জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন যেকোনো সভ্য দেশে মানুষের মৌলিক মূল্যবোধগুলোর একটি। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশ বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে নিজেদের জন্য একটি পতাকা অর্জন করতে পেরেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং বাংলাদেশকেও এই পতাকার জন্য কত যে মূল্য দিতে হয়েছে।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই পতাকা আমাদের স্বাধীনতার চেতনা আর সার্বভৌমত্বের প্রতীক।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগে ২ মার্চ পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয় ও স্বাধীনতা অর্জনের কঠিন, দুস্তর পথে যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় একই রকম দেখতে একটি পতাকা ব্যবহার করা হতো, যেখানে মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের একটি মানচিত্র ছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়।
প্রথম পতাকাটি এঁকেছিলেন স্বভাবশিল্পী ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস। এই পতাকা তৈরির জন্য কাপড় দিয়েছিলেন ঢাকা নিউমার্কেটের অ্যাপোলো টেইলার্সের মালিক বজলুর রহমান লস্কর। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান কলাভবনের সামনের পশ্চিম গেটেই বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব।
বিজয়ের পর ১৯৭২ সালে শিবনারায়ণ দাসের ডিজাইন করা পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা-সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয় পটুয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান আমাদের জাতীয় পতাকার যে রূপ দিয়েছিলেন, সেটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারিভাবে গৃহীত হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে শিবনারায়ণ দাসের নকশা করা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
এখন জরুরি প্রশ্নটি হলো লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে লাল-সবুজের পতাকা আমরা পেয়েছি, সেই পতাকার মর্যাদা আমরা কতটুকু রাখতে পেরেছি? আমাদের জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান দেখানোর মতো সচেতনতা আমাদের অনেকেরই নেই। এমনকি আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মানবোধ দেখলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। সম্প্রতি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেভাবে সবুজ জমিনের ভেতর লাল বৃত্তকে চারকোনা বানিয়ে, সেই পতাকা বাংলাদেশের বিজয় দিবসে প্রদর্শন করেছে তা রীতিমতো ভয়ংকর ঘটনা। জাতীয় পতাকা একটি দেশের প্রতীক। এই পতাকার জন্য কত মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে, কত নারী তাদের জীবন বাজি রেখেছে, কত তাজা প্রাণ ঝরেছে। এই পতাকার মর্যাদা তাই জাতি হিসেবে, নাগরিক হিসেবে সবার ওপরে। যেকোনো মূল্যেই আমাদের সেই মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে হবে।
জাতীয় পতাকা ব্যবহার বিধিমালা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে পতাকা বিধিমালা প্রণয়ন করে। জাতীয় পতাকার আকার: গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ ও মাঝে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যরে এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধবিশিষ্ট হবে।
ভবনে ব্যবহারের জন্য পতাকার আয়তন: ভবনের ব্যবহারের জন্য পতাকার তিনটি মাপ রয়েছে। প্রথমটির আয়তন হবে দৈর্ঘ্যে ১০ ফুট আর প্রস্থে ৬ ফুট। দ্বিতীয়টির দৈর্ঘ্য ৫ ফুট আর প্রস্থ ৩ ফুট এবং তৃতীয়টি দৈর্ঘ্য ২ ফুট আর প্রস্থ ১ ফুট। গাড়িতে ব্যবহারের জন্য পতাকার আয়তন: গাড়িতে ব্যবহারের জন্য মাপ হচ্ছে, বড় গাড়ির জন্য ১৫:৯ এবং ১০:৬ ( ছোট ও মাঝারি গাড়ির জন্য)। তবে ইচ্ছা করলেই সবাই গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারবে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আরোপিত কোনো শর্তাবলি (যদি থাকে) ও লিখিত অনুমোদন ব্যতীত, কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্বোধন, পেশা বা অন্য যেকোনো উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের ‘পতাকা’ কোনো ট্রেড মার্ক, ডিজাইন, শিরোনাম অথবা কোনো প্যাটেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ব্যতীত, ‘জাতীয় পতাকা’ অর্ধনমিত করা যাবে না, তবে শর্ত থাকে যে, বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান (যে দেশের নিকট তিনি আস্থাভাজন) ইচ্ছা করলে ওই সব দিবসে ‘পতাকা’ অর্ধনমিত রাখতে পারবেন, যেসব দিবসে উক্ত দেশে, সরকারিভাবে ‘পতাকা’ অর্ধনমিত রাখা হয়।
তাই জাতীয় পতাকা ব্যবহারে যথার্থ বিধিমালা মেনে চলা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। এক্ষেত্রে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সব শিক্ষকদের আইনীভাবে শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
-লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh