবার একটি বৃহৎ যোগাযোগের ভাষাকেও আমি গ্রহণ করব। তবে সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, ভাষার যে শক্তির সিঁড়ি, সেই সিঁড়ির কোন ধাপে আমার ভাষার জায়গা হবে? কতটা তাকে ঠেলে শক্ত ধাপের ওপর তুলতে পারব, সে দায়িত্ব আমাদেরই।

আমরা এখন যে সময়ে বাস করছি, সেখানে বিজ্ঞান চর্চার বিষয়টি খুব বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে যেভাবে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। এখনো এ ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন আমাদের প্রভাবিত করছে। বিজ্ঞানের চর্চা কীভাবে হলে মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হবে, সেটি নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভাষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আর ভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বেশি কার্যকর এবং তা সহজে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, যে মাতৃভাষা ভালো বলতে ও লিখতে পারে না, তার অন্য ভাষায় দক্ষতা যেভাবে গড়ে ওঠার কথা, সেভাবে গড়ে ওঠে না। 

এখন প্রশ্ন হলো- বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করা সম্ভব কি-না, আর এর ফলাফল ইতিবাচক হবে কি-না। বাংলা ভাষার প্রতি আবেগের জায়গা থেকে শুধু নয়, যৌক্তিকতার দিক থেকেও বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। বিষয়টি অদ্ভুত মনে হতে পারে; কিন্তু গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত বলছে- মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চার সাথে একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো- মাতৃভাষার মাধ্যমে যখন কোনো একটি দেশ বিজ্ঞান চর্চা করে, তখন সে দেশের মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটে বেশি। এই উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে সে দেশ প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা অর্জনে সমর্থ হয়। ফলে প্রযুক্তির হাত ধরে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠে, যা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। 

চীনের ক্ষেত্রে শুধু চীনা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করার ফলে তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ভারতের চেয়ে বেশি। জাপান, জার্মানি বা হাঙ্গেরির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের দেশের সব মানুষের কথা বলা ও লেখার মাধ্যম হলো বাংলা। ফলে আমরাও জাপান, চীনের মতো মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হতে পারি।

আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ- অর্থনীতি যত অগ্রসর হবে, ভাষার পরিবর্তনশীলতা তত বেশি গতিশীল হবে। এর ফলে ভাষার শব্দের ভাণ্ডার যেমন বাড়বে, তেমনি ভাষার গুণগত মান সমৃদ্ধ হবে। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের ভাষাকে একটি শক্ত অবস্থানে ধরে রাখার জন্য বিদ্বৎ সমাজের চ্যালেঞ্জ এ ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ বেড়ে গেছে। রক্তে অর্জিত ভাষাকে সিঁড়ির উঁচু ধাপে রাখা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে। তাই বলা যায়- বাঙালিকে নিজেদের ভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের নতুন পর্ব শুরু করতে হবে এখনই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //