শিক্ষা ব্যবস্থার সংগতি-অসংগতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাসমস্যা নিয়ে লিখেছেন ‘ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাষ্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘন্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটার সময় কারখানা বন্ধ হয় মাস্টার কলও তখন মুখ বন্ধ করেন; ছাত্ররা দুই-চার পাতা কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্ক পড়িয়া যায়।’ 

সেখানে না আছে কোনো আনন্দ, না আছে আকর্ষণ। বরং ভিতিকর অবস্থাটাই কাজ করে ভেতরে ভেতরে।

এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষারূপী কারখানার প্রতি প্রবল নেতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন। সে যাই হোক, করোনাভাইরাসের করাল গ্রাসে এখন কারখানাটি বন্ধ, দেশে বিদেশে সবখানেই। স্কুলবিদ্বেষী কবি বেঁচে থাকলে এতে নিশ্চয়ই মনে মনে আনন্দ পেতেন। এ রকম স্কুলের প্রতি তিনি একরকম বিদ্রোহই ঘোষণা করেছিলেন। তার সঙ্গতি ছিল, তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বোলপুর শান্তিনিকেতনে উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির সহচার্যে, আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের শিক্ষা দান। 

সন্দেহ নেই যে, কভিড-১৯ নামের এই অচেনা শত্রুর আক্রমণে আমাদের জীবন থেকে বাদ দিতে হয়েছে অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়। বিশ্বজুড়ে মানবসমাজ ভয়ংকর মানসিক চাপে রয়েছেন। বিশ্বায়নের এই যুগে লঘু-গুরু, ইতিবাচক-নেতিবাচক বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা কমবেশি প্রত্যেকেই জানি; কিন্তু সচেতন কিনা সেটা বলা মুশকিল। করোনাভাইরাসের আগ্রাসী থাবার শুরুতেই লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা পড়ে এক অনাকাক্ষিত দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে। সেখান থেকে কোনো রকমে উঠে আসার জন্য বিকল্প পথ বেছে নিতে হয়। বিকল্প পথটি হচ্ছে- অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা। অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করতে প্রয়োজন অতি-আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। 

যে দেশে গণশিক্ষা হারের পরিসংখ্যান অতিসামান্য, সেখানে ই-লার্নিংয়ের প্রচেষ্টা আদৌ সফল হওয়া কী সম্ভব? যদিও বলা হচ্ছে সবার জন্য শিক্ষা- মৌলিক অধিকার। এই হাইটেক সময়েও প্রযুক্তির সংসর্গ থেকে বহু শিক্ষার্থীই আজও বঞ্চিত। শহরের চশমা আটা চোখ দিয়ে বিচার করলে হয়তো সাময়িক আত্মতুষ্টি কিংবা আধুনিক প্রগতির এক ধারাবাহিক রেখাচিত্র পাওয়া যাবে; কিন্তু তার মাধ্যমে বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি সাম্য এবং প্রতিসাম্যের বিষয়গুলো অবলোকন করা মুশকিল। 

দেখতেই পাচ্ছি, এ সময়ে দাঁড়িয়ে রাজনীতি থেকে সমাজ, অর্থনীতি এমনকী শিক্ষা পরিসরেও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাবে আমাদের মানসিকতায়, জীবনযাত্রায় এসেছে বহুবিধ পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের সমান্তরালে ঘটে চলছে এক অসম প্রতিযোগিতা। প্রযুক্তি যেমন আমাদের একে অন্যের কাছাকাছি করেছে, করেছে দূরকে কাছে। অপরদিকে সেই প্রযুক্তিকে হাতের নাগালে না পেয়ে যে দূরে আছে, সে আরো দূরে সরে যাচ্ছে।

প্রায় প্রতিদিনই কিছু শিক্ষার্থীর কাছ থেকে হৃদয় ভারাক্রান্ত টেলিফোন পাই। দূরালাপনে ভেসে আসে হতাশার বাষ্পে ভেজা তাদের কণ্ঠস্বর। আমার তো স্মার্টফোন নেই। যার আছে সে বলছে আমার এখানে তো কোনো ইন্টারনেট নেই। আমরা তো শিক্ষকের কোনো লেকচারই শুনতে পাচ্ছি না। তবে আমাদের সিলেবাস শেষ হওয়ার কী হবে? যাদের এসব আছে আমরা তো তাদের থেকে পিছিয়ে পড়ছি। তাহলে আমাদের ভবিষৎ কী? মেধা কী তাহলে স্থবির হয়ে থাকবে? এ রকম শত শত প্রশ্নের পাহাড়।

সত্যিই তো কোনো প্রশ্নই অমূলক নয়। শিক্ষার্থীদের এক অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে ফেলা হয়েছে। তৈরি হচ্ছে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। কী উত্তর আছে এসব প্রশ্নের! পরীক্ষা না দিয়েই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ফলাফলও দিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানেও প্রশ্নের অন্ত নেই। প্রশ্ন হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও তছনছ করে দিচ্ছে।

করোনাভাইরাসে মহামারির কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৩ শিক্ষার্র্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দিক থেকে ভাবলে সহজেই অনুমেয় এই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে অধিকাংশই ঝরে যাবে, যাদের পক্ষে আর কোনোদিনই বিদ্যালয়ে ফেরা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে কন্যাশিশু, যারা বাল্যবিবাহের স্বীকার হয়েছে বা হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ‘মহামারির আগেই আমরা শিক্ষা সংকটের মুখোমুখি হয়েছি। এখন প্রজন্মের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছি, যা মানুষের সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করতে পারে। কয়েক দশকের অগ্রগতি বিনষ্ট করতে পারে এবং সমাজের বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে।’

একশ’ বছর আগের ইতিহাস বলছে প্রাণঘাতী রোগ যক্ষ্মার কারণে শিশুদের শিক্ষা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছিল। একশ’ বছর আগের একই পরিস্থিতির মুখে আজকের বিশ্ব। প্রাণঘাতী করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা একবারেই ভেঙে পড়েছে। সংক্রমণের আশঙ্কায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে আজ। প্রতিষেধক টিকা কবে পাওয়া যাবে, সেই অনিশ্চয়তায় বসে থেকে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান শিক্ষাবর্ষ যাতে নষ্ট না হয় সেই জন্য অনলাইন শিক্ষার কথা চিন্তা করা হয়েছে।

একশ’ বছর আগের বিশ্ব আর আজকের বিশ্বের মধ্যে ফারাক আকাশ-পাতাল। যদিও সেদিন মানুষ ঘরবন্দি থেকেছে সংক্রমণের ভয়ে। আজও মানুষ ঘরবন্দি সেই একই ভয়ে। পার্থক্য সেদিন কারও হাতে কোনো স্মার্ট ফোন ছিল না, ছিল না কোনো ইন্টারনেট ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দুর্লভ। আজ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ঘরে বসেই জীবনযাত্রা সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে। সে সময় শিক্ষার্থীদের জন্য খোলা মাঠে স্কুল ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা হয়েছিল। আর আজ আমরা চিন্তা করছি ঘরে বসে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে অনলাইনের মাধ্যমে; কিন্তু কতটুকু সংগতি আছে আমাদের! আজ পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে কী অনলাইন শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে?

শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ১৯০৪ সালে প্রথম জার্মান ও বেলজিয়াম চালু করেছিল খোলা মাঠের স্কুল। সেই ধারণা অল্প দিনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অনেক দেশে। খোলা চত্বরে, উঁচু ভবনের ছাদে এমনকি পরিত্যক্ত নৌকায় স্কুল চালু হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল খোলামেলা পরিবেশে রেখে মানসিক গঠনের পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক উন্নতি ঘটানো। এ ধরনের স্কুলগুলো গড়ে উঠেছিল দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। শিক্ষা নিয়ে তখন নানা গবেষণা চলছিল। ‘শিক্ষকরা প্রথাগত শিক্ষার কাঠামো ভেঙে এমন স্কুল গড়ার চিন্তা-ভাবনা করছিলেন- যার লক্ষ্য হবে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে গণতন্ত্র চর্চায় উৎসাহ দেয়া, যাতে একটা শান্তিকামী এবং পারস্পারিক সহযোগিতা করার মানসিকতা নিয়ে একটা প্রজন্ম তৈরি হয়।’

বিবিসি নিউজ ব্রাজিলের সাংবাদিক পলা অ্যাডামো আইডোটার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের কাশ্মীরে উন্মুক্ত স্থনে পাঠদান ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে। সেখানে হিমালয়ের বরফ ঢাকা পাহাড়ি পরিবেশে খোলা জায়গায় স্কুলে শিশুরা লেখাপড়া করছে। সিঙ্গাপুরে বহু বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে লেখাপড়া শেখানোর চল রয়েছে। দেশটি শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে তোলার জন্য খোলা জায়গায় পাঠদানে সাফল্য পেয়েছে। ফিনল্যান্ডে জঙ্গলে স্কুল বেশ জনপ্রিয়। দেশটিতে বনেজঙ্গলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে লেখাপড়া শেখার সংস্কৃতি বহুদিনের। ডেনমার্কেও উন্মুক্ত স্থানে বিশেষ দিনে ক্লাস করার প্রথা চালু রয়েছে। ডেনমার্কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকরোনার মধ্যে তাদের এই সংস্কৃতিকে আরো উৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

কবে নাগাদ আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারব তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে শিক্ষা নিয়ে যারা বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করছেন, সেই সব বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন করোনা যতদিন আমাদের সঙ্গে আছে, ততদিন শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের বিষয়টি চিন্তা করে দেখা যেতে পারে।

লেখক: শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস, টাঙ্গাইল

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //