করোনাকালে যাপিত জীবন: শ্রেণি, ক্ষমতা ও বৈষম্য

কভিড-১৯ অতিমারি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে স্মরণকালের মধ্যে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। 

করোনা অভিঘাতের প্রভাব মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন নীতি-কৌশল ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে বৈষম্যমূলক প্রভাবের কারণে পিছিয়ে পড়া, দুর্বল, ঝুঁকিপ্রবণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তরা ক্রমেই প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। 

পুনরুদ্ধার প্রকৃতি ও কৌশল 

পুনরুদ্ধার নিয়ে অধিকাংশ আলোচনা প্রবৃদ্ধিতেই টিকে আছে ও কত দ্রুত পুনরুদ্ধার সম্পন্ন হবে তাতেই সীমাবদ্ধ; কিন্তু পুনরুদ্ধারের সার্বিক বিষয় ও প্রকৃতি নিয়ে তেমন কথা হচ্ছে না। সাধারণত পুনরুদ্ধারের উপায় হিসেবে ইংরেজি অক্ষরের পাঁচটি আকারের দৃশ্যকল্পের কথা বলা হয়। অর্থনীতি ‘ভি’র মতো নিচে নেমে আবার ছয় মাস পর ঘুরে দাঁড়াতে পারে। ‘ইউ’র মতো বেশ কিছুদিন পর ঘুরে দাঁড়াতে পারে। ‘ডব্লিউ’র মতো ঘুরে দাঁড়ায় আবার নিচে যায় এবং পরবর্তীতে পুনরুদ্ধার হয়। ‘এল’ এর মতো দীর্ঘদিন পর ঘুরে দাঁড়ায়। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে ‘আই’র মতো নিম্নগামী হতেই থাকে অথবা ‘কে’র মতো বৈষম্যমূলক গতিপথ নেয়। 

সরকার পুনরুদ্ধার নীতি-কৌশলে সক্রিয় প্রতিরোধ (একটিভ রেসট্রেইন্ট) ব্যবস্থা নিলে এক ধরনের পুনরুদ্ধার হবে; আর সক্রিয় নিষ্ক্রিয়তার (একটিভ ইনেকশন) আশ্রয় নিলে আরেক ধরনের পুনরুদ্ধার হবে। সক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থার শর্ত হিসেবে প্রথমত, জনগণকে সরকারিভাবে গণদ্রব্য বা পাবলিক গুডস প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে সম্পদ, বিভিন্ন সুফল ও সুযোগ-সুবিধাগুলোর বণ্টনমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-কাঠামোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্থত, অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এ শর্তগুলো পূরণ হলে সম্পদ, সুফল ও সুযোগ-সুবিধাগুলো গুটিকয়েক গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়ে সব গরিকের কাছে পৌঁছাবে। ফলে পুনরুদ্ধার গতিপথ বৈষম্যমূলক না হয়ে একটি অপেক্ষাকৃত কম বৈষম্যের সাম্যাবস্থার দিকে যাবে; কিন্তু এ শর্তগুলো পূরণ না হলে অর্থনীতি চরম বৈষম্যমূলক পুনরুদ্ধারের পথে যাবে এবং পুনরুদ্ধার গতিপথ ক্রমেই ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের চেহারা ধারণ করবে। অর্থাৎ সম্পদ উচ্চবিত্ত কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হবে, বিপরীতক্রমে দারিদ্র্য পরিস্থিতি বাড়তে থাকবে। নীতি-কৌশলের সক্রিয় নিষ্ক্রিয়তার অর্থ প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতি-কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করে মন্দা পূর্ববর্তী বৈষম্যমূলক-গোষ্ঠীতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখা। 

বৈষম্যমূলক ‘কে’ গতিপথ? 

পুনরুদ্ধার গতিপথ ‘কে’ অক্ষরের মতো হলে একদিকে বড় বড় কোম্পানি, কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পদ বেড়েই যাবে; অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষের আয় কমতে কমতে তলায় ঠেকবে। অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং শ্রেণি-পেশা ভেদে সামাজিক পার্থক্য ত্বরান্বিত হবে। আবার দারিদ্র্যের হার বাড়ার মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য ও মেরুকরণ বৃদ্ধি পাবে। বৈষম্যমূলক পুনরুদ্ধার পথের কারণ নিহিত আছে- রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এবং শ্রেণি ও ক্ষমতা কাঠামোর ধরনের মধ্যে। যারা গোষ্ঠীতন্ত্রে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে তারাই সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও অর্থ ব্যবহার করে আরও বেশি সম্পদশালী হয়; অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি হলেও তারা রাষ্ট্রের নীতিকৌশল নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে না। রাষ্ট্র সর্বজনের কথা না ভেবে গোষ্ঠীতন্ত্রের কথা ভাবে। 

দারিদ্র্য ও পৃথকীকরণ

১৯৯২ সালের পর এই প্রথম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, করোনার প্রথম চার মাসেই বেকারত্ব বেড়েছে ১০ গুণ। আর্থিক সংকটে পড়া ৪৬.২২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে এবং ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সাহায্যসহায়তার ওপর নির্ভর করে সংসার চালিয়েছে। বিআইডিএস গবেষণা অনুযায়ী, কোভিড-১৯ অভিঘাতে নতুন ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে। মূলত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির স্বল্পতা এবং সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তার অভাবেই নতুন দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। ফলে অধিকাংশ মানুষ প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। 

বৈষম্য ও মেরুকরণ 

গত কয়েক দশকে সম্পদ ওপরের দিকের কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। করোনার আগেই উপরের দিকের ১০ শতাংশ মানুষের আয় নিচের দিকের ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে বেশি ছিল। করোনার কারণে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। বিশেষত মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তদের অনেকে নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়ায় সামাজিক বৈষম্য ও মেরুকরণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, করোনা মহামারির মধ্যেই কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন। বিপরীতে দারিদ্র্য বাড়ছে, বৈষম্য বাড়ছে এবং মেরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণায় দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কালো ছায়া সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

স্বাস্থ্যসেবা খাত 

সালমা নারায়ণগঞ্জে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত। গত বছরের মার্চ মাসে প্রথম তিনি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী দেখতে পান। ওই সময়ে করোনা সংক্রমিত কাউকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কোনো কিছুই জানা ছিল না তাদের। কারণ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত রোগীদের শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণের সুযোগ ছিল না। পরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সালমা দেখতে পান, হাসপাতালটির প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামাদি (পিপিই), ভেন্টিলেটর এবং অন্যান্য সরঞ্জামের কিছুই নেই। ফলে তারা নতুন রোগীদের প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছু দিনের মধ্যেই চিকিৎসক ও নার্সসহ হাসপাতালের অনেক কর্মী সংক্রমিত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার জনগণের বিপরীতে ডাক্তারের অনুপাত মাত্র ৫.২৬ জন। এ অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে ১৬.৫ কোটি জনসংখ্যার জন্য আইসিইউ শয্যা আছে মাত্র ১ হাজারের মতো; অন্যদিকে ৬৭টি জেলার মধ্যে মাত্র ৪৭টি জেলাতে আইসিইউ সুবিধা আছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের নাজুক দশা মহামারিতে মানুষের দুর্ভোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া গত্যন্তর নেই আমাদের।

অভিবাসী শ্রমিক 

হারুন ইতালিতে রেস্তোরাঁ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ইতালি লকডাউনে যাওয়ার সময় তিনি চাকরি হারান এবং তখন তার পক্ষে দেশে ফেরাও সম্ভব ছিল না। হারুন এখন নিজের সামান্য সঞ্চয়টুকু ভেঙে পাঁচজনের সঙ্গে একটি রুমে ভাগ করে থাকছেন। দেশে ফিরতে না পারা বেশিরভাগ অভিবাসী শ্রমিক গ্রেফতার এবং দেশে ফেরত পাঠানোর আতঙ্কে আছে। ২১টি জেলায় ২০০টি খানায় পরিচালিত একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ সময়ে প্রতিটি খানায় গড়ে ৪৭ হাজার টাকা অভিবাসী আয় আসে। তবে কভিড-১৯ এর কারণে ৬১ শতাংশ খানায় কোনো অভিবাসী আয়ই আসেনি। অন্য ৩৯ শতাংশ খানায় এখন প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার টাকা অভিবাসী আয় আসছে। 

অর্থাৎ পূর্বের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম। এ খানাগুলোর ৫৭ শতাংশেই রেমিট্যান্স একমাত্র আয়ের উৎস (বিসিএসএম ও আরএমএমআরইউ, ২০২০)। করোনায় অভিবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি উর্ধ্বমুখী থাকলেও গত অক্টোবরে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮.৬২ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৫.৬৪ শতাংশ। ইতিমধ্যেই বিদেশে শ্রমিক যাওয়া ৭১ শতাংশ কমেছে (আরএমএমআরইউ, ২০২০)। এ কারণেই অভিবাসী আয় কমতে শুরু করেছে। বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে না দাঁড়ালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। কারণ ছদ্মবেকার ও উননিয়োজিত শ্রমিক গ্রাম থেকে শহরে ও বিদেশে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার কারণেই গ্রামে ভোগ ব্যয় বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে। অভিবাসী আয় কমে গেলে গ্রামীণ অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। 

নারী 

শিরিন তার নিজস্ব ছোট্ট ক্যাটারিং ব্যবসা পরিচালনা করেন। তিনি চুক্তির ভিত্তিতে বিভিন্ন অফিসে দুপুরের খাবার সরবরাহ করতেন; কিন্তু করোনার কারণে বিভিন্ন অফিস বন্ধ হয়ে গেলে এবং ঘরে বসে কাজ শুরু হওয়ার পর শিরিন খাবার সরবরাহের সমস্ত চুক্তি হারায়। কয়েক মাস ধরে শিরিনের আয়ের পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও পরিবারের ভরণপোষণের খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়ায় সংসারে ঘন ঘন কলহের ঘটনা ঘটছে। স্বামীর হাতে প্রায়ই তিনি শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। করোনায় অর্থনৈতিক চাপে শিরিনের মতো অনেক পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন বেড়েছে। প্রায় ৫৮ শতাংশ নারী মনে করেন মহামারিতে দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণেই সহিংসতা ও নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে (ব্র্যাক, ২০২০)। 

যুবক ও শিশু 

সুমনের বয়স উনিশ। তিনি মিরপুরের একটি হোস্টেলে থাকেন। সুমন মাধ্যমিক পর্যায়ের দু’জন শিক্ষার্থীকে বাসায় গিয়ে পড়াতেন। করোনার মধ্যে অনলাইনে পড়ানো চালিয়ে যাচ্ছিলেন; কিন্তু তাকে এখন অর্ধেক বেতন দেয়া হচ্ছে। করোনা অভিঘাতের পূর্বেই যুবকদের অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছিল। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ থেকে ২৪ বছরের বয়সী যুব বেকারত্বের হার ছিল ১২.৩ শতাংশ। বিআইডিএস এক গবেষণায় দেখিয়েছে, শিক্ষিত যুবকদের প্রায় ৩৩ শতাংশই ছিল বেকার। আইএলও এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে ১১.১৭ লাখ থেকে ১৬.৭৫ লাখ যুবক বেকার হতে পারে। অর্থনীতিতে পূর্বে বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতা এবং করোনার অভিঘাত যুবকদের এক ধরনের প্রিক্যারিটি বা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে; কিন্তু বিশালসংখ্যক যুবকদের কাজে লাগানো না গেলে রাষ্ট্র জনমিতিক লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশুরা এখন আরও বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকি, বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম, পরিবারের সদস্যদের দ্বারা শারীরিক শাস্তি এবং মনো-সামাজিক সমস্যার ঝুঁকিতে রয়েছে (সেভ দ্য চিলড্রেন, ২০২০)।

বয়স্ক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী 

শামসুল আলম একজন অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগী। ডায়াবেটিস ও হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণে তিনি বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তার স্ত্রীর তীব্র বাতরোগ থাকায় তেমন হাঁটাচলা করতে পারেন না। অধিকাংশ সময় হুইলচেয়ারেই বসে থাকতে হয়। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় শামসুল স্ত্রীকে ফিজিওথেরাপির জন্য হাসপাতালে নিতে ভয় পাচ্ছিলেন। শামসুল আলম এবং তার স্ত্রীর মতো বয়স্কদের করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি বযস্ক মানুষ একাধিক স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছেন। এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি বয়স্ক মানুষের ডাযাবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ব্যাপক আতঙ্ক, ক্রমবর্ধমান সামাজিক যোগাযোগের অভাব, চলমান সংকটের ভয় এবং ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০-১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধিতার শিকার। আয় হ্রাস, নতুন দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে প্রতিবন্ধীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। 

বস্তিবাসী 

পাঁচজনের পরিবার নিয়ে শাহানা মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ বস্তির পশ্চিম প্রান্তে একটি রুম ভাড়া করে থাকেন। তিনি তিনটি বাসায় গৃহকর্মী হিসাবে খ-কালিন কাজ করতেন। মহামারি শুরু হলে দুটি পরিবার সংক্রমণের উদ্বেগ থেকে তাকে বিদায় করে দেয়। এখন শাহানার মাসিক আয় এক-তৃতীয়াংশের নিচে নেমে এসেছে। অটো রিকশাচালক স্বামীর উপার্জন পুরোপুরি হ্রাস পেয়েছে। লকডাউনে বস্তির প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবারের প্রধান অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে শাহানার মতো শহুরে বস্তিবাসীদের মাথাপিছু দৈনিক আয় ৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তার স্বামীর মতো অনানুষ্ঠানিক খাতের অনেকেরই ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশ আয় হ্রাস পেয়েছে। 

অনানুষ্ঠানিক খাত 

রিয়াজ ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। করোনা শুরু হলে গাড়ির মালিক কয়েক মাস ধরে তাকে বেতন দিচ্ছেন না; কিন্তু গাড়ি চালানো ব্যতীত বিকল্প কোনো কাজ খোঁজার পথ নেই তার। পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে না পেরে তিনি শেষমেশ গ্রামে ফিরে গেছেন। রিয়াজ এখন হন্যে হয়ে কাজের সন্ধানে ফিরছেন। মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশ তথা ৫.১৭ কোটি মানুষ কোনোরকম সুরক্ষা ছাড়াই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা যে কোনো সময় তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায়টি হারাতে পারে এবং যে কোনো সময় দরিদ্রসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আয় না করে রাজধানীতে বসবাস করা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। 

কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প 

রতনের ঢাকায় একটি ছোট্ট দর্জি দোকান আছে। দোকানে কর্মচারী ৫ জন। দোকানের আয়ের বড় অংশই আসে দুই ঈদে; কিন্তু এ বছরটি ছিল ভিন্ন। করোনার প্রথম তিন মাস দোকান বন্ধ ছিল। তাই ইদুল ফিতরে কোনো আয়ই হয়নি। আবার ইদুল আজহায় দোকান খোলা থাকলেও যৎসামান্য কাজ হয়েছে। ইতিমধ্যেই রতনের সঞ্চয় ফুরিয়েছে। কয়েক মাসের দোকান ভাড়া এবং কর্মচারীদের বেতন বাকি। ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র শিল্পে সরকার ঘোষিত ঋণভিত্তিক অর্থ সহায়তা দিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যদিও বেসরকারি খাতের প্রতি তিন জনের দু’জনই এ খাতে নিযুক্ত। জীবিকার জন্য ৩.১২ কোটির বেশি মানুষ এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। মহামারিতে এসএমই খাতের প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে এবং প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ ব্যবসা বন্ধ থাকা বা আংশিকভাবে বন্ধ থাকার কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রায় ৯৪ শতাংশ এমএসএমইর বিক্রয় কমেছে এবং তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ সরকারি সহায়তা পেয়েছে। 

ম্যানুফেকচারিং খাত 

নাসিমা সম্প্রতি কড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন। তার উপার্জন সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা মজুরির একটি অংশ মাত্র। এ যৎসামান্য আয়ে কোনোরকমে জীবনযাপন হয়; কিন্তু লকডাউন শুরু হলে কারখানাটি তার পাওনা পরিশোধ না করে বন্ধ করে দেয়। নাসিমার কোন সঞ্চয় বা জীবনধারণের বিকল্প উপায় নেই। কারখানা চালু হলে তিনি নিরুপায় হয়ে পুনরায় সামান্য মজুরিতে কাজে যোগ দিয়েছেন। এপ্রিলে ম্যানুফেকচারিং খাতের কার্যক্রম আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮.৭৮ শতাংশ কমেছে। মজুরির হার ২০২০ সালের জানুয়ারির ৫.৫৭ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে জুলাইয়ে ৫.১৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসের তুলনায় এবার তৈরি পোশাক রফতানি হ্রাস পেয়েছে ৪৪৮ কোটি মার্কিন ডলার। মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে ১৭৯টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে প্রায় ০.১ কোটি শ্রমিক কাজ হারিয়েছে। অধিকন্তু ৪৭ শতাংশ শ্রমিক মজুরি পায়নি (ব্র্যাক, ২০২০) । 

কৃষিখাত 

কোভিড-১৯ যখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, ফেনীর নিকটবর্তী একটি প্রত্যন্ত গ্রামে রহমত বিভিন্ন কারণে চিন্তিত ছিলেন। বোরো মৌসুমে তার লোকসান হয়েছিল এবং রহমত ঋণ শোধ করতে পারেনি। করোনা দেশের কৃষকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারিজনিত কারণে প্রায় সব কৃষকই সরকার নির্ধারিত মূল্যের নিচে ফসল বিক্রি করেছেন। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে কৃষকদের প্রথম দেড় মাসে ৫৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। রহমতের মতো কৃষকদের গড় ক্ষতি প্রায় ০.০২৮ কোটি টাকা (ব্র্যাক, ২০২০)। তার ওপরে এক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কারণে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমির ধান পানিতে ডুবে গেছে। এতে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। 

সেবা খাত 

রূপায়ণ চাকমা রাঙামাটির সাজেকে একটি ক্ষুদে রিসোর্টের মালিক। ভ্রমণে বিধিনিষেধের কারণে তার রিসোর্টের প্রায় সমস্ত বুকিং শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছিলেন। চার মাস ধরে রূপায়ণ কর্মচারীদের আংশিক বেতন নিজস্ব সঞ্চয় থেকে প্রদান করে যাচ্ছেন। আর নিজের ব্যবসায় গুনতে হচ্ছে বড় ধরনের লোকসান। মহামারির একেবারে গোড়ার দিকেই সেবা খাতের বেশিরভাগ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পর্যটন, পরিবহন ও যোগাযোগ, ব্যাংক-বীমা, হোটেল এবং রিসোর্টের মতো খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৯ শতাংশ সেবা খাতে নিয়োজিত। জিডিপির অর্ধেকেরও বেশি আসে এই খাত থেকে। মহামারিজনিত কারণে পর্যটন খাতের প্রাক্কলিত ক্ষয়ক্ষতি হবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা (উন্নয়ন অন্বেষণ, ২০২০)। পরিবহন খাতে প্রায় ০.২৩ কোটি শ্রমিক নিযুক্ত এবং লকডাউনের কারণে এ খাত প্রতিদিন প্রায় ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সামগ্রিকভাবে পরিষেবা খাতের মজুরির হার জুলাই মাসে হ্রাস পেয়ে ৫.৫২ শতাংশ হয়েছে। জানুয়ারিতে ছিল ৬.২২ শতাংশ (পিপিআরসি-বিআইজিডি, ২০২০)। 

আনুষ্ঠানিক খাত 

ওয়ালিউল হক ঢাকার একটি বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা বিভাগে ৭ বছর ধরে কাজ করছিলেন। করোনায় কোম্পানিটির সংকোচন নীতির কারণে ওয়ালিউলকে চাকরি হারাতে হয়। এখন তিনি জীবিকার তাগিদে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করে আয় করছেন। করোনায় আনুষ্ঠানিক খাতেই এমন প্রভাব পড়েছিল। যদিও অনানুষ্ঠানিক খাতের চেয়ে এখানে তুলনামূলকভাবে বেশি চাকরির সুরক্ষা থাকে বলে মনে করা হয়। আনুষ্ঠানিক খাতের ০.৯ কোটি শ্রমিকের মধ্যে ৮৪ শতাংশ নিযুক্ত বেসরকারি খাতে। কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের মজুরির প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ কমিয়েছে। মহামারির প্রথম কয়েক মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, বাণিজ্যিক ও বহুজাতিক ব্যাংকের আয় কমেছে ৬৬ শতাংশ। অধিকন্তু করোনার মধ্যেই সরকার ২৫টি সরকারি মালিকানাধীন পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে, ফলে আরও ২৫ হাজার স্থায়ী কর্মী বেকারত্বের মুখে পড়েছেন। 

রোহিঙ্গা শরণার্থী 

ফাতেমা শরণার্থী শিবিরের একটি ছোট কুঁড়েঘরে দুটি সন্তান এবং ছোট ভাইকে নিয়ে থাকেন। তিনি আবার সন্তানসম্ভবা। সম্প্রতি ফাতেমা লক্ষ্য করেছেন, এনজিওর লোকজন আগের মতো আসে না এবং বিভিন্ন সেবাও আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। ফাতেমা করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষের মুখে ভাসাভাসা শুনেছেন; কিন্তু এনজিওকর্মীরা না এলে ফাতেমা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাও পাবে না। মহামারীতে শিবিরগুলোতে যৌন হযরানি এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বেড়েছে। রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় জনগণ উভয়ের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ এমনিতেই হ্রাস পেয়েছে। প্রশাসন বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম ৮০ শতাংশ হ্রাস করার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও অবনতি ঘটে। অন্যদিকে উপার্জনমূলক কর্মকা-ে জড়িত হওয়ার সুযোগ না থাকায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশু পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে।

শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, সার্বিক জীবনমানের উন্নতি 

প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের সার্বিক জীবনমানের উন্নয়ন প্রয়োজন। আবার জৈব এবং অজৈব উভয় ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে স্থিতিশীল, টেকসই ও বজায়ক্ষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিভেদ কাটিয়ে একটি মানবিক মর্যাদাপূর্ণ, সমতাভিত্তিক, ন্যায়বিচারের গণতান্ত্রিক নাগরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। শুধু প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক উন্নয়ন দর্শন এবং জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর ও প্রকৃতি-পরিবেশ বিধ্বংসী প্রযুক্তি থেকে বেরিয়ে টেকসই ও সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের পথ খুঁজতে হবে। মানুষ এবং প্রকৃতি-পরিবেশকে প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে প্রযুক্তিকে বরং মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো করে তৈরি করতে হবে। 

উপসংহার 

বাংলাদেশ এখনো যদি অভিঘাত মোকাবেলায় সক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থার আশ্রয় নেয়, তবে পুনরুদ্ধারের বৈষম্যমূলক ‘কে’ গতিপথ এড়ানো সম্ভব।

প্রথমত, সর্বজনীন প্রাথমিক আয় হিসেবে প্রতিটি নাগরিকের কাছে অবশ্যই নগদ অর্থ পৌঁছাতে হবে। দ্বিতীয়ত, গণদ্রব্য যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সর্বজনীন ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, কতিপয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ চিন্তা না করেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্বার্থে নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থত, রফতানি প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য রফতানিমুখী পণ্য এবং বাজারের বৈচিত্র্যকরণে গুরুত্বারোপ করতে হবে। পঞ্চমত, টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা অবশ্যই পরিবেশবান্ধব করতে হবে। ষষ্ঠত, শুধু মুদ্রানীতি নির্ভর না হয়ে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির সমন্বয়ে নতুন বিনিয়োগ এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। সপ্তমত, কর্মসূচি এবং নীতিগুলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক হতে হবে, যাতে অর্থনীতিতে গুণকপ্রভাবক সৃষ্টিতে সক্ষম খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। 

ইতিহাস থেকে প্রমাণিত বাংলাদেশের জনগণ কখনো হাল ছাড়েনি। যে কোনো সংকট, বঞ্চনা, অধিকারহীনতা মোকাবেলা করে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সমস্ত বাধা-বিপত্তি, সংকট, অনিশ্চয়তা কাটিয়ে তারা নিশ্চয় আবার ঘুরে দাঁড়াবে। 

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //