প্রযুক্তি: জাগরণের ঊর্মি

সভ্যতার বিবর্তনে কৃষি, শিল্প, তথ্য বিপ্লবের পর এখন প্রযুক্তি সভ্যতা চলমান। প্রতিনিয়ত মানুষ অপার বিস্ময়ে দেখছে আর উপভোগ করছে, প্রযুক্তির কল্যাণময় রূপান্তর। নব নব সৃষ্টিতে প্রযুক্তি মানবজীবনকে আরামদায়ক করে তুলছে। দিনে দিনে বিশ্বে মানুষ প্রযুক্তির ছোঁয়া পেয়ে অজেয়কে জয় করে চলছে। 

জীবনযুদ্ধের নানা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার সম্ভাবনাময় সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তুলছে। মানবজাতির ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। এতে প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগ বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে। অন্যথায় অতীতের ধারাবাহিকতায় বুদ্ধিমান মানুষ প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে সভ্যতার ধ্বংস ডেকে আনবে। 

বাংলাদেশে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তির ব্যবহার তেমনভাবে গুরুত্ব পেয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। কিছু সহজ উচ্চারণে, কিছু স্বপ্নে, কিছু পরিকল্পনাহীন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্যেই প্রযুক্তির ব্যবহার সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। প্রযুক্তির প্রাগ্রসরতাকে জাতীয় মুক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ায় উন্নয়ন-অগ্রগতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের বিপুল জনসংখ্যার স্বচ্ছল নিশ্চিত জীবন গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যাকে সীমিত রাখার কথা আমরা ভুলেই গিয়েছি। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে আজ সতের কোটি মানুষের বাস। সংখ্যা বিবেচনায় এদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করা যায়নি। 

বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে পরিবর্তনকে ধারণ করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। দেশে পেশাজীবীদের মধ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রম খুব বেশি দাগ কাটে বলে মনে হয় না। তবে বিদেশে প্রশিক্ষণের আগ্রহ সবার মধ্যে কল্পনাতীত। এই বিদেশে প্রশিক্ষণ দেশের প্রযুক্তির ব্যবহারকে কতটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। এখন যদিও এই বিদেশ প্রশিক্ষণ ডাল-ভাত করে ফেলা হয়েছে। বিচিত্র সব বিষয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে দলে দলে যাচ্ছেন কর্তাব্যক্তিরা। কেউ পুকুর কাটা শিখতে যাচ্ছেন, কেউ খিচুড়ি রান্না করা শিখতে যাচ্ছেন আবার কেউ আফ্রিকার দেশগুলোতে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা শিখতে যাচ্ছেন। তবে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বিশাল অংশই মাঠ পর্যায়ে থাকেন না। তারা অন্য কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য অন্যত্র সচেষ্ট হয়ে পড়েন। এতে করে প্রযুক্তির উন্নত ধারা যদি শিখেও আসেন, তবে তা আর মাঠে প্রয়োগ হয় না। দেশ যে তিমিরে ছিল সেখানেই আটকে থাকে। প্রশিক্ষণ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না। এহেন মানসিকতা পরিবর্তন প্রয়োজন; কিন্তু তার সুযোগ সৃষ্টির কোনো ব্যবস্থাপনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। 

সম্প্রতি সরকার কারিগরি শিক্ষায় প্রচণ্ড আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বহু কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সরকার ২০২০ সালের মধ্যে ২০ ভাগ, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ ভাগ ও ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ কারিগরি জনশক্তি তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি অনেক কারিগরি শিক্ষায়তনে দ্বিতীয় শিফটের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। ২০২০ সালে শেষ হয়ে গেলে সরকার পরিকল্পনা মোতাবেক ২০ ভাগ কারিগরি জনশক্তি তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছে। তবে গত ৫০ বছরে ২ ভাগের কম জনশক্তিকে ১২/১৩ ভাগে উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যায়, সরকারের চলমান পরিকল্পনায় আগামী সময়ের মধ্যে ৪০ ভাগ কারিগরি জনশক্তি তৈরি সম্ভব হবে। তবে এই জনশক্তি দেশের প্রাযুক্তিক কর্মকাণ্ডে কতটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন আছে। 

সরকার দেশে কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের কথা বোধকরি ভুলে গিয়েছে। এই শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সিংহভাগই ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সরদার। জবাবদিহি, দায়বদ্ধতা না থাকার এ দেশে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন কীভাবে দেয়া হয়, তা নিয়ে কথা বলার খুব একটা সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে এভাবে যে দক্ষতা অর্জন করা যায় তা আমাদের বিশ্বে রোল মডেল হওয়ার সুযোগ করে দেয়। তারপরও সরকার হঠাৎ করে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ব্যবসার উত্তরোত্তর উন্নয়নকে গতিশীল রাখতে কারিগরি শিক্ষার্থীদের বয়সসীমার বার তুলে নিয়েছে ও জিপিএ কম করে দিয়েছে। এতে করে দক্ষতা অর্জন নয়, বাণিজ্যিকভাবে সনদ প্রাপ্তির পথ সুগম হয়েছে। 

আমাদের শিক্ষার সাথে কর্মজীবনের সম্পর্ক খুব দুর্বল। কারিগরি শিক্ষা তো এমন হবার কথা নয়। ১৯৫৫ সালে যে কারিগরি শিক্ষা শুরু হয়েছিল তার ঐতিহ্য সযত্নে লালন করে চলেছি আমরা। প্রযুক্তি যে প্রতিদিন এগিয়ে চলেছে তা কেউ বিশ্বাস করে বলে মনেই হয় না। সংশ্লিষ্টরা গতানুগতিকতার বাইরে আসতে চায় না। দেশ-বিদেশের কর্মজীবনের সাথে সংগতিপূর্ণ দক্ষতা অর্জনের কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা কার্যক্রমের আধুনিকীকরণ নেই, পাঠাগারে চলমান প্রযুক্তি উন্নয়ন ধারার পাঠ্যপুস্তক নেই, ব্যবহারিক শিক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের অভাব সর্বোপরি শিক্ষক স্বল্পতা পুরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বেহাল করে রেখেছে। সমস্যার সমাধান করে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। 

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখার ঘোষণা বাস্তবায়ন করে চলছে। তবে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বেহাল অবস্থা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রমকে মসৃণ করতে পারছে না। বেহাল দশা থেকে উত্তরণের জন্য যে রসদের প্রয়োজন তারও সরবরাহ নেই, আগামীতে সে সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। গুণীজনদের শত চিৎকারেও শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি ঘটছে না। দেশের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণখাতে জাতীয় বাজেটে উদ্বেগজনক অপ্রতুল বরাদ্দ মানব সম্পদ উন্নয়নের পরিচায়ক নয়। জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচির ২ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে চলমান সবার জন্য শিক্ষার কার্যক্রমের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ শুধু অপ্রতুল নয় লজ্জাজনক। এই বরাদ্দ নিয়ে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছি; কিন্তু কেউ মনে রাখেনি বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের কথা। 

সদ্য স্বাধীন দেশে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সে পথে এখনকার শাসক শ্রেণি না হাটার কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের জ্ঞান ও দক্ষতা সম্পন্ন কারিগরি জনশক্তি সোনার হরিণ হয়েই থেকে যাচ্ছে। 

বর্তমান সরকার জাতিকে শিক্ষানীতি উপহার দিয়ে সমাদৃত হয়েছে। অতীতের সব কয়টি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সুপারিশে গুরুত্ব বিবেচনায় কারিগরি শিক্ষাকে পৃথক অধ্যায় হিসেবে স্থান দেওয়া হলেও বর্তমান শিক্ষানীতিতে তা বৃত্তিমূলক শিক্ষার সঙ্গে একই অধ্যায়ে সংযুক্ত। সরকারিভাবে কারিগরি শিক্ষার প্রতি এটিই সবচেয়ে বড় আন্তরিকতার প্রমাণ! রাজনীতিতে প্রযুক্তির চর্চা করতে হবে। সাধারণের শিক্ষার বরাদ্দ সম্মানজনক হারে বৃদ্ধির পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা-প্রশিক্ষণে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে কর্মজীবনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতির স্মারক পাথরযুগ থেকে ন্যানোটেকনোলজি পর্যন্ত বিবর্তনকে সামনে রেখে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। 

প্রযুক্তির ম্যাজিকে জীবন ভরে উঠুক। প্রযুক্তি জাগরণের ঊর্মি হোক। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে উচ্চারিত প্রযুক্তির নতুন ভাবনা, চিন্তা, অনুভূতি আমাদের আকাশে ছড়িয়ে পড়ুক সূর্যের রশ্মির অপ্রতিরোধ্য গতিতে, বাতাসের অবাধ গতিতে।

-লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //