মিয়ানমারে কোনো সামরিক ক্যু হয়নি

ফ্যাক্টস হলো, ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে কোনো সামরিক ক্যু হয়নি। যদিও দেশি-বিদেশি মিডিয়া বিশেষত বিদেশি মিডিয়ায় একে সামরিক ক্ষমতা দখল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- ওই দিনের রয়টার্স লিখেছে- এক ‘ডেমোক্রেটিক্যালি ইলেক্টেড গভর্মেন্ট’-এর বিরুদ্ধে নাকি ক্যু হয়েছে! আসলে পশ্চিমের প্রায় সবারই এই ‘ডেমোক্রেটিক্যালি ইলেক্টেড’ কথাগুলোর মধ্যেই সব রহস্য লুকিয়ে আছে। কেন? 

মূল কথাটি হলো, কোথাও ‘নির্বাচন হলেই সেই দেশে একটি রাষ্ট্র’ কায়েম আছে ধরে নিতে হবে, এই অনুমান আসলে ভিত্তিহীন। সুষ্ঠু নির্বাচন, কথিত ‘ডেমোক্রেটিক্যালি’ তা ঘটা অথবা একটি ‘ইলেক্টেড গভর্মেন্ট’ থাকা মানেই সেই দেশে ‘একটি রাষ্ট্র কায়েম আছে’ তার প্রমাণ নয় কখনোই। আর ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি বললেই মূলত বুঝতে হবে একটি ‘রিপাবলিক রাষ্ট্রের’ কথা বলা হচ্ছে। এই লেখায় সবখানে তাই রাষ্ট্র শব্দটি বুঝতে হবে ‘রিপাবলিক রাষ্ট্র’ হিসেবে।

অতএব, সার কথাটি হলো, কোথাও ‘ডেমোক্রেটিক্যালি ইলেক্টেড’ হলেই সেখানে রিপাবলিক রাষ্ট্র আছে, তা প্রমাণ করে না। অর্থাৎ কোথাও রিপাবলিক রাষ্ট্র আছে মানে, সেখানে ডেমোক্রেটিক্যালি ইলেক্টেড গভর্নমেন্ট আছে। তাই বলে উল্টাটা বা বিপরীতটি স্বতসিদ্ধ নয়। আর যেটি রিপাবলিক রাষ্ট্রই নয়, সেখানে নতুন করে ‘সামরিক ক্ষমতা দখল’ হয়েছে- এই তর্ক তোলা অর্থহীন; কিন্তু তাই-ই বা কেন?

রিপাবলিক রাষ্ট্র আসলে কী?

রিপাবলিক রাষ্ট্র মানে হলো, ওই রাষ্ট্রে শাসকদেরকে ক্ষমতা কে দিয়েছে, কোথা থেকে পেয়েছে- এর সদুত্তর সে দিতে পারে কি না। যে এ ক্ষমতা দিতে পারে তার ক্ষমতার উৎস জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা- একমাত্র তবেই সেটি এক রিপাবলিক রাষ্ট্র বলে গণ্য হতে পারে। 

যারা এই মৌলিক ধারণাটি জানে না, মানতে চায় না অথবা যারা ফাঁকি রাখতে চায় অথবা যারা পশ্চিমের দাস হতে চায়- জেনে বা না জেনে তারা সে কারণে একটি বিশেষ শব্দ ব্যবহার করে। আর সেই শব্দটি হলো- ‘গণতন্ত্র’ বা ‘ডেমোক্রাটিক্যালি’। এদের মধ্যে জ্ঞানত ও অজ্ঞানত এমন দু ধরনের লোকই আছে, যারা এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। মূলত এরা রাষ্ট্র বোঝে না অথবা না বোঝার সুবিধা নিতে চায়। যেমন- পশ্চিম আপনার থেকে কোনো সুবিধা নিতে চায়। যদি এমন হয় তবে তারা বলবে বা আপনাকে সার্টিফিকেট দেবে যে আপনারা ‘ডেমোক্রেটিক্যালি ইলেক্টেড গভর্মেন্ট’। অর্থাৎ নির্বাচনই সব, নির্বাচন মানে গণতন্ত্র, রাষ্ট্র কিছু না। আর ওই কথিত গণতন্ত্র মানে সেখানে যেন একটি রিপাবলিক রাষ্ট্র হয়ে আছে। এমনটি ভিত্তিহীনভাবে ধরে নিয়ে তারা কথা বলবে। অথচ এটা শতভাগ মিথ্যা ধারণা এবং মিথ্যা বুঝ। 

যে দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়, এমনকি তা সুষ্ঠুভাবে হলেও সে দেশে কোনো রিপাবলিক রাষ্ট্র নেই তা কি হতে পারে? যে রাষ্ট্রে শাসকের ক্ষমতার উৎস কী- এর হদিস নেই, সেখানে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হলে বা না হলে কী এসে যায়? এরই সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হলো-  মিয়ানমার। 

যেমন ধরেন আজকাল পাড়ার ক্লাবে বা স্কুলের গভর্নিং বডিরও রীতিমত পোস্টার লাগিয়ে নির্বাচন হয়। তো এগুলো কী একেকটি রাষ্ট্র? বা রিপাবলিক?

শাসক বা শাসন থাকা মানে রাষ্ট্র থাকা নয়

শাসক বা শাসন থাকলেই কী সেটি রাষ্ট্র? অবশ্যই না; তবু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোথাও শাসকের শাসন থাকলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে নিশ্চয় তখনো ‘রাষ্ট্র’ ছিল। আসলে এরা রাষ্ট্র ধারণার সঙ্গে শাসক বা শাসন ধারণা গুলিয়ে ফেলে। দেশে কোনো না কোনো ধরনের শাসন ক্ষমতার অধীনে শাসিত থাকা মানেই, সেটি রাষ্ট্রের শাসন আছে মনে করা- ভিত্তিহীন।

কোনো না কোনো শাসন তো দুনিয়াতে বহুশত যুগ থেকে আছে; কিন্তু তা থেকেই রাষ্ট্র মানে রিপাবলিক আছে, তা একেবারেই সত্যি না। যেমন শাসন বলতে তা রাজার শাসনও হতে পারে। কোনো ধর্মীয় কাঠামোর শাসনের অংশ হতে পারে। তাই সেটি শাসন বটে; কিন্তু তা রাষ্ট্র নয়। বহু বাদশার আমলে ভালো শাসন ছিল হয়তো, গল্প শুনেছেন; কিন্তু এর মানে সেখানে রাষ্ট্র বা রিপাবলিক ছিল ধরে নেওয়া যাবে না। কেন?

তাহলে রাষ্ট্রে কী থাকতে হয়?

যে কোনো শাসনে শাসকের ক্ষমতার উৎস কী এর গ্রহণযোগ্য জবাব থাকতে হবে। বাস্তবের দুনিয়াতে কোনো রাজা/সম্রাট/বাদশার কাছে এর জবাব থাকে না; তারা দিতে পারবে না, মানে এই জবাবটিই তাদের কাছে থাকে না, সম্ভবত আর সব কিছু থাকে। কে তাকে ক্ষমতা দিয়েছে, কার থেকে এনেছেন বলতে পারবে না তারা। অর্থাৎ রাষ্ট্র হতে গেলে ক্ষমতার উৎসের হদিস দিতে পারতে হবে। তবে দেখা যায় অনেক রাজাই এই প্রশ্নের জবাব দিতে হিমশিম খায়। এ কারণে পাশে এক ধর্মীয় নেতা বসিয়ে তাকে দিয়ে দাবি করিয়েছে যে, রাজার ক্ষমতাটি ঐশ্বরিক; কিন্তু তাতে সেটি জবাব হয়নি, তা আমরা সবাই জানি। কারণ সবশেষে একমাত্র সদর্থক জবাব হতে পারে- ক্ষমতা তাকে জনগণ দিয়েছে, জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিনিধি তিনি; এ জন্য তিনি শাসক। একমাত্র এই জবাব থাকলে মানা যাবে যে সেটি রাষ্ট্র হয়েছে। তিনি জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার নির্বাচিত প্রতিনিধি হলেই, তবে তিনি শাসক; অন্যথায় নয়। এই হলো রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। 

রাজতন্ত্রী ধারণার বিপরীত এটি। আর রিপাবলিক ধারণা ছাড়া রাষ্ট্র ধারণা নেই। কাজেই এ কথাগুলো আবার যেখানে লিখে রাখা থাকে সেটিই অনুমোদিত সংবিধান। সেখানে আরও অনেক বিষয় বিশেষত মৌলিক অধিকারভিত্তিক নাগরিকত্ব, নাগরিকরা সবাই বৈষম্যহীন ও সমান ইত্যাদি অনেক কিছু স্পষ্ট করা থাকে। আর ওই সংবিধান অনুসারেই কেবল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। এ জন্য রিপ্রেজেন্টেশন বা জনপ্রতিনিধি ধারণাটিও তখনই আসে। রাজা-বাদশার আমলে তাই জনপ্রতিনিধি বলে কোনো ধারণা নেই। এমনকি রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল বলেও কিছু নেই সেখানে।

রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র ধারণার বিপরীতে যা কিছু আছে, তা এককথায় মর্নাকি বা রাজতন্ত্র। রাজার সন্তানরা উত্তরাধিকার সূত্রে নতুন রাজা হবে। তাই রাজতান্ত্রিক ক্ষমতাও তার ক্ষমতার উৎস দেখাতে পারে না। না হলে কী হয়? না হলে তা রাজতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি অনেক কিছুই হতে পারে, এরই আরেক নাম আমাদের মিয়ানমার!  

এর মানে মিয়ানমার কখনই কোনো রাষ্ট্র ছিল না। কারণ তার ক্ষমতার উৎসের ঠিক নেই। মিয়ানমারে প্রথম সংবিধান ১৯৪৭ সালে প্রবর্তন হয় । যেটির প্রথম অনুচ্ছেদে লেখা ছিল “বার্মা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রিপাবলিক যা ‘ইউনিয়ন অব বার্মা’ বলে পরিচিত হবে”। অর্থাৎ নামের মধ্যে রিপাবলিক শব্দটি রাখা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেবল বর্ণনা অর্থে শব্দটি রাখা হয়েছে। অর্থাৎ মূল কনসেপ্টে গন্ডগোল আছে। এ ছাড়া আমরা দেখব এটি একটি জাতি কি না, ইউনাইটেড কি না ইত্যাদি শব্দের ওপর শুধু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। 

এরপরে ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমার পুরাপুরি এক সামরিক সরকারের অধীনে চলে যায় যেটিকে জেনারেল নে উইন এর নেতৃত্বে কথিত ‘সমাজতান্ত্রিক সরকার’ বলে দাবি করা হতো। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র মিয়ানমারের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই তার নতুন সরকার সংবিধানের সব কিছু স্থগিত করে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছিল। 

তাই নে উইনের বেলাতেও সংবিধানের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে দেখা যায়নি। সে কারণে পরে ১৯৭৪ সালে তিনি আরেকটি সংবিধান রচনা করেছিলেন। যদিও এ কালে সেটির কথা বেশি শোনা যায় না। তবে মিয়ানমারে সর্বশেষ সংবিধান বলতে যা বোঝায় সেটি হলো- ২০০৮ সালের । যদিও ১৯৮১ সালে নে উইন ক্ষমতা হারান গণবিক্ষোভে। মিয়ানমারে এমন গণবিক্ষোভের অনেক ইতিহাস আছে; কিন্তু সবক্ষেত্রেই এর পরিণতি একই। তা হলো নতুন নামে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করেছে। জেনারেলরা নিজেদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি কমিটির নামে ক্ষমতা নিয়ে থাকে, কেবল জেনারেলরা যার সদস্য হয়ে থাকেন। আশির দশক থেকে পরের মোটামুটি তিন দশক পর্যন্ত এমন কমিটি কয়েকবার করা হয়েছে। এদের নামের মধ্যে পিস, সলিডারিটি উন্নয়ন জাতীয় শব্দ প্রায় কমন থাকতে দেখা যায়। এই গোষ্ঠীই ২০০৮ সালে নতুন সংবিধান রচনা করেছিল, সেটিই এখনো চলমান সংবিধান।

২০০৮ সালের সংবিধানও একইভাবে রাষ্ট্রের নাম বলা হয়েছে, ‘ইউনিয়ন অব মায়ানমার’। তবে এবার ইউনিয়ন কথাটি কম বলে এর চেয়ে ‘নেশন’ শব্দটা বারবার এসেছে। এটি এত ব্যবহার হয়েছে, যে এক জায়গায় ‘উই দ্য নেশন পিপল’ ধরনের অদ্ভুত অর্থের শব্দও আছে। 

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সংবিধানের শুরুতে দ্বিতীয় প্যারায় ‘বেসিক প্রিন্সিপাল’ বলে একটি অনুচ্ছেদ আছে, যেখানে এর উদ্দেশ্য হিসেবে সাতটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। আর এর সর্বশেষ সপ্তম উদ্দেশ্যই হলো হাজার কথার এক কথা।

সপ্তম উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, ‘দেশের ডিফেন্স সার্ভিসকে রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণে সক্ষম করা।’ অথচ এটি একটি চরমতম স্ববিরোধী বাক্য। ‘ডিফেন্স সার্ভিসের সদস্যরা’ দেশের ‘রাজনৈতিক নেতা’ হবে কীভাবে?

আগেই বলেছি, নিজেকে রিপাবলিক রাষ্ট্র দাবি করার মানে এর শুরু হবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি থেকে যারা রাজনৈতিক নেতা। তিনি হবেন প্রধান নির্বাহী- যাকে দেশে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বলে। এরপর তাদের অধীনে ক্যাবিনেট মন্ত্রী নিয়োগ দেবেন তারা। আর এরপরই কেবল তাদের পূর্ণ তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে, যার একটি হলো ডিফেন্স সার্ভিস বা প্রতিরক্ষা বা মিলিটারি আমলার প্রতিষ্ঠান। তাহলে ‘ডিফেন্স সার্ভিসের সদস্যদের’ দেশের ‘রাজনৈতিক নেতা’ হবার সুযোগ কই? সংবিধানের এই বেসিক প্রিন্সিপাল অনুচ্ছেদ মতে দেখা যাচ্ছে, ডিফেন্স সার্ভিস তো ‘জনগণের সম্মিলিত ক্ষমতারও ওপরে’ কর্তৃত্বধারী ক্ষমতার অধিকারি!

অর্থাৎ এটি একটি এবসার্ড, অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনোই মানে হয় না এমন কথার। ঠিক যেমন ‘জনগণের সম্মিলিত ক্ষমতারও উপরে’ কোনো এক রাজা বসে থাকে, স্বৈরশাসক বসে থাকে এটি তাই। অতএব, মিয়ানমার কোনো রিপাবলিক রাষ্ট্রই নয়। জনগণের সবার উপরে এর সর্বময় ক্ষমতা কথিত এক ডিফেন্স সার্ভিস এবং এর চিফের হাতে ন্যস্ত। তাই এর আবার নতুন করে ক্যু বা ক্ষমতা দখল কথার তাৎপর্য কী? সব সময়ই যারা দখলদার হয়ে বসে আছে! তাই শুরুর বাক্যে বলেছি, মিয়ানমারে কোনো ক্যু হয়নি।

তাহলে ২০০৮ সালে এই সংবিধান লেখার তাৎপর্য কী?

মিয়ানমার এমন একটি দেশ যার শাসক আছে; কিন্তু তা রাষ্ট্র নয়, মানে জনগণের রাষ্ট্র নয়। অনবরত যে বার্মিজ বা বুদ্ধিস্ট বাদে অন্যান্য সব জাতিগোষ্ঠীর ওপর হত্যা নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো তো বটেই জাতিসংঘেরও অবরোধ ছিল সেই আশির দশক থেকে। অর্থাৎ মিয়ানমার ছিল একঘরে। 

মিয়ানমারে অস্ত্রবিক্রিতেও নিষেধ ছিল; কিন্তু চীনের সাথে সীমান্ত আছে বলে অনেকটা চোরাচালানের ছলে বা বেনামে ব্যাপক পণ্যবিনিময় চলত। এটি তার একমাত্র সীমান্তের বাইরে যাবার উপায় ছিল। চীনের সাথে এই সম্পর্ক আবার চীনের ডাবল ডিজিট উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গেও বেড়ে উঠেছিল। সে সময়টি ছিল গ্লোবাল অর্থনীতিতে ২০০৮ সালের মন্দা আসার আগের বছর পর্যন্ত। তাই অর্থনীতি ভালো চলাতে কোনো দেশের মাটির নিচের গ্যাস তেল কে আগে কিনে নিতে বুকিং দিয়ে রাখতে পারে এই প্রতিযোগিতা ছিল। 

সেই সূত্রে মিয়ানমারে একটি খনির গ্যাস ভারত বুকিং দিতে কথা শুরু করেছিল; কিন্তু শর্ত ছিল বাংলাদেশকে হুইলচার্জ দিয়ে এর ওপর দিয়ে পাইপলাইনে গ্যাস নেয়া হবে। কিন্তু বাংলাদেশ এই অনুমতি দিতে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় প্রতিযোগিতায় চীন ওই গ্যাস কিনে ফেলার ডিল করে ফেলে। মূলত এরপর থেকে ভারত নতুন এক আইডিয়া নিয়ে একদিকে মিয়ানমার, অন্যদিকে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে কথা বলে। ভারতের মূল পয়েন্ট ছিল অবরোধের সুফল সবাই না পেয়ে একচেটিয়াভাবে শুধু চীন পাচ্ছে। 

সুচি তখনো গৃহবন্দি ছিলেন। তাই নামকাওয়াস্তে মিয়ানমারে একটি রাজনৈতিক সংস্কার হয়েছিল সে সময়। যার মূল ক্ষমতা আগের মতোই সেনাবাহিনীর হাতে রেখে তাদের অধীনে কেবল সু চিকে কিছু ক্ষমতা দিয়ে তারা ‘গণতন্ত্র কায়েম’ করেছে বলে প্রচার চালায়। কারণ যদি পশ্চিমারা সার্টিফিকেট দেয় তবে সব অবরোধই তুলে নেওয়া যেতে পারে। এবার আর একা চীন না, ভারত ও পশ্চিমারাও বিনিয়োগ করে পণ্য-পুঁজি রপ্তানির ব্যাপক সুযোগ নিতে পারে। এই রফাতে জেনারেলদের কথিত লোক দেখানো সংস্কার (যেটি রাষ্ট্র সংস্কার নয় মোটেও) করে নির্বাচন দিতে ২০১০ সাল লেগেছিল। আর তখনই কি কি ক্ষমতা জেনারেলরা সুচিকে দিতে চায় এরই হিসেবে সংবিধান সংস্কার করা হয়েছিল। ফলে এই সংস্কার যে আজকের দশায় পড়বে তা জানলেও সবাই এক জুতাতে নেমেছিল- যদি লাইগ্যা যায়। 

মিয়ানমারে মোবাইল ব্যবহারকারি ছিল মাত্র কয়েক শতাংশ, সেটি এখন ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এভাবে যে যা পেরেছে খাবলে নিয়েছে এতদিন। ওদিকে ২০১০ সালের নির্বাচন এই সংবিধান ২০০৮ এর অধীনেই হয়েছিল। সুচি তখন মুক্ত; কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আর আর্মি একাই অংশ নিয়েছে বেনামে, নিজেরাই একটি দল (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলভমেন্ট পার্টি) গঠন করেছিল। এভাবেই ক্ষমতায় ছিল। আর পরের ২০১৫ সালের নির্বাচনে সুচির দল এনএলডি অংশ নিয়ে প্রধান নির্বাচিত দল হয়; তবুও সেনা বাহিনী সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়নি। কারণ সংবিধানে লেখা আছে সংসদের নিম্ন কক্ষে চার ভাগের এক ভাগ আসন সেনা বাহিনীকে দিতে হবে। যেটি সেনাবাহিনীর প্রধান ঠিক করে দেবেন কোন অফিসার সংসদ সদস্য হবে। আবার সংসদের উচ্চকক্ষের তিনভাগের একভাগ আসন একইভাবে সেনা বাহিনী পাবে। এতেও শেষ হয়নি। স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, সীমান্তরক্ষীসহ পাঁচ মন্ত্রিত্ব বাহিনীকে দিতে হবে আর বাহিনী প্রধান এই নিয়োগ দেবে।

অর্থাৎ ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ এরাই আসলে মিয়ানমারের (সরি, রাষ্ট্র বলতে পারছি না) মূল মালিক। না হলে ডিফেন্স চিফ কি করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ দেবেন!

এর মানে হলো ২০১৫ সালের নির্বাচন ছিল নিজের নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ সিভিলিয়ানদেরকে কতদুর ক্ষমতার ভাগ দিতে পারে, এরই পরীক্ষা। দুঃখজনক হলো ফলাফল সুখের হয়নি। কারণ এবার ২০২০ সালের নভেম্বর নির্বাচনে সুচির দল আরো বেশি আসন দখল করেছিল, প্রায় ৮৩ শতাংশ ভোট। এতে স্বভাবতই সুচি আরও বেশি ক্ষমতার হকদার হয়ে উঠত। তাই এবারের নতুন সংসদ বসার আগেই সিভিল রাজনীতিকদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। সুচি গ্রেফতার তো হলেন, দেশের প্রেসিডেন্টও ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি হলেন। আর্মি চিফ আরেক সাবেক আর্মি সদস্যকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিয়েছেন।

তা হলে সারকথাটি কী এখন? তা হলো জেনারেলরা ২০০৭ সালে ফিরে গেছেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে জেনারেলদের ভুয়া সংস্কারের পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে, তা আর কাজ করল না। 

ব্যবসা-বাণিজ্যের লোভে পশ্চিমাদের মিয়ানমারকে রাষ্ট্র হতে না দেওয়ার জুয়াচুরি এতে উন্মোচিত হলো। আবার অবরোধের হুমকি দিয়ে এটি কতদূর যেতে পারবে?

-লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //