মধুপুর শালবনকে রক্ষা করতে হবে

টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন পৃথিবীর এক প্রাচীন পত্রঝরা অরণ্য। ‘গড়’ হিসেবে পরিচিত এই বনের আদি বাসিন্দা মান্দি (গারো) ও কোচ-বর্মণ জাতি। মান্দি ভাষায় এই বন ‘বলসাল ব্রিং’ এবং মধুপুর গড় ‘হা. বিমা’ নামে পরিচিত। হা. বিমা মানে মায়ের মাটি। 

মান্দি-পুরাণ মতে, চিগেলবাড়িওয়ারী খুট্টি নামের এক জঙ্গল দ্বীপে মান্দিদের জন্ম। তারপর হা. বিমা, হা. ফাল আর হা. রঙ্গা অঞ্চলে গড়ে ওঠে মান্দি সভ্যতা। হাবাহুআ (জুম আবাদ) করেই মধুপুরে মান্দিরা গড়ে তুলেছিলেন তাদের প্রাচীন বসত। 

হা. গেত্তাল (নতুন জুমের জমি) এর অভাব ছিল না তখন। প্রতিবার জুম আবাদের পর এক থেকে তিন বছর জুম জমিকে বিশ্রাম দেয়া হতো। বিশ্রামরত এমন জমিকে বলে ‘হাজিরি হাব্রেং’। সঙনকমা (গ্রামপ্রধান) গ্রামের সবাইকে নিয়ে বছরভিত্তিক আবাদের জমি ঠিক করতেন। লম্বা ওয়াহ (বাঁশ) দিয়ে এক নল, দুই নল, দশ নল এভাবে হত জমির মাপ। পাখি-বিঘা-শতাংশ-কানি-হেক্টর-একরের মাপ ছিল না তখন। 

ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে মধুপুর শালবন নাটোর রাজার অধীনে আসে। রাজা শ্রী যোগীন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের সঙ্গে ১৮৬০ থেকেই মান্দি গ্রামপ্রধানদের জমিবিষয়ক চুক্তি হয় এবং বনের অধিবাসীরা রাজার ‘রায়ত’ হিসেবে চার্জশিটের রাজাকে খাজনা প্রদান শুরু করে। বছরে একবার চানপুর চণ্ডীমণ্ডপ, চাড়ালজানি, রসুলপুরের কাচারীতে একটাকা পাঁচসিকা খাজনা দিতে হতো। ফসল ঘরে তোলার পর গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হতো ‘ওয়ান্না’ বা নবান্ন উৎসব। ফসল রোপণের আগে গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হতো ‘গালমাকদুআ’ পরব। যেখানে সঙনকমা পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুয়ায়ী বীজবণ্টন বিনিময় করতেন। 

১৯৫০ সনে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে হা.বিমার এক বিশাল অংশ হয়ে যায় ‘রাষ্ট্রীয় বনভূমি’। কয়েকশ’ বছর ধরে বসবাসরত মান্দি-কোচরা হারায় ভূমির প্রথাগত মালিকানা। মাতৃসূত্রীয় মান্দিসমাজে জমির মালিকানা ও বংশপরিচয় মাতৃসূত্রে বাহিত হয়। পারিবারিক জমির মালিকানা সাধারণত পায় পরিবারের ছোট মেয়ে (নকনা)। এ ছাড়াও আছে মাহারীভিত্তিক (গোত্র) সামাজিক জমি (আখিং)। 

১৯৫৫ সনে মধুপুরে জুম চাষ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫৬ সনে ফরেস্টার আফাজউদ্দিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দোখলা রেঞ্জের চুনিয়ায় প্রাকৃতিক বন কেটে গাছের চারা রোপণ করে বনবিভাগ। প্রাচীন এক বনের নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘উডলট বাগান’। মধুপুর গড়ে চালা ও বাইদ দু’ধরনের জমি আছে। বাইদ জমিতে আগে কোনো আবাদ ছিল না। চালা/কান্দা জমিতেই মূলত জঙ্গল, জুম জমি এবং মান্দি-কোচদের বসতি স্থাপন করা হয়। চালাজমিতে জুম আবাদ নিষিদ্ধ হলে বাধ্য হয়ে মান্দিরাও নামা বা বাইদ জমিতে বাঙালিদের মতো লাঙলভিত্তিক কৃষিকাজ শুরু করেন। বসতবাড়ির চারিধারে অল্পবিস্তর চালাজমিনে শুরু হয় আনারস-পেঁপে-থাবুলচু-আদা-হলুদ-মান্দি কচু-কাঁঠালের মিশ্রবাগান। 

আজ মধুপুর আনারস ও কলার জন্য বিখ্যাত। মধুপুর উপজেলাতে তৈরি হয়েছে ‘আনারস চত্বর’। চালাজমিতে চাষের অধিকার হারিয়ে মধুপুরে এই আনারস চাষের সূচনা করেছিলেন ইদিলপুরের মিজি মৃ। ১৯২৭ সনের উপনিবেশিক বনআইনের ৬ ধারার মাধ্যমে তৎকালীন ‘পূর্ববঙ্গীয় বনবিভাগ’ ১৯৫৫ সনে একটি ‘ফরেস্ট গেজেট’ প্রকাশ করে। 

১৯৬২ সালে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের আমলে মান্দিদের উচ্ছেদের জন্য ‘জাতীয় উদ্যান’ নাম দিয়ে ২০,৮২৭.৩৭ একর শালবনে তারের বেড়া দেয়া হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য বনবিভাগ দখলকৃত ‘সংরক্ষিত বন এলাকায়’ করা হয় বম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮২ সনে ‘আটিয়া অধ্যাদেশের’ মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলার ৫৫,৪৭৬.৩৮ একর ভূমি ‘আটিয়া সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষিত হয়। এর ভেতরেই মান্তি গ্রাম উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক শালবনে তৈরি হয় বিমানবাহিনীর ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জ। 

১৯৮৪ সনে মধুপুর বনে বসবাসরত মান্দি-কোচদের বনবিভাগ আবার উচ্ছেদ নোটিস দেয়। ১৯৮৯-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের টাকায় টিএনডিপির সাড়ে সাত হাজার একর উডলট ও এগ্রোফরেস্ট্রি বাগান করার ফলে অনেক মান্দিরা আপন জায়গা-জমিন হারায়।

২০০০ সন থেকেই শালবনের ৩০০০ একর কোর এলাকাকে ৬১,০০০ রানিং ফুট দেয়াল দিয়ে ঘিরে বিতর্কিত ‘ইকোট্যুরিজম প্রকল্প’ শুরু হয়। ২০০৪ সনের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্কবিরোধী মিছিলে বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পীরেন স্রাল। ২০১৬ সনে আবারো অরণখোলা মৌজার ৯১৪৫.০৭ একর ভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর শুধু এই মৌজাতেই আছে কয়েকশত বছরের প্রাচীন ১৩টি মান্দি গ্রাম। 

গণমাধ্যম সূত্রে আবারো জানা যাচ্ছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেশের সংরক্ষিত বনভূমি দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছেন এবং ২০২১ সনের ৩০ জানুয়ারির ভেতর সবাইকে উচ্ছেদ নোটিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অরণ্য, নদী আর প্রকৃতি ছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জীবনের কোনো মানে নেই। বিশ্বব্যাপি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা বনভূমির ঐতিহ্যগত সংরক্ষক। অবশ্যই দেশের সব প্রাকৃতিক বনভূমি বেদখলমুক্ত হোক; কিন্তু ‘সংরক্ষিত বনভূমি’ বা কোনো উন্নয়নপ্রকল্প বা বনভূমি দখলমুক্ত করার নামে বনাঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে বসবাসরত আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা অন্যায়। এমনকি এভাবে জোর করে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষাও সম্ভব নয়। কারণ মধুপুর শালবন হলো এখানকার আদি বাসিন্দা মান্দিদের কাছে হা. বিমা ও বলসালব্রিং। এই বনভূমি মান্দি-কোচদের আত্মপরিচয়ের অংশ। এখানে ঘুমিয়ে আছে পরিবারের কত আপনজন। এখানে চালা কী বাইদ জমিনে ছড়িয়ে আছে কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি। 

আবারো তাই জাগছে মধুপুর। মান্দি-কোচদের পাশাপাশি এবার যুক্ত হয়েছে বাঙালিরাও। কারণ এখন মধুপুর শালবনে বাইরে থেকে আসা নয়া বসতিস্থাপনকারী বাঙালিরাই সংখ্যায় বেশি। এদের বড় অংশই কোনো বৃহৎ উন্নয়নপ্রকল্প বা নদীভাঙ্গনে নিজেদের বসত হারিয়ে এই মধুপুরের নানা গ্রামে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬২ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের’ সমন্বয়ে আবারও ‘সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারের’ বনবিভাগের সাম্প্রতিক এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে আন্দোলন। 

২০২১ সনের ২৫ জানুয়ারি বন বিভাগের সিদ্ধান্তকে প্রতিবাদ জানিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান চেয়ে ‘মধুপুর গড়ের সংক্ষুব্ধ জনগণ’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছেন। স্মারকলিপিতে তারা বনবিভাগ, রাজস্ব ও স্থানীয় আদিবাসীদের মাধ্যমে মধুপুরের জমির ত্রিদলীয় জরিপের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া মধুপুরে ইকোপার্ক, জাতীয় উদ্যান বাতিল করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলোচনা, ১৯৮২ সনের আটিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল, মিথ্যা বন মামলা বাতিল ও সামাজিক বনায়ন বাতিল করে তাদের তত্ত্বাবধানে প্রাকৃতিক বন রক্ষায় গ্রামবন পদ্ধতি চালুর দাবি জানানো হয়েছে। 

বন বিভাগকে মধুপুর শালবনের ঐতিহাসিকতা বোঝা দরকার। এখানকার বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশের সঙ্গে স্থানীয় মান্দি ও কোচ জনগণের ঐতিহাসিক শ্রেণিসম্পর্ক বোঝা দরকার। ইচ্ছে করে বা মনে হইলেই প্রাকৃতিক শালবন কেটে কখনো রাবার বাগান, আগ্রাসী গাছের বাগান, চিড়িয়াখানা কী ইকোপার্ক এসব করা যায় না। অবশ্যই বনভূমি জবরদখলমুক্ত করতে হবে; কিন্তু বনের সাথে জড়িত মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস, আখ্যান ও সম্পর্ককে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ এই মানুষেরাই এত বছর ধরে বনভূমি সুরক্ষা করে আসছেন।

হা. বিমা কোনো বাণিজ্যিক জমি নয়, তাই হা. বিমার কোনো দলিল-দস্তাবেজ হয় না। মানুষের বয়ান, স্মৃতি আর প্রাকৃতিক বিকাশের ভেতরেই এই বনভূমির সঙ্গে মানুষের প্রথাগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মালিকানার সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। বনবিভাগ কী চাইলেই এই সম্পর্ক চুরমার করে দিতে পারে? না পারে না। কারণ রাষ্ট্রের সংবিধান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের বহুঘোষণা এই সম্পর্ককে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বনসম্পর্ককে বিবেচনা করতে গিয়ে বনভূমির সত্যিকার দখলদার প্রভাবশালী করপোরেট কোম্পানিরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায় সে দিকেই সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে বনবিভাগকে।  

সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর ৫৬৫৯ জন আদিবাসী এবং ৩০০৩ জন বাঙালির বসতভিটা ও কৃষিজমি পড়েছে। প্রাকৃতিক বনভূমি ‘উদ্ধার ও সুরক্ষার’ ক্ষেত্রে বনবিভাগকে অবশ্যই মধুপুরের মান্দি-কোচ ও নতুন বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের ইতিহাস, জীবন-জীবিকা, বনের সাথে প্রথাগত সম্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে। আমরা কোনোভাবেই চাই না করোনা মহামারিকালে আবার মধুপুরের মাটি লাল হয়ে উঠুক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //