আরো একটি আন্দোলন দরকার বাংলা ভাষার জন্য

এখন ভাষার মাস। এ মাসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বলতে হলে কিশোর বয়সের কথা মনে পড়ে। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে। একদিন হঠাৎ শুনলাম রাষ্ট্রভাষা ইস্যুতে গুলি চলেছে ঢাকায়, একজন ছাত্র মারা গেছে। 

এ খবর শুনে নারায়ণগঞ্জে তখনকার যারা ছাত্রনেতা ছিলেন, কিংবা কলেজে যারা ছিল শিক্ষার্থী, তারা সবাই একরকম উত্তেজিত হয়ে সেদিনই সন্ধ্যায় মিছিল বের করে। আমিও সে মিছিলে ছিলাম। ছাত্রদের ওপর গুলি ও হত্যার প্রতিবাদে চারদিক তোলপাড় তখন। প্রশাসনও বেশ তৎপরতা দেখাচ্ছে।

আমি ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতাম। ফলে ছবি আঁকা ছিল আমার একটি আনন্দের ও পরম যত্নের কাজ। শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনকে ঘিরে পোস্টার, ব্যানারে অনেক কিছু লিখে টাঙিয়ে দিচ্ছিল। অমি তখন বললাম- পোস্টারে হবে না শুধু, লিখেও হবে না। আমি তখন ছবি আঁকতে শুরু করলাম। রাতের পর রাত জেগে প্রচুর বড় কাগজে কার্টুনের মতো করে ছবি আঁকছি, ছবির ভেতরে অল্প ক্যাপশন দিচ্ছি। যেমন একজন মায়ের গলায় অনেক হাত এসে চেপে ধরেছে- নিচে ক্যাপশনে লিখে দিয়েছি। এ রকম বহু কার্টুন তখন আমি এঁকেছিলাম। নারায়ণগঞ্জে আমার আঁকা ছবিগুলো হাতে নিয়ে মিছিল হয়েছিল। বন্ধুরা সেসব দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছিল।

এখানে তখন একটি গার্লস স্কুল ছিল, ওই স্কুলের হেড মাস্টারকে কী কারণে যেন ধরল পুলিশ। সে ঘটনায় আমরা প্রতিবাদ করলাম, গাড়ি আটকালাম ইত্যাদি। তার পর তো পরিস্থিতি ভয়াবহ হলো- মিলিটারি এলো হঠাৎ করে; অ্যাটাক করল ওরা। রাস্তায় রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ওদের আটকানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। ওই সময়ে চাষাড়ায় আমরা ছিলাম, চাষাড়ার মোড়ে একটি বাড়ি ছিল, নাম ভুলে গেছি। বাড়িটির পাশেই ছিল চাষাড়া পুলিশ ফাঁড়ি। ওই পথেই ছিল রেললাইন। ওই জায়গা থেকে ছাত্ররা ইট-পাথর গাড়িতে ছুড়ে মারছে, এমন অবস্থা চলছে চারদিকে। আমি যেখানে ছবি আঁকি ওই স্থানে একটা শেল্টার ছিল, ওইখানে আমরা বন্ধুরা দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিই। এরপরও ওরা আমাদের ধরে ফেলল, অ্যারেস্ট করল। পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গেল। তারপর রাতে একজন আর্মি অফিসার এসে উর্দুতে বলল, ‘এদের আগে খুব পেটাও, তারপর গাড়িতে ওঠাও।’ ওরা আর্মি অফিসারের কথা মতো মারতে শুরু করল। আমরা তখন ২০-২৫ জন একটি রুমে গাদাগাদি করে ছিলাম। তখন একটি বিষয় ভালো লেগেছিল-  ছাত্রনেতা বড় যারা ছিল, তারা আমাদের ছোটদের গায়ে আঘাত না লাগে এ রকমভাবে একটি প্রটেকশন তৈরি করেছিল। ব্যাপারটি খুব ভালো লেগেছিল- কারণ আমাদের জন্য দরদ ছিল নেতাদের মনে। আমাদের সকালবেলায় ঘুম থেকে তুলেছে পিঠে ঘুষি মেরে মেরে, বলেছে- এই ওঠ, গাড়িতে ওঠ এরকম। আমরা দু-তিনজন শুধু স্কুলের, আর বাকি সবাই ছিল আমাদের সিনিয়র। আমার একটি ধারণা ছিল, রাজবন্দিদের এভাবে অত্যাচার করে না। আমাদের যখন গাড়িতে তুলছিল, আমি তখন বলেছিলাম- ‘মারছেন কেন? মারছেন কেন? মারার তো কথা ছিল না!’ অবাক ব্যাপার আমার এই কথাটি নারায়ণগঞ্জে খুব ছড়িয়ে পড়ে। কিশোর বয়সের ব্যাপার ছিল- ‘ভেবেছি, অদ্ভুত কথা তো- মারবার তো কথা ছিল না। অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে জেলে, তো মারবে কেন। আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি।’ 

এর আগে একটি ঘটনা আমার জীবনে হয়েছিল, আমি তখন ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভের ছাত্র, আব্বা নিয়ে গেলেন রেসকোর্সে (আব্বা আমাকে নিয়ে যেতেন অনেক জায়গায়)। আব্বা ইনভাইটেড ছিলেন ওখানে, মঞ্চের সামনেই চেয়ারে উনি বসলেন, আমিও উনার পাশে বসেছি। জিন্নাহ সাহেব এসেছেন, এসে বললেন যে- ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান।’ এই কথা বলার পরে দেখলাম যে, চারদিক থেকে নো, নো চিৎকার করে বলছে অনেকে। আমরা তো হতবাক হয়ে গেলাম যে, জিন্নাহ সাহেবের এক কথায় নো, নো চিৎকার করবে। এটি দেখেই আমি খুব সচেতন হয়ে গেলাম, কেন এমন হলো? 

আমার আগে থেকেই সাহিত্যের প্রতি দরদ ছিল, অনেক বইপত্র পড়েছি তখন- বাংলার প্রতি এক ধরনের দরদ তো ছিল-ই। এ ছাড়া নাচ, ছবি আঁকা, গান, কবিতা, গল্প এগুলোর মধ্যেই তো আমার বেড়ে ওঠা। এই কারণেই সেই সময়ে আমার খুব খারাপ লেগেছিল, কেন উর্দু আমাদের ভাষা হবে? এটি অবশ্য ১৯৫২ সালের আগের একটি ঘটনা। 

’৫২তে আমি অনেক ছবি এঁকেছি, নানারকম ছবি দেয়ালে লাগানো ছিল, অনেক লোক সেগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। সিরিজের মতো করে, ছোট ছোট কথায় তা চিত্রিত হতো- যেন মানুষ বুঝতে পারে। যেমন- ‘বাংলা কথা বলো না/ বাংলা অপবিত্র,’ ‘মোদের গরব মোদের আশা/ আ‘মরি বাংলা ভাষা,’ ‘উর্দু পবিত্র/ হাজার বছরের বলা বাংলা ছেড়ে দাও।’ কার্টুনের মধ্য দিয়ে এসব কথা ফুটিয়ে তুলতাম আমি।

তারপর আমাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে অ্যারেস্ট করে ঢাকায় দিয়ে আসে। কারাগারে যে পুরনো কয়েদি ছিল, তারা আমাদের খুব যত্ন করত। না বুঝেই হয়তো করত- আপনারা ভাষার জন্য এখানে এসেছেন, খুব খাতির করত এই ভেবে। সাধারণ মানুষের এই যে, ভাষার প্রতি দরদ- বাংলা ভাষা যে আমাদের মাতৃভাষা, ভাষার যে কোনো ধর্ম নেই এই জিনিসটি ওদের মনেও ছিল। সাধারণ মানুষের মনেও ভাষার জন্য ভালোবাসা তৈরি করেছি আমরা- জেলের মধ্যে থাকা কয়েদিরা এটিও বুঝেছে। বিষয়টি বুঝতে পারি তখন- বাংলাদেশের মানুষ আজ এক হয়েছে। তারপর হঠাৎ ৫-৬ দিন পর আমাদের মধ্যে যারা ছিল ছাত্রলীগের, তাদের ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করত। ওরা আমাকেও বলল- তোমাকেও ডাকতে পারে, জানতে চাইতে পারে- তুমি ছবিগুলো এঁকেছো কিনা, তুমি বলে দিও- আমি জানি না। এ সময় প্রায় একমাস জেলে ছিলাম, তারপর ছাড়া পেলাম। এরপর আমি ভাবলাম, এভাবে ছবি না এঁকে ১০টি করে চিত্রে সিরিজ গল্পের মতো আঁকবো। প্রথমে করলাম একটি বাঁশের আত্মকথা। সেখানে ছিল একটি বাঁশঝাড়। সেখান থেকে কলম বানানো হলো, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে হাতে খড়ি হলো, বাঁশঝাড়ের সুন্দর প্রকৃতিতে বাউল গান করছে। তারপর সেই বাঁশঝড় বয়ে যাচ্ছে, আবার সেই বাঁশ দিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। বাঁশের যে চটা, তা দিয়ে পোস্টার হলো- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। এটি প্রত্যেকের হাতে। তারপর বাঁশের বেড়া ভাঙছে, গুলি করেছে, পড়ে আছে লাশ। এরপর তাদের কবর দিচ্ছে, কবরের ওপর বাঁশ দেওয়া। কবরে যে ঘাসটাস আছে তাতে অক্ষর লেখা। অক্ষরগুলো ঘাসের মতো, ফুলের মতো। এটি হলো একটি বাঁশের আত্মকথা। তারপর করেছিলাম- বিক্ষুব্ধ বর্ণমালা, অ-তে অজগর। এটি বায়ান্নর অনেক পরে করি অবশ্য, তখন আমি আর্ট কলেজে পড়ি, ’৬০-এর দিকে হবে। ছাত্রদের নানাভাবে আমি এনকারেজ করেছি তখন। 

বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে আমি বলি- প্রথমত, বাংলাটা একুশের জন্য তোলা থাকে, একুশে এলে বাংলা ভাষার কথা একটু একটু বলি; কিন্তু যখন ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, তখন কিছুই কী ছিল? তবুও আন্দোলন হয়েছিল, তখন কে প্রতিবাদ করেছিল, সেটি কিসের অনুপ্রেরণায়? এটিই মূল কথা- তখন আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল আমাদের সাহিত্য, আমাদের অসাধারণ সাহিত্যিক আবদুল হাকিম, কায়কোবাদ, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র; এদিকে গানবাজনাও যদি বলি- লালন ফকির, হাসন রাজা। এই যে বিরাট বিরাট মনীষি, যারা আমাদের জাগ্রত করে রেখেছিল, তারা আমাদের গর্ব। আমার ভাষা বাংলা- এ মনীষিরা আমার ভাষার গর্ব। 

এখন হয়ে গেছে কি, বাংলা ভাষা কোথায়, বাংলা ভাষার জন্য সেই দরদটা দেখি কোথায়? বোধ হয় দরদ নেই, যেখানে যা দেখি সবটাই বিদেশি ভাষায় হচ্ছে। টিভিতে ইংরেজি-বাংলা, উর্দু-বাংলা, পার্সিয়ান সিনেমা, অনুষ্ঠান কাটছাঁট করে প্রচার করছে। বাংলা সিনেমার নামটাও দেখি যে ইংরেজি মেশানো থাকে এবং বাজারে গেলে বেশিরভাগ হলো ইংরেজি। নারায়ণগঞ্জে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল দু’তিন বছর আগে, ওদের শহীদ মিনার যেখানে রয়েছে ওখানে। পুরনো কথা, নারায়ণগঞ্জে কি হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে, এ বিষয়ে বলার জন্য। তখন কথা বলার সময় দেখলাম- শহীদ মিনারের পাশেই চার-পাঁচটি ইংরেজি সাইনবোর্ড ঝুলছে। আমি তখন গুনে দেখলাম ১০টি থেকে ১৫টি ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ড। তখন বলেছিলাম- বাংলা শিখতে হবে অবশ্যই, শিখতে হবে যার যার ভাষা। প্রয়োজনের ভাষাও আমাদের ভাষা এবং আন্তর্জাতিক ভাষাও শেখা দরকার। তবে জাপানে গিয়ে দেখেছি- এত উন্নয়ন চারদিকে, অথচ সেখানে কেউ ইংরেজি জানে না। এর কারণ- যেকোনো বই দরকার হোক না কেন, তারা সেটি জাপানি ভাষায় রূপান্তর করে নেয়। তারা যে ইংরেজি জানে না, তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনোরকম আক্ষেপ নেই। তাদের বেশিরভাগই আমাদের থেকে অনেক কম জানে ইংরেজি। সেখানে তাদের বই, তাদের ট্রেডিশন সবকিছুই তাদের নিজের ভাষায়। অথচ আমাদের গর্ববোধ করা উচিত আজকের দিনে বাংলার জন্য। এ ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতি কত উঁচু; কিন্তু তা না করে কেবল ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’ বলে আমরা এই একুশে ফেব্রুয়ারিকে উৎসবে পরিণত করেছি।

একজন বলছিলেন যে, আর একটা আন্দোলন দরকার বাংলাভাষার জন্য। আমি বললাম- বাংলা ভাষার আন্দোলন হবে এরকম- বাংলা ভাষার ব্যবহার চারদিকে করতে হবে সমানভাবে। সরকারের হোক, যে কোনো লোকের হোক- বাংলার ব্যবহার করতে হবে সঠিকভাবে। তবেই হবে বাংলার সঠিক ভাষা আন্দোলনের মূল্যায়ন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //