করোনাকালে দুনিয়াদারি

আগামী বহুকাল পর্যন্ত বোধকরি ২০২০ সাল ‘করোনাকাল’ হিসেবে দুনিয়ার ইতিহাসে চিহ্নিত হবে। বেশ কয়েক শতক হলো, দুনিয়ায় প্রাকৃতিক ঘটনার চেয়ে মানুষের কাজকর্মই বড় হয়ে উঠেছে। 

অন্তত গত চারশ’ বছর ধরে মানুষের প্রকৃতিকে জয় করার ইতিহাসে ব্যাপারটাকে এভাবেই দেখে থাকে। না দেখে উপায়ও নেই। মানুষ প্রকৃতির অংশ হলেও প্রকৃতিকে রূপান্তরের প্রেরণা ও ক্ষমতাই প্রজাতি হিসেবে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশিষ্টতা। সভ্যতার ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের প্রায় সমার্থক এক ধারণা। সেই ধারণার গোড়ায় আছে প্রকৃতিকে যথাসম্ভব কব্জা করে জীবনযাপনের অনুকূলে বদলে ফেলার সামর্থ্য। এ বস্তুকেই আমরা ‘সংস্কৃতি’ নামে চিনে থাকি। 

প্রকৃতির বিপরীতে সংস্কৃতিকে স্থাপন করার বিপদ সম্পর্কে আজকাল যত সতর্কতাই দেখানো হোক না কেন, মানুষের সভ্যতার ইতিহাসকে এর বাইরে গিয়ে দেখার ও দেখানোর সুযোগ সামান্যই আছে। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান অংশ বস্তুত প্রকৃতিকে কব্জা করার কলা; বাকি অংশ মানবসমাজের ব্যবস্থাপনা। এই দ্বিতীয় অংশের গোড়ায় আছে মানব-প্রকৃতিকে ‘স্বাভাবিক’ ধারায় বইতে না দিয়ে আর দশের জন্য জুতসই পন্থায় বশে রাখার প্রবণতা। আর প্রথম অংশের ঘোষিত-অঘোষিত লক্ষ্য বাহ্য-প্রকৃতির ব্যবহার ও ভোগ।

‘প্রকৃতির ওপর আধিপত্য-বিস্তার’ কথাটি আজকাল বেশ সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে; কিন্তু সত্য এই, মানুষের অস্তিত্বমাত্রই প্রকৃতি-বিরোধী। আদি মানুষের ইতিহাস যতটা জানা যায়, তাতে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের চেষ্টার হদিস মেলে; কিন্তু সে চেষ্টায় তাকে কয়েকটি কাজ করতেই হয়েছে, যেগুলো সহাবস্থানের চেয়ে বেশি কিছু। তাকে আগুন জ্বালাতে হয়েছে, ঘর তৈরি করতে হয়েছে, পোশাক পরতে হয়েছে, আর শস্য ফলাতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মানুষের আগে পর্যন্ত প্রকৃতির সাথে প্রকৃতি-ব্যবহারকারীর যে সম্পর্ক ছিল, তাতে বৈপ্লবিক বদল ঘটে গেল। 

খুব সরল করে বলা যায়, মানুষের পরের ইতিহাসটি মূলত প্রকৃতিকে বদলে ফেলার সামর্থ্যরে ইতিহাস। কখনো ধীর বা কখনো দ্রুতগতিতে এটি ঘটেছে। ষোল-সতের শতককে ইউরোপীয় দখলদাররা যে ‘আধুনিক যুগ’ (জামানা) হিসেবে চাপিয়ে দিতে পারল দুনিয়ার এতগুলো মানুষের ওপর, তার পেছনে প্রকৃতি-জয় ছিল একমাত্র সূত্র; জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, আলো, যুক্তি এগুলো আলঙ্কারিক সুভাষণ মাত্র ছিল। আমার বলার কথাটি হলো, অধিবিদ্যক আদর্শবাদকে অতিরিক্ত মূল্য না দিয়ে, যদি যাপিত জীবনের ইতিহাস থেকে মানুষের বা মানবসভ্যতার সংজ্ঞায়ন করি, তাহলে প্রকৃতির বিপরীতে মানুষকে স্থাপন না করে আদতে কোনো উপায় নেই। 

কিন্তু অতীতের মানবসভ্যতাকে এভাবে দেখা হয়েছে বলে ভবিষ্যতেও দেখতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সভ্যতার যে বিন্দুগুলোকে আমরা উৎকর্ষের নমুনা হিসেবে হাজির করে থাকি, তার প্রতিটিতেই প্রকৃতির ব্যাপারে বিশেষ ধরনের মনোযোগ দেখতে পাই। প্রাচীন ভারতে এ মনোযোগ সাহিত্যে-দর্শনে-ধর্মতত্ত্বে একটা চূড়ান্ত মর্যাদায় পৌঁছেছিল। কালিদাসের কাব্যের তপোবনকে, অর্থাৎ প্রকৃতি-মানুষের সখ্যকে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের নাগরিক ঐশ্বর্যের বিপরীতে অন্যতর সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। নগরায়ণ, অর্থাৎ প্রকৃতির বিনাশ এবং জীবনে-যাপনে প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাওয়ার বিপরীতে তীব্রতম প্রতিবাদ দেখতে পাই ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের কালে, রোমান্টিক কবিদের আহাজারিতে। আমাদের রবীন্দ্রনাথ মিলিয়েছেন কালিদাস ও ইংরেজ রোমান্টিকদের, তবে গিয়েছেন আরও বহুদূর। বলতে চাইছি, প্রকৃতি থেকে তফাতে চলে যাওয়ার-যে বিপদ আছে, তা যে মানব-প্রকৃতির এক রকমের বিরুদ্ধাচরণ, মানুষের ইতিহাসে সে কথাটি প্রকৃতি-জয়ের সমানতালে ঘোষিত হয়ে আসছে; কিন্তু গত কয়েক দশকের বাস্তবতাটি পুরোপুরি আলাদা। 

ইদানীং মানুষ প্রকৃতিকে দেখতে বাধ্য হচ্ছে, একেবারেই অস্তিত্ব-সংকটের জায়গা থেকে। প্রকৃতির ওপর আধিপত্য করতে গিয়ে সে যে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, প্রকৃতিকে বদলে নিয়ে ব্যবহার ও ভোগ করতে গিয়ে সে-যে দুনিয়ার আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে, আর এভাবে প্রজাতি হিসেবে মানুষের বিলুপ্তির আশঙ্কা তৈরি করছে- সে বোধটি গত কয়েক দশক ধরে চিন্তায় ও চেতনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। প্রকৃতি নিয়ে ভাবনার এই ধরনটি অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত বলে আগের যে কোনো প্রকৃতি-ভাবনার তুলনায় এটি একেবারেই অন্যরকম। বৈশ্বিক উষ্ণতা-বৃদ্ধি, পানির উচ্চতা বেড়ে স্থলভাগ গ্রাস করা, অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি, ওজনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি বিচিত্র নামে আমরা এ বাস্তবতাকে বুঝতে পারছি। করোনা-পরিস্থিতি মানুষের এই বুঝটাকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল। আগে যা দূরবর্তী খবর আকারে ছিল, তা এসে ভর করল নিজের শরীরে; আগে যা কারো কারো ভাবনা-দুর্ভাবনায় ছিল, তা এক লহমায় হয়ে উঠল সবার। এভাবে, বলা যায়, ২০২০ সালে করোনা মানুষের কাজকর্মের তুলনায় প্রাকৃতিক ঘটনাকে কয়েক শতাব্দী পরে প্রথমবারের মতো বড় করে তুলতে পারল।

দুই

করোনার শুরুর দিনগুলোতে ভয় আর হতাশার যে জমাট অন্ধকার দুনিয়ার মানুষকে গ্রাস করেছিল, তার কোনো জুড়ি কি ইতিহাসে মেলে? বোধ হয় না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে এ রকম দুনিয়াজোড়া ঘটনাই সম্ভবত মানুষের অভিজ্ঞতার মধ্যে আর আসেনি; কিন্তু ১৯৪০-৫০ সাল নাগাদও দুনিয়া আজকের অর্থে বিশ্বায়িত ছিল না। তাছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে দুনিয়ার একটা বড় অংশে যুদ্ধ খবর আকারে ছিল, ঠিক মৃত্যু বা ধ্বংস হিসেবে নয়। তিন দশক হলো, দুনিয়া একাকার হয়ে গেছে বলে আমরা প্রচারণায় শুনছি, অভিজ্ঞতায় দেখছি। আর্থিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে ওই একাকার হয়ে যাওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কেও দুনিয়ার অনেক এলাকা যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। 

তবে করোনাই প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষত জানিয়ে গেল, বিশ্বায়িত দুনিয়ায় বিপদ-আপদের ধরনও গেছে বদলে- এখন বিপদের বেশেও তা গোটা দুনিয়াকে একাকার করে দিতে পারে। এ দিক থেকে করোনার অভিজ্ঞতা প্রজাতি হিসেবে মানুষের জন্য একেবারেই নতুন। নতুনত্ব মানুষের ভড়কে যাওয়ার গোড়ার কারণ। কোনো আঞ্চলিক সমস্যাকে সে অঞ্চলের মানুষ দেখবে ভেতর থেকে, জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বাইরের মানুষ দেখতে পারবে দূর থেকে। অর্থাৎ, সমস্যাটাকে তার খানিকটা অবজেক্টিভ দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ থাকবে। উপদ্রুত অঞ্চলের মানুষরা মুক্তাঞ্চলের ওপর ভরসা করবে। বহুদিন ধরে দুনিয়ার গরিব অঞ্চলগুলোর মানুষ ধনী ও উন্নত অঞ্চলে নিজেদের নিরাময় দেখে আসছে। এই প্রথম অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো। দেখা গেল, উন্নত অঞ্চলগুলো অনেক বেশি দৌড়ের ওপর আছে; তারা অনেক বেশি দিশাহারা। ফলে কর্তৃত্ব ফলানোর জন্য বা সহানুভূতি বিলানোর জন্য দুনিয়ার তৃতীয় অংশে নাক গলানোর কোনো মওকা তারা নিতে পারছে না। এ অবস্থাটি মানুষের অচেনা। কাজেই প্রজাতি হিসেবে মানুষের চূড়ান্ত অস্তিত্ব-সংকট বোধ করার প্রথম কোনো সুযোগ তৈরি করল করোনা মহামারি।

সংকটের প্রথম ধাপ অবশ্য মৃত্যুভয়। অন্যের মৃত্যুতে মানুষ নিজের মৃত্যুর একটা আন্দাজ পায়। তাই মৃত্যুভয় যতই প্রবল হোক, তাকে ঠিক অচেনা বলা যাবে না। মৃত্যুরও নানান প্রতিষ্ঠিত হিসাব-নিকাশ আছে। ওটা নিয়েই মানুষ বাঁচে। মৃত্যুর সঙ্গে প্রয়োজনীয় লড়াই করে। কোন ধরনের মৃত্যুর জন্য কার কতটা শোক বরাদ্দ হবে, তার একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যাকরণও থাকে। করোনা এসে মানুষের মৃত্যু-বিষয়ক তাবত হিসাব-নিকাশ দিয়েছে পাল্টে। আসলে শুরুর দিনগুলোতে সামষ্টিকভাবে মানুষের কোনো বিকল্প হিসেবেও গড়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। ফলে এ মৃত্যুভয়কে আগের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝা যাবে না। কথাটি আরেকটু খুলে বলা যাক।

মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের জিত হয়েছে বড়জোর দুইশ’ বছর হলো। জিত হয়েছে মানে- মানুষ ‘অকাল’-মৃত্যু বেশ কতকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। মৃত্যুর ব্যাপারে ব্যক্তিগত না হোক, অন্তত সামষ্টিক নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এর আগে, জন্ম-মৃত্যুর ঘোর অনিশ্চয়তার জমানায়, মৃত্যুজনিত শোক নিশ্চয়ই আজকের তুলনায় আলাদা ছিল। আফ্রিকার কিছু এলাকা বাদ দিলে দুনিয়ার বাকি অংশের মানুষের সাধারণ-সামষ্টিক মৃত্যুজনিত অভিজ্ঞতায় এ রকম একটা সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর ব্যত্যয় যথেষ্ট ছিল। তবে সেটাকে বিচ্যুতি হিসেবে দেখার চোখ আর মনও তৈরি হয়েছিল। মানুষ এমনকি বহুদিন ধরে অন্য প্রজাতির মৃত্যু, বিলুপ্তি ইত্যাদি নিয়েও মনোযোগ দেবার অবসর পাচ্ছে। ডলফিন বা বিশেষ প্রজাতির হরিণের মৃত্যু ঠেকানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। এটিকে নৈতিক উন্নতি হিসেবে না দেখে অস্তিত্ব ও মৃত্যু-বিষয়ক নতুন পরিস্থিতির নতুন উপলব্ধি হিসেবে দেখাই ভালো। কারণ, যে মানুষ ডলফিনের মৃত্যুতে শোকাকুল হয়, সে হয়ত আফগানিস্তান-ইরাকে লক্ষ মানুষের মৃত্যুকে আমলে আনার মতো ঘটনাই মনে করে না। আইনের শাসনের নামে দুনিয়াজুড়ে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকে। একপক্ষের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্যপক্ষের মৃত্যুকে উদযাপন করে। সে পক্ষ শনাক্ত করতে চায়, এবং একইসঙ্গে প্রতিপক্ষও। প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করতে পারলে মৃত্যু তার হিসাবের আওতায় চলে আসে। সে ‘অন্যে’র মৃত্যুকে ন্যায্য এবং ‘নিজে’র মৃত্যুকে সহনীয় দেখতে পায়। 

যাবতীয় রোগ-বালাইয়ের সঙ্গে লড়াই তার সেই মৃত্যুদর্শনেরই অংশ। তার মানেই হলো, অন্য সবকিছুর মতো মৃত্যুবোধও ঐতিহাসিকভাবে উৎপাদিত, সাংস্কৃতিকভাবে রূপায়িত এবং প্রভাবশালী ধ্যানধারণা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। করোনা এই পুরো ব্যাপারটিকে কিছু সময়ের জন্য মুলতবি রাখতে বাধ্য করেছিল। কোনো নতুন হিসেবে নিজের মনকে বশ মানানোর সুযোগও ছিল না। কাজেই এ মৃত্যুভীতির কোনো তুলনা মানব-ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। এমনকি ভবিষ্যতে মানুষ যদি এ রকম বা এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো বিপর্যয়ের মুুখোমুখি হয়, তবু এ রকম অভিজ্ঞতা আর হবে বলে মনে হয় না। কারণ, প্রথম অভিজ্ঞতার মেজাজ দ্বিতীয়-তৃতীয়তে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। 

করোনার শুরুর দিনগুলোতে মৃত্যুজনিত বিপর্যয়ের গুজব এ কারণেই সত্যের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল। ইন্টারনেটের দুষ্ট ছুটা শিকারিরা নিশ্চয়ই কিছু সংবাদ গড়াপেটা করেছে; কিন্তু সত্য হলো, গ্রাহক প্রান্তে ওই ধরনের সংবাদের জন্য মাঠ ছিল প্রস্তুতের চেয়ে বেশি। অমুক দেশে রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে আছে- এ সংবাদ তার জন্য খুবই বিশ্বাসযোগ্য ছিল; কারণ, সে নিজে মানসিকভাবে ওই পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যাচ্ছিল। মানুষ মৃত্যু-পরবর্তী কৃত্যের নিশ্চয়তা চায়। অন্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের কৃত্যে অংশ নেয়া আসলে তার নিজের মৃত্যু-পরবর্তী নিশ্চয়তাকেই নিজের কাছে পরিচ্ছন্ন করে। করোনা তার ভয়াবহ ছোঁয়াছে ক্ষমতার সত্যে বা গালগল্পে ভর করে মানুষের জীবনের নিশ্চয়তাকে যেমন তছনছ করে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি মৃত্যু-পরবর্তী কৃত্যের নিশ্চয়তাকেও অন্তত কিছুকালের জন্য ধসিয়ে দিয়েছিল। 

সার্বিকভাবে অনিশ্চয়তার বোধকে চূড়ান্ত মাত্রায় প্রতিষ্ঠা দিতে পারাই করোনা-সৃষ্ট প্রধান বাস্তবতা। ‘আধুনিক’ মানুষের ইতিহাস অনিশ্চয়তা থেকে ক্রমশ নিশ্চিত হয়ে ওঠার ইতিহাস। বর্তমান নিশ্চয়তার ওপর ভিত্তি করে সে ভবিষ্যতের পাক্কা হিসাব-নিকাশ করতে পারে- প্রজাতি হিসেবে এ নিশ্চয়তাই আধুনিক মানুষের সামষ্টিক অহংবোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভিত্তি। এর বুনিয়াদে দাঁড়িয়েই সে ইহলৌকিক হয়, এমনকি মহাকাশের একাংশকেও ইহলোক বানিয়ে ছাড়ে। ব্যক্তিগত অনিশ্চয়তা যথেষ্ট পরিমাণে থেকে গেলেও সামষ্টিক অনিশ্চয়তাকে মানুষ একরকম ব্যাখ্যার অধীন করতে পেরেছে। করোনার প্রথম দিনগুলো মানুষের সামষ্টিক এ ভিত্তিকেই তছনছ করে দেয়। কল্পনার সমস্ত সীমা ডিঙিয়ে মানুষকে অনিশ্চিত করে তোলে। ভরসা করার মতো ‘অন্য’ কেউ ছিল না। একে শেষ পর্যন্ত রুখে দেওয়া যাবে, এমন আশা নিশ্চয়ই ছিল; কিন্তু কাজ শুরু করার পরিস্থিতি ছিল না। দুনিয়াজুড়ে এ হতভম্ব দশা তৈরি করা করোনার সবচেয়ে কার্যকর প্রভাব।

তিন.

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মানুষ উদ্যোগ-আয়োজন শুরু করেছে। করোনার সঙ্গে বসবাসের কায়দা-কানুন রপ্ত করেছে; কিন্তু তার আগেই ‘আধুনিক’ দুনিয়ার মতিগতিতে ইমানদার মানুষরা কিছু সময়ের জন্য বেশ কোণঠাসা হয়ে উঠেছিল। মানুষের ইহলৌকিকতার প্রত্যয় বেশ কতকটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। আধুনিক সেক্যুলার মন বহুদিন হলে ওপরওয়ালার কর্তৃত্বে সন্দেহ করতে শিখেছে। সন্দেহই বা বলি কেন? অন্তত দুই শতক ধরে এ দৃষ্টিভঙ্গিই তো দুনিয়ায় রাজত্ব করছে। সংখ্যার বিচারে এ মতওয়ালারা নিশ্চিতভাবেই ছোট হবে; কিন্তু তাদের আছে বাস্তব জীবনযাপনে মিঠাই-মণ্ডা খাওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আছে দুনিয়ার প্রগতি বা উন্নতির বাস্তব সাক্ষ্যপ্রমাণ। ফলে ওপরওয়ালার ইমান নিয়ে দুনিয়াদারি করতে চায় যে বিপুল মানুষ, তারা তাদের আবদার বহুদিন হলো লুকাছাপা রেখে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। করোনাকালে কিছু সময়ের জন্য তারা একটা বিরাট মওকা পেয়ে যায়। 

ধর্ম বনাম বিজ্ঞান আলোচনা দুনিয়াজুড়ে বেশ জোরদার হয়ে ওঠে। ধর্মওয়ালাদের হাতে এক নগদ প্রমাণও মজুত ছিল। যে কোনো কারণেই হোক, করোনা ধনী দেশগুলোর বাসাবাড়িতে হানা দিয়েছিল তুলনামূলক বেশি। ফলে বিরাট হতাশা আর আতঙ্কের মধ্যেও বিপুল গরিব মানুষ তুলনামূলক সুখ ভোগের একটা সুযোগ পেয়েছিল। ঠিক এ দৃষ্টিকোণ থেকে না হলেও, ভোগে সক্ষম পয়লা দুনিয়ার মানুষজন নৈতিক আক্রমণের শিকার হয়েছে দুনিয়ার বহু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক-দার্শনিকের মতামতে। দুনিয়া যারা চালায়- কেন্দ্রগুলোতে এবং প্রান্তগুলোতে- তারা আক্রান্ত হয়েছে প্রধানত ভোগবাদী একটি দুনিয়া কায়েম করার অভিযোগে। করোনাকে দুনিয়াজুড়ে যারা দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছে, তারা মূলত এ দিকটিকেই সামনে নিয়ে এসেছে। কথাটি পরিষ্কার। বহুদিক থেকেই করোনার পাগলামিকে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে দেখার সুযোগ আছে। প্রথমে কিছুদিন ষড়যন্ত্রতত্ত্ব চাউর হয়েছিল। চীন ছিল সে আলাপ-আলোচনার ভিলেনপক্ষ। তাদের ল্যাবরেটরি এ ভাইরাসের জন্মস্থান- এমন গুজব নানা আকারে বেশ কিছুদিন রাজত্ব করেছে। এর গোড়ায় পশ্চিমা লবি কাজ করেছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সে প্রচারণা হালে পানি পায়নি; কিন্তু প্রকৃতি-যে প্রতিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে আছে, সে কথা বহুদিন হলো বহুজন বলে আসছিল। করোনা তাদের হাতের মুঠোয় একটা মোক্ষম জ্যান্ত নজির এনে হাজির করল। ফলে পয়লা দুনিয়ার ভোগবাদী মানুষগুলো বা দুনিয়ার অন্য অংশের সক্ষম ক্রেতারা নিজের ভোগলিপ্সাকে বাড়াতে বাড়াতে দুনিয়ার জন্য কী ভীষণ পরিণতি বয়ে এনেছে, সে কথাটা বড় গলায় বলা গেছে। ভোগকে হাজির করা গেছে বিলয়ের কারণ হিসেবে। ফলে অনেক দিন ধরে বলা কথাটি শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। 

কথাটি যুক্তিপ্রমাণসহ বলা অবশ্য খুব সহজ নয়। ভোগের পিপাসা মানুষের উন্নতির মূল- এ রকম বলার যথেষ্ট কারণ আছে। আদতে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক যে-জীবনদৃষ্টি গত কয়েক শতক ধরে দুনিয়ার কাম্য দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রভাবশালী, তার গোড়ায় আছে মানুষের এই ভোগলিপ্সার স্বীকৃতি। এর বিপরীতে ধর্ম বা সমাজতন্ত্রকে ঘিরে চালু থাকা ডিসকোর্সগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ার কারণে, তার বরাত দিয়ে ভিন্ন কথা বলা খুব সহজ ছিল না। করোনা কাজটিকে সহজ করেছে। প্রশ্নটা যেখানে দুনিয়ার থাকা-না থাকার, সেখানে আমার ক্ষমতা বা ইচ্ছার যুক্তি আর বড় থাকছে না। আমি সক্ষম, তাই আমি কামাই করি, ভোগ করি- এ কথা কেবল ততক্ষণ টেকসই থাকবে, যতক্ষণ তা দুনিয়ার অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি তৈরি করবে না। যদি বলা যায়, তুমি ভোগ করেছ এবং করছ, এখন অন্যরাও এ লাইনে শামিল হয়েছে; কিন্তু দুনিয়ার আরও কয়েকশ’ কোটি মানুষের জন্য ওই ওই অঞ্চলগুলো যদি বাড়তি ভোগের এনতেজাম করতে পারে, তাহলে এই দুনিয়ার মতো আরও তিনটি দুনিয়া লাগবে। তা যখন নেই, আর তোমরা যারা আগে থেকেই ভোগ করে আসছ, তারা অন্যদের স্থায়ীভাবে বঞ্চনার মধ্যে থাকতেও বলতে পারছ না, তখন সবার রয়েসয়ে ভোগ করার একটি শর্তে না এসে উপায় নেই। 

করোনার আগেও এসব কথাবার্তা উঠেছে। তবে করোনা এ ডিসকোর্সকে একটি শক্ত জমির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। 

এ উপলক্ষে উৎপাদনব্যবস্থা আর বিলিবণ্টনের যে-নিয়মে আজকের দুনিয়া চলছে, তা নিয়েও নতুন করে কথা তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। লাগামছাড়া মুনাফা আর কাছাখোলা উদ্যোগের এ দুনিয়া করোনার মতো দুনিয়াজোড়া বিপদ কীভাবে সামলাবে, তার দিশা পাওয়া খুব সহজ ছিল না। দেখা গেল, স্বাস্থ্যখাতের মুনাফাপ্রীতি দুনিয়ার বহু অংশের গণস্বাস্থ্যের বারটা বাজিয়ে রেখেছে। সক্ষম ক্রেতারাই কেবল স্বাস্থ্যসেবা কিনবে- এ নিয়মেই চলছে স্বাস্থ্য খাতের মূল অংশ; কিন্তু করোনার বাজারে এ সূত্র হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। প্রাইভেট উদ্যোগের বিপরীতে পাবলিক উদ্যোগ নিতেই হলো; কিন্তু চরিত্রগত ফারাকের কারণে তা খুব সহজ হলো না। ফলে সার্বিকভাবে প্রাইভেট খাতের দেউলিয়াপনা, অন্তত সরাসরি গণস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে, উদাম হওয়ার একটা জোরালো উপলক্ষ তৈরি করল করোনার অভিজ্ঞতা। 

করোনাকালে দার্শনিক মেজাজের দিক থেকে আরেকটি আলোচনা বড় হয়ে উঠেছিল। গত চারশ বছর ধরে ভাবগতভাবে রাজত্ব করা ‘মানবকেন্দ্রিকতা’ কার্যকর প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। একদা মানুষ তার অস্তিত্বের বাস্তব প্রয়োজনেই প্রকৃতির বিপরীতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছিল। সেটিকেই সাব্যস্ত করা হয়েছিল অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে। কাজটি অবশ্য ইউরোপীয় আধুনিকতার যুগে প্রথমবারের মতো হয়নি। একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো অন্যভাবে এ দর্শনই প্রচার করেছে। অন্য মাকলুকাত তো বটেই, এমনকি জিন, ফেরেশতা বা সমধর্মী অস্তিত্বের কল্পনাতেও সে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা ভোলেনি। তবে, আধুনিক মানুষের এ দাবিটি একেবারেই ভিন্ন কিসিমের। মানবকেন্দ্রিকতার ইউরোপীয় আধুনিক ধারণায় একটি কর্তৃত্বের ঘোষণা আছে। প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব কায়েমের ঘোষণা। গত কয়েক দশক ধরে সে অহমিকায় চিড় ধরছিল। ফলে মানবকেন্দ্রিকতা আস্তে আস্তে কম উচ্চারিত বয়ানে পরিণত হচ্ছিল। 

করোনাকালে মানবকেন্দ্রিকতার মর্যাদায় আরও একটি শক্ত ফাটল ধরল। একদিক থেকে মানুষকে কেন্দ্র থেকে নামিয়ে আর দশ জৈব অস্তিত্বের কাতারে নিয়ে আসার সাম্প্রতিক তরিকাও অবশ্য আরও গভীরভাবে মানবকেন্দ্রিক। অন্য অস্তিত্বগুলোর সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান ছাড়া মানুষের অস্তিত্বের জন্য জরুরি দুনিয়াটি ধ্বংস ঠেকানো যাবে না- এ ধরনের একটি ভীতিই এ দৃষ্টিভঙ্গির মূল; কিন্তু তাহলেও এর মধ্যে উঁচু মাপের আদব আছে। দশককে সঙ্গে নিয়ে বাঁচার শিক্ষা ও স্বীকৃতি আছে। যেমন করোনা ভীষণভাবে শিখিয়ে গেছে, নিছক মানবতাবাদী বা নৈতিক প্রেরণায় নয়, একেবারে অস্তিত্বের স্বার্থেই সব মানুষকে একসঙ্গে ভাবার চর্চাটা যত তাড়াতাড়ি রপ্ত করা যায়, প্রজাতি হিসেবে মানুষের জন্য ততই মঙ্গল। 

চার.

করোনার মতো পরিস্থিতি অভিজ্ঞতার মধ্যে না থাকলেও মানুষ কিন্তু এ রকম দুনিয়াজোড়া বিপর্যয়ের কথা বিস্তর কল্পনা করেছে। সায়েন্স ফিকশনে এরকম রোগ-বালাইয়ের উল্লেখ দেদারছে পাওয়া যায়। বিশেষত হলিউডের গ্রাফিক্সনির্ভর বড় বাজেটের মুভিতে প্রায়ই দেখা যায়, এরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা রোগবালাই বা শত্রুপক্ষের আক্রমণ মানুষ একক কৃতিত্বে অথবা যৌথভাবে সামলাচ্ছে। তাতে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য শত্রুপক্ষ সাধারণভাবে আসে মহাকাশ থেকে, এলিয়েনের বেশে। করোনার মতো নিজ গ্রহের শত্রুও অবশ্য দুনিয়ার সিনেমায় কম চিত্রিত হয়নি। বাস্তবে করোনা আসার পরে সে অভিজ্ঞতা মানুষের কাজে এলো না। 

দুনিয়ার মুরব্বিদের কেউ নেতা বনতে পারল না। সবাই নিজ নিজ কাছা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দেখা গেল, করোনা একদিকে দুনিয়াকে এবং দুনিয়ার মানুষকে এক সঙ্গে ভাবতে শিখিয়েছে; আবার যে রাষ্ট্রের অধীনে তার বসবাস সে রাষ্ট্রের সক্ষমতাই-যে তার জন্য প্রধান বাস্তবতা, সে কথাও আগের চেয়ে বড় করে মনে করিয়ে দিয়েছে। 

যেমন, বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে বুঝতে পেরেছে, কী দুর্বল ঠুনকো এক রাষ্ট্রকাঠামোয় সে যাপন করছে নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। তবে, করোনাকালে মানুষের অভিজ্ঞতার মধ্যে বিপদ সামলানোর পাশাপাশি আরেকটি বড় জিনিস যুক্ত হলো- যোগাযোগের এবং কর্মপ্রণালির একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষ শিখল, বহু কর্মকা- বা যাতায়াত বা প্রত্যক্ষ উপস্থিতি বাদ দিয়েই দুনিয়া চালানো সম্ভব। সম্ভব বাড়তি অনেক কিছু ছেঁটে ফেলা। 

এই মৌসুমে মানুষ তার সবকিছু বাস্তবায়ন করতে উঠে-পড়ে লাগবে, সে আশা বৃথা। তবে, এ অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী না করে কোনো উপায় নেই। সেসব অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই মানুষের আগামী দিনগুলোতে নতুন দর্শন বা অভিনব কল্পসাহিত্য আকারে অনূদিত হবে।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //