আমীন আল রশীদ
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫২ এএম | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:০০ এএম
ফাইল ছবি
প্রথমে নিখোঁজ ও পরে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল প্রায় নয় মাস পর যেদিন (২৫ ডিসেম্বর) বাড়ি ফিরলেন, সেদিনই একটি চলচ্চিত্রের সংলাপে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয় ওই সিনেমার পরিচালক ও এক অভিনেতাকে।
পুলিশ নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় যেদিন সিনেমার পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেফতার করল, তার চারদিন পর প্রথম সারির একটি পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম- ‘ডাকাতি করতেন দুই এএসআই, সাথে নিতেন সরকারি অস্ত্র’। এর চারদিন পর পত্রিকার আরেকটি শিরোনাম- ‘ডিবির তদন্তে বেরিয়ে এলো, ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়েছিল র্যাব।’ একটি প্রথম সারির নিউজ পোর্টালের শিরোনাম- ‘হাজতিকে নির্যাতনে হত্যার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে’।
দেখা যাচ্ছে, হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা; সংবাদ প্রকাশের জেরে একজন সাংবাদিককে ধরে নিয়ে প্রায় গুম করে ফেলা কিংবা বিতর্কিত আইনে তাকে গ্রেফতার; ডাকাতি করা কিংবা ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে পয়সা আদায়ের ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হলেও সিনেমার সংলাপে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যে অভিযোগে পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাও প্রশ্নাতীত নয়। কারণ তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায়।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ১৬ ডিসেম্বর ‘আই থিয়েটার’ নামক একটি অ্যাপে আংশিকভাবে মুক্তি পায় ‘নবাব এলএলবি’। সিনেমার একটি দৃশ্যে ধর্ষণের শিকার এক নারী থানায় মামলা করতে যান- যেখানে পুলিশের এক এসআই (অভিনয় করেছেন শাহীন মৃধা) ওই নারীকে ধর্ষণ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এ নিয়ে আপত্তি জানায় পুলিশ। পরে গত ২৪ ডিসেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে সিনেমার পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনেতা শাহীন মৃধাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরদিন তাদের আদালতে হাজির করা হলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
যে পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়, সেখানে ‘পর্নোগ্রাফি’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যা চলচ্চিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, গ্রাফিক্স বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য ও যার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই।
প্রশ্ন হলো- উল্লিখিত সিনেমার কোনো একটি দৃশ্যে যদি একজন ভিকটিমকে ধর্ষণের বিষয় নিয়ে পুলিশের প্রশ্ন করার দৃশ্য দেখানো হয়, তার মাধ্যমে কি যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে? সেখানে যে সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে, তা কি অশ্লীল? অশ্লীলতার মানদণ্ড কী?
অসংখ্য সিনেমার সংলাপে গালাগাল আছে। বিশেষ করে নায়ক ও খলনায়কের মধ্যে যখন বাহাস হয়। সে হিসেবে ওইসব সিনেমার বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করা যায়। সিনেমার প্রচুর গানে নারীর শরীর যেভাবে প্রদর্শন করা হয়, তা কি অশ্লীল? যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশের অধিকাংশ সিনেমার বিরুদ্ধেই এই আইনে মামলা করা যায়। তার চেয়ে বড় কথা, স্বাভাবিক জীবনের অশ্লীলতা আর শিল্পের অশ্লীলতা এক নয়। শিল্পী অনায়াসে একজন নগ্ন নারীর ছবি আঁকতে পারেন; কিন্তু চাইলেই একজন নারী নগ্ন হয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারেন না।
সমস্যা আসলে সংলাপ বা দৃশ্যের নয়। সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গীর। পুলিশ হচ্ছে জনগণের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তারা যদি এভাবে সিনেমার কোনো একটি দৃশ্য বা কিছু সংলাপকে অশ্লীল দাবি করে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করে পরিচালক ও অভিনেতাদের গ্রেফতার করতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো নাটক-সিনেমায় পুলিশের কোনো চরিত্র রাখার আগে চিত্রনাট্যকার দশবার ভাববেন। কবি ও লেখকরাও পুলিশকে নিয়ে কিছু লিখতে ভয় পাবেন।
কাজলের বাড়িফেরা
প্রায় ৯ মাস পর গত ২৫ ডিসেম্বর বাড়ি ফেরেন আলোকচিত্রী শফিকুল ইসলাম কাজল। গত বছরের ১১ মার্চ পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় বাসা থেকে বের হয়ে তিনি নিখোঁজ হন। এর ৫৩ দিন পর গভীর রাতে যশোরের বেনাপোল সীমান্তের একটি মাঠ থেকে তাকে ‘উদ্ধার’ করার কথা জানায় পুলিশ। ৩ মে থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।
নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর। যুব মহিলা লীগের দুই নেত্রীও তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা করেন। সুতরাং তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এইসব মামলা ও ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে কি-না, তা প্রশ্নাতীত নয়।
কাজলকে কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কেন নিয়েছিল, কেনই বা তাকে ছেড়ে দিলো ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে থেকে তাকে ‘উদ্ধারের’ কথা বলা হলো- এসব প্রশ্নের জবাব কোনোদিনই হয়তো জানা যাবে না। নিখোঁজ থাকার দিনগুলোতে তার সাথে কী আচরণ করা হয়েছে, তার কাছ থেকে কী কী জানতে চাওয়া হয়েছে, কোন শর্তে তাকে জীবিত রাখা হলো বা কেন তাকে গুম করা হলো না- সেসব প্রশ্নের উত্তরও হয়তো জানা যাবে না। হয়তো চুপ থাকার শর্তেই তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। হয়তো কাজল কোনোদিনই নিখোঁজ থাকার দিনগুলোর কথা প্রকাশ্যে বলবেন না। কারণ অতীতেও যারা এরকম ‘নিখোঁজের’ পর ফিরে এসেছেন, তাদের মোটামুটি সবাই চুপ থেকেছেন।
ব্যতিক্রম লেখক ফরহাদ মজহার। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে তার সাথে কী আচরণ করা হয়েছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন; কিন্তু দেশের একজন খ্যাতিমান লেখক (তার রাজনৈতিক পরিচয় বা মতাদর্শ যা-ই হোক না কেন) হিসেবে না হোক, অন্তত একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেও তিনি যে সংবাদ সম্মেলন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপারে কিছু গুরুতর অভিযোগ করলেন, রাষ্ট্র কি তার সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছে? নেয়নি। কারণ যারা নাগরিকদের এরকম ধরে নিয়ে যায় বা গুম করে, তারা হয়তো অনেক সময় রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী।
সুতরাং সেই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ যদি মনে করেন সিনেমার কোনো সংলাপে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাহলে যে পরিচালককে ধরে নিয়ে যাবেন- সেটিই স্বাভাবিক। এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর সব অপরাধের অভিযোগ উঠলেও কতগুলো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়, তা নিয়ে নাগরিকদের মনে প্রশ্নের শেষ নেই।
প্রসঙ্গত, গত ৩ জানুয়ারি সকালে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ৩৭তম বিসিএস কর্মকর্তাদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭২ সালে পুলিশ বাহিনীকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা মেনে চলতে হবে। আজ তোমরা যে শপথ নিয়েছ তা পালন করতে হবে। জনগণের পুলিশ হতে হবে।’
প্রশ্ন হলো- পুলিশ বাহিনী কি সে পথে এগোচ্ছে?
ABOUT CONTACT ARCHIVE TERMS POLICY ADVERTISEMENT
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ | প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ
প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী | ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
© 2021 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh