বিজয়ের ৪৯ বছর: শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিলো। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক, গায়ক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী ও কলা-কুশলীবৃন্দ যে বিরাট অবদান রেখেছেন তার উল্লেখ না করলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসমাপ্ত থেকে যাবে।

৩০শে মার্চ চট্টগ্রামে আমাদের বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ছোট্ট একটি ট্রান্সমিটার অনেক চেষ্টায় অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতের আগরতলার নিকট কর্ণেল চৌমোহনীতে ছোট্ট ট্রান্সমিটারটি দিয়ে আমরা একটা নতুন বেতার কেন্দ্র পুনরায় চালু করেছিলাম। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এক কিলোওয়াট শক্তির এই ট্রান্সমিটারটি অনুষ্ঠান প্রচার করে; কিন্তু এর শক্তি ছিলো খুবই কম। কেবল মাত্র কুমিল্লার সীমান্ত এলাকার নোয়াখালী ও সিলেটের অংশ বিশেষ ছাড়া আর কোথাও অনুষ্ঠান শোনা যেতো না। 

এদিকে আমাদের সরকার একটা শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের জন্য ভারতের সংগে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার ফলশ্রুতিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ৫০ কিলোওয়াটের একটি ট্রান্সমিটারের ব্যবস্থা করেন এবং এটি ২৩শে মে তারিখের মধ্যে মুজিব নগরে স্থাপন করা হয়। কিন্তু শুধু ট্রান্সমিটার পেলেই তো চলবে না, প্রচারের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত অনুষ্ঠানমালা, তাছাড়া এর জন্য অন্যান্য অনেক আয়োজনও দরকার ছিলো। আমাদের কোন রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি ছিল না। টেপ কিংবা ট্রান্সমিশনের অন্যান্য সাজসরঞ্জামও ছিলো না। 

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে কক্ষটিতে বাস করতেন তার পাশেই ছোট্ট একটি কুঠুরিকে স্টুডিওতে রূপান্তরিত করা হয়। রেকর্ডিংয়ের জন্য দরকারি জিনিসপত্রের একটি তালিকা তৈরি করে পরিষদ সদস্য জনাব মান্নানের হাতে দেয়া হয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। বস্তুতঃ একেবারে শূন্য থেকেই সবকিছু শুরু করা হয়েছিলো।

২৪শে মে বেতারে অনুষ্ঠান প্রচারের প্রস্তুতি শুরু হয়। শুরু হয়েছিল শুধু একটি রেকর্ডিং মেশিন এবং একটি মাইক্রোফোন দিয়ে। সে দিন রাত চারটা পর্যন্ত খেটে তিনটি অধিবেশনের জন্য অনুষ্ঠান সূচী তৈরী করা হয়। তারপর ২৫শে মে মুজিবনগর থেকে বাঙালীদের এবং বিশ্ববাসীর জন্য ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। অনুষ্ঠানের প্রথমে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের প্রতি অভিবাদন জানানো হয়, অভিবাদন জানানো হয় বিশ্বের সকল মানুষের প্রতি- যাঁরা বাঙালীদের সংগ্রামে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ২৫ শে মে এই অনুষ্ঠান প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীদের নিজস্ব বেতার কেন্দ্র লাভের দীর্ঘ দিনের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।

মুজিবনগর বেতার কেন্দ্র থেকে সার্থক অনুষ্ঠান প্রচার করার জন্য যেসব বাঙালী দিনের পর দিন কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন প্রেস সেক্রেটারী আমিনুল হক বাদশা, টি.এইচ. সিকদার, আশফাকুর রহমান, শহীদুল ইসলাম, তাহের সুলতান, সামসুল হুদা, মাহবুব উদ্দিন, নজরুল, সুকুমার বিশ্বাস প্রমুখের নাম করতে হয়। এদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন মুস্তাফা আনোয়ার, আবদুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, আবদুস শুকুর এবং বেতার প্রকৌশলী সৈয়দ আবদুস শাকের, রাশেদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, এ এম শফিকুজ্জামান, রেজাউল করিম, কাজী হাবিবুল্লাহ প্রমুখ।

এই শেষের দলের ব্যক্তিরাই কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, কালুরঘাট কেন্দ্র থেকে ২৬শে মার্চ আমাদের প্রথম অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। মুজিবনগর বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত প্রতিদিনের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে ছিল-

১. অগ্নিশিখা (মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান)

২. রক্তস্বাক্ষর (একটি জাতীয়তাবাদী সাহিত্য আসর)

৩. বজ্রকণ্ঠ (শেখ মুজিবুর রহমানের টেপ করা বক্তৃতা, বিশেষ করে ৭ই মার্চের বক্তৃতাটি বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস ছিল)

৪. দর্পণ (একটি বিশ্লেষণমূলক অনুষ্ঠান)

৫. জাগরণী (জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবী সংগীতানুষ্ঠান)

৬. ঐকতান (সংগীতানুষ্ঠান)

৭. চরম পত্র (একটি ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক অনুষ্ঠান। পাকসেনাদের মনোবল ভাঙার জন্য তাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হতো এই অনুষ্ঠানে)

৮. বহির্বিশ্ব এবং বিদেশী নাগরিকদের জন্য বিশেষ ইংরেজী অনুষ্ঠান। 

৯. ইংরেজী খবর

১০. বাংলা খবর

১১. বিশ্ব জনমত (আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন বিদেশী পত্র পত্রিকা এবং প্রখ্যাত বিশ্ব নেতৃবর্গের মতামত)

পবিত্র কোরান তেলওয়াতের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন সকালের অনুষ্ঠান শুরু হতো। হিন্দুদের জন্য গীতা এবং বৌদ্ধদের জন্য ত্রিপিটক পাঠের ব্যবস্থা হয়েছিলো সপ্তাহে দুবার।

বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই সব অনুষ্ঠানগুলি ছিলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই বিরাট সাফল্যের পেছনে রয়েছে বাঙালী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, কবি, গায়ক, সংগীত শিল্পী, চিত্র শিল্পী এবং বেতার কেন্দ্রের কলাকুশলী ও কর্মচারীদের কঠোর পরিশ্রম, নিরলস প্রচেষ্টা এবং অকৃত্রিম দেশপ্রেম। সৈয়দ আলী আহসান, শওকত ওসমান, রণেশ দাশ গুপ্ত, ড. আনিসুজ্জামান, ড. মযহারুল ইসলাম, ড. এ.আর মল্লিক, ড. সারোয়ার মোর্শেদ, সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, ড. অজয় রায়, অধ্যাপক আবদুল হাফিজ, ফয়েজ আহমদ, গাজী-উল-হক, জহির রায়হান, সিকানদার আবু জাফর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আবদুল তোয়াব খান, মহাদেব সাহা, ড. মাহমুদ-উল-ইসলাম, মাহবুব তালুকদার, উম্মে কুলসুম, নাসিমা চৌধুরী, নওয়াজেস হোসেন, আসাদ চৌধুরী, সুকুমার বিশ্বাস, নির্মলেন্দু গুন, বদরুল হাসান এবং আরো অনেকের অবদান সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তাঁরা নিবন্ধ, গল্প, নাটক, ককিতা ও গান রচনা করে- গান গেয়ে জনগণকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছেন- অনুপ্রাণিত করেছেন শত্রুকে পর্যুদস্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে।

এমনকি চিত্র শিল্পীরাও বসে ছিলেন না। তাঁদের অনুপ্রেরণা মূলক চিত্রকর্ম মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম প্রেরণা জুগিয়েছিলো। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামের ছবি এঁকেছেন- এঁকেছেন গেরিলা পরিবেষ্টিত হয়ে আর পালাবার পথ না পাওয়া পাক সেনাদের দুর্দশার চিত্র। চিত্রশিল্পীদের মধ্যে কামরুল হাসান, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ড, নাজির আহমেদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের মধ্যে কামরুল হাসানের ‘নরপশু ইয়াহিয়ার’ সেই অসাধারণ চিত্রটির কথা কখনো ভোলা যাবে না।

সংগীতে সেদিন যারা কণ্ঠ দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন আবদুল জব্বার, সমর দাস, আপেল মাহমুদ, অজিত রায়, রথীন রায়, কাদেরী কিবরিয়া, রফিকুল আলম, এম.এ. মান্নান, মান্নান হক, স্বপ্না রায়, কল্যাণী ঘোষ, আলোকময় নাহা, প্রবাল চৌধুরী, অরূপ রতন চৌধুরী, সুকুমার বিশ্বাস, উমা চৌধুরী প্রমুখ। দেশের প্রতি ও জাতির সংগ্রামের প্রতি প্রাণের দরদ দিয়ে গাওয়া দেশাত্মবোধক গানগুলো সেদিন এ দেশের মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করেছিলো। এই গানগুলো যখনই মানুষ স্মরণ করবে তখনই তাদের মনে পড়বে এসব গানের নেপথ্য শিল্পীদের কথা।

হাসান ইমাম, সুভাষ দত্ত, সুমিতা দেবী, রাজু আহমদ, নারায়ণ ঘোষ, মাধুরী চক্রবর্তী, প্রসেনজিৎ বোস, আজমল হুদা মিঠু প্রমুখ ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত নাট্য শিল্পী। কল্যাণমিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’ নামক ধারাবাহিক নাট্যানুষ্ঠানটিও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিলো। বেতারের অনুষ্ঠানমালা সাফল্যের সাথে প্রযোজনা করেছেন আলী যাকের, আলমগীর কবির, মুস্তফা মনোয়ার, তাহের সুলতান, এম. আর. আখতার (মুকুল), কামাল লোহানী প্রমুখ। ইংরেজী সংবাদ পাঠে প্রশংসা লাভ করেছেন- মিসেস পারভীন হোসেন এবং নাসরিন আহমদ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে কুড়িটিরও বেশি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো। এইসব পত্রিকার কতগুলো প্রেসে ছেপে, কতগুলো সাইক্লোষ্টাইল কপি করে, আবার কতগুলো শুধু হাতে লিখে বিতরণ করা হতো। প্রকাশের ভঙ্গি যা-ই হোক, সবগুলোরই আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিলো অভিন্ন- শত্রুর বিরুদ্ধে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করা।

(বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম রচিত ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে- এ টেল অব মিলিয়নস’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //