দারুচিনি দ্বীপে তোলপাড়

ছোটবেলায় ডাকটিকিট, ভিউকার্ড ইত্যাদি জমানোর শখ ছিল আমার। আর তা পূরণে খুব সহায়ক হয়েছিল পত্রমিতালী। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশে, এমনকি বাংলাদেশ ও ভারতেও আমার পত্রমিতা ছিলেন। 

তেমন এক পত্রমিতা ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার এক ব্যক্তি। ভদ্রলোক ছিলেন খুব রাশভারি। আমি ছিলাম তার তুলনায় এক্কেবারে ছোট্টোটি। আমি মা’কে দিয়ে ইংরেজিতে চিঠি লিখিয়ে নিয়ে, সেই চিঠি পোস্ট করতাম তাকে। আর তিনি মোটা ও পিচ্ছিল ধবধবে সাদা কাগজে ইলেকট্রিক টাইপ রাইটারে টাইপ করে চিঠি পাঠাতেন। নিচে শুধু কলম দিয়ে সইটুকু করতেন। সেই চিঠি যে খামে আসত তার গায়ে লাগানো থাকত অনেক ডাকটিকিট। তাছাড়া খামের ভেতরেও থাকত ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার ডাকটিকিট। টিকিটগুলো নানান রকমের ও রঙের হতো; কিন্তু অনেক টিকিটেই কালো টুপি পরা একজন মানুষের ছবি থাকত। সেই মানুষটির নামও লেখা থাকত টিকিটের গায়ে। সেখান থেকেই জেনেছি ছবির মানুষটির নাম সুহার্তো। আমি ভেবেছিলাম, উনি বোধহয় দেশটির প্রতিষ্ঠাতা বা জাতির পিতা হবেন। পরে বাবাকে জিজ্ঞেস করে তার পরিচয় জানতে পেরেছিলাম। আগ্রহের কারণে আরও পরে জেনেছি, সুহার্তো ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর জেনারেল।

মাত্র ৬১ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন খন্দকার মাহমুদুল হাসান! কী এমন তাড়া ছিল আপনার? ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে গত ২৮ জানুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিচিত্র্য বিষয়ে লিখলেও মূলত শিশুসাহিত্যি ও প্রত্নতত্ত্বই ছিল তার আগ্রহের বিষয়। কোথাও প্রত্নতত্ত্বের কোনো খবর পেলেই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ছুটে যেতেন। 

তার লেখা বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। লিখেছেন- ইতিহাস, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, কিশোর উপন্যাস ও গল্প। গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে হলো- দুই খণ্ডের ‘বাংলাদেশের পুরাকীর্তি কোষ’, দুই খণ্ডের ‘প্রথম বাংলাদেশ কোষ’, বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেপথ্য-কাহিনি, ঢাকা অভিধান, চলচ্চিত্র, সিনেমা থেকে চিত্রালী, প্রাচীন বাংলার আশ্চর্য কীর্তি, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, হিব্রু থেকে ইহুদি, বাংলাসাহিত্যে মুসলিম অবদান, যেমন করে মানুষ এলো, ইতিহাসের সেরা গল্প প্রভৃতি ।

আমাদের পত্রিকার সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আমাদের পত্রিকার ঈদ সংখ্যা এবং ‘ত্রৈমাসিক দেশকাল পত্রিকা’য় তার অসংখ্য লেখা আমরা ছেপেছি। মৃত্যুর আগে তিনি আমাদের পত্রিকার জন্য বেশ কয়েকটি লেখা পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে আলোচ্য লেখাটির মাধ্যমে আমরা তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি

এই অবস্থায় দেশটির শাসনক্ষমতা কমিউনিস্টদের হাতে চলে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দেয় যুক্তরাষ্ট্রপন্থীদের মধ্যে। সুহার্তোর নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর অভিযান বিশ্বব্যাপী এখন পরিকল্পিত গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দীর্ঘকাল পরে জানা গিয়েছিল যে, সেই পরিকল্পিত গণহত্যায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। এখন বিভিন্ন সূত্র বলছে যে, কুড়ি থেকে ত্রিশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। বিশ্ব ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যাগুলোর একটি ছিল এটি।জেনারেল সুহার্তো (১৯২১-২০০৮) ক্ষমতায় এসেছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ১৯৬৫-১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলন নির্মমভাবে দমনের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসেন। দেশটি নেদারল্যান্ডসের কাছ থেকে স্বাধীনতার আগে একটি পরাধীন দেশ ছিল। ইন্দোনেশিয়ার মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুকর্ন (১৯০১-১৯৭০)। তিনি স্বাধীন ইন্দোনেশিয়া দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতাও ছিলেন। তিনি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইসলামপন্থীদের কর্মকাণ্ড চালাতে দিয়েছিলেন। আবার কমিউনিস্টদের তৎপরতাও অনেক বেড়েছিল। 

সুকর্ন ইসলাম ও কমিউনিজম দুই মতাদর্শ দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি আত্মত্যাগ করেছিলেন ও জেল খেটেছিলেন। তিনি দেশশাসন করতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তার জনপ্রিয়তা কমেছিল ও তিনি স্বৈরাচারী একনায়ক হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন। তার অনুগত ছয়জন জেনারেলকে হত্যার মাধ্যমে মার্কিনপন্থী সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। 

১৯৪৯ থেকেই ইন্দোনেশিয়ার জনমানসে সুকর্নোর অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবমূর্তি ছিল। এই ভাবমূর্তি দিনে দিনে ক্ষুণ্ন হয়েছিল। গ্রেফতার-নির্যাতন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের পরিচালক বা গাইড হিসেবে নিজেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন থাকা, নিজেকে ১৯৬৩ সালে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা, মুদ্রাস্ফীতি ৬০০ শতাংশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে অতি জনপ্রিয় এই নেতা খুবই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। তিনি শেষে বেতার ভাষণে জনগণকে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। তার সমর্থকরা যত সংখ্যায় পথে নেমেছিল তার বেশি সংখ্যায় মানুষ পথে নেমেছিল সুহার্তোর সমর্থনে অর্থাৎ সুকর্নোর উৎখাতের পক্ষে। ১৯৬৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পরও সুকর্নোকে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল রাখা হয়। ১৯৬৬ সালে তাঁকে দুর্নীতির দায়ে অপসারণ করা হয়। 

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় সুহার্তোর জনপ্রিয়তাও বেশ ছিল। এই জনপ্রিয়তা ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। এই হলো সেই সুহার্তোর ইতিবৃত্ত, যিনি পূর্বসূরি শাসককে দুর্নীতির দায়ে অপসারণ করেছিলেন। পরে অবশ্য সুকর্নোর মেয়ে মেঘবতী বা মেগওয়াতি সুকর্নোপন্থী জনগণের সমর্থনে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।

অনেক আগে কোথায় যেন পড়েছি, দূর অতীতেও আরবের মতো দূরবর্তী দেশের মানুষ মসলার জন্য নির্ভর করত মসলা দ্বীপের ওপর। বনিকেরা তাই মসলা সংগ্রহের জন্য মহাসমুদ্র পাড়ি দিত। তবে মসলা শুধু একটা দ্বীপেই পাওয়া যেত না। কাছাকাছি অবস্থিত অনেকগুলো দ্বীপেই পাওয়া যেত দারুচিনির মতো মসলা। তাই সেই দ্বীপ বা দ্বীপমালার নাম হয়েছে দারুচিনি দ্বীপ। সেই মত অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়া হলো দারুচিনি দ্বীপ। ইন্দোনেশিয়ার এসব উত্থান-পতনকে তাই দারুচিনি দ্বীপে তোলপাড় বললে বোধ করি ভুল হবে না। তবে এ তোলপাড় শুধু দারুচিনি দ্বীপেরই ছিল না, তা ছিল বিশ্ব পরিস্থিতিতেই। 

মহা পরিতাপের বিষয় সেই তথাকথিত কমিউনিস্ট দমন, যা আসলে ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর গণহত্যাই ছিল, এতকাল পরেও তার কোনো বিচার হয়নি। আজও মানবাধিকারের পশ্চিমা ধ্বজাধারীদের চোখের ওপর স্কচটেপ আঁটা। ইন্দোনেশিয়ার জনগণকে তাদের ইচ্ছেমতো শাসন ব্যবস্থা যে গ্রহণ করতে দেয়া হয়নি, এ হলো তারই ঐতিহাসিক প্রমাণ। অথচ তারা গণতন্ত্রেরও অভিভাবক। হায় সেলুকাস!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //