বিশ্ববিদ্যালয় ও অপ্রিয় সত্য

সদ্য প্রয়াত হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হিমেল বরকত। কবিতা ও গবেষণায় তিনি দারুণ পারঙ্গম এক প্রতিভা। সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই। তাঁকে ঘিরে আমাদের অজস্র স্মৃতি। সেই স্মৃতির সবই মধুর। কিন্তু অপ্রিয় কিছু সত্যও লুকিয়ে আছে, যা তাঁর ব্যক্তিজীবন ও পেশাগত জীবনকে নিরানন্দ ও বেদনাদায়ক করে তুলেছিল। আমি সেই সত্যগুলোর কয়েকটি বলতে চাই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেতরমহল কতোটা নির্মম, অনৈতিক ও অন্তঃসারশূন্য তা বুঝতে এই সত্যসমূহ জানা দরকার।

১.
যে যোগ্যতা নিয়ে হিমেল বরকত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলেন, তার চেয়ে সম যোগত্যাসম্মন্ন ব্যক্তিবর্গকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হলেও হিমেল বরকতের নিয়োগের সময় নানা রকম তালবাহানা ও অপপ্রচার করা হয়েছিল– যাতে করে তাঁর নিয়োগ না হয়। সে সময় হিমেল বরকত বিস্মিত এবং বিষণ্ণ হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে হিমেল তাঁর সদৃপ্ত পদক্ষেপে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন তিনি শিক্ষক হিসেবে কতোটা জ্ঞানমুখী ও শিক্ষার্থীবান্ধব; শ্রেণিকক্ষের বাইরে চা-সিঙাড়া খাইয়ে শিক্ষার্থীদের হৃদয়-জয় করার অপচেষ্টা করতে হয় নি তাঁকে। শিক্ষার্থীবান্ধব বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার সময় তাঁকে নানা ধরনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে।

২.
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত পরীক্ষা ও মূল্যায়ন-পদ্ধতি সম্পর্কে হিমেল বরকত বিভিন্ন সময় সমালোচনামূলক বক্তব্য রেখেছেন। রাজনীতিকীকরণের ফলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিমূল দুর্বল হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তাঁর আক্ষেপ ছিলো। মেধাবী শিক্ষার্থী ও ভালো ফলাফলধারী শিক্ষার্থী নির্ণয় করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা যে গভীরতরভাবে অন্তরায়- একথা তিনি বহুবার বলেছেন। বৈশ্যবিদ্যালয় নামে একটি কবিতার বইয়ে এ বিষয়ে নিজের মতও উপস্থাপন করেছেন। এই বইভুক্ত কবিতাগুলো লেখার জন্যও তিনি কারো কারো গুপ্ত রোষের শিকার হয়েছিলেন।

৩.
শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে হিমেল ভাবতেন; যে কারণে রবীন্দ্রনাথের ‘তোতাকাহিনি’কে গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তচিন্তা, সহনশীলতা ও মানবিক বিদ্যাচর্চার কথা ভাবতেন তিনি। উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের নামে বিগত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমা ফর্মুলায় হেকেপ নামে যে ধরনের উন্নয়নমূলক গবেষণা-প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে, তার ঘোরবিরোধী ছিলেন হিমেল। কারণ এইসব প্রকল্প বিদ্যায়তনের চাকচিক্য বাড়ালেও শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে পারে নি। তার প্রমাণ বিভিন্ন রেটিঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান না-থাকা বা পিছিয়ে পড়া।

৪.
অপ্রিয় সত্য এই যে, হিমেল বরকতের পদোন্নতি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে, তাহলে মনে পড়ছে, সহযোগী অধ্যাপক পদে তাঁর পদোন্নতির তারিখ পেছানো হয়েছিল তিন থেকে চার বার। এর শিকার হয়েছিলেন তাঁর সমমনা আরো কয়েকজন শিক্ষক। গ্রহণযোগ্য কোনো যৌক্তিক কারণ এসবের পেছনে ছিলো না। রাজনৈতিক আনুগত্য, ক্ষমতাচর্চা ও রাজনীতিকীকরণের বিরুদ্ধে থাকায় তাঁর পদোন্নতি ব্যাহত হয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগের যেকোনো ইট-কাঠ-চেয়ার-টেবিলকে জিজ্ঞেস করলেও জবাব দেবে : বিভাগের জন্য কল্যাণকর কর্মকাণ্ডে হিমেলের কতোখানি ভূমিকা ছিলো।

অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিক– সকল ধরনের কাজে তাঁর অংশগ্রহণ ছিলো সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল। কিন্তু রাজনৈতিক কলুষের কারণে চাকরিজীবনে প্রাপ্য বৈধ সুযোগগুলোও হিমেল যথাসময়ে যথার্থভাবে পান নি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী’ প্রশাসন হিমেলকে দমিয়ে রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। অথচ হিমেল ‘মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ’-এর বিরুদ্ধ পক্ষীয় কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। যৌক্তিক আন্দোলনে যৌক্তিক বিষয়ে কথা বলতেন মাত্র।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুপ্রিয় শব্দবন্ধ- ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী কোনো অবস্থান তাঁর ছিলো না। উল্লেখ্য যে, মাস দুয়েক আগেও জাতীয় পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধ ও পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত একটি সম্পাদনামূলক কাজে অংশ নিয়েছিলেন তিনি, যার সঙ্গে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মণি এবং মাননীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তাঁর বেশ কিছু প্রস্তাব সমর্থন করেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় মাননীয় মন্ত্রিবৃন্দ অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হিমেলের পরিচিতি নির্মাণ করা হয়েছে ‘প্রশাসনবিরোধী’, ‘সরকারবিরোধী’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতানা’র সঙ্গে খাপ খায় না ইত্যাদি; আরো অধিক পরিচিতি ছিলো হিমেল ‘বাম’; যেন বামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশে খাপ-খায় না। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধব্যবসায়ীরা হিমেলকে বারবার প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে।

৫.
অপ্রিয় সত্য এই যে, পদোন্নতিকেন্দ্রিক একটি মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন– যদিও তা বর্তমান প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই করা; কিন্তু সে মামলার কার্যকারণ থেকে হিমেল কোনোভাবেই বিচ্যুত নন। অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ব্যাপারে তাঁকে বিতর্কিত করা হয়েছিল। এ বিষয়ে স্ক্যান্ডাল-ব্যবসায়ী তৃতীয় শ্রেণির কিছু ওয়েব পোর্টালে বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছিল। আমার অনুমান সাংবাদিকতার নামে প্রকাশিত ওই পোর্টালগুলোর নামচিহ্নও সম্ভবত কেউ শোনেন নি, দেখেনে নি। আদতে হিমেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল।

সুমন সাজ্জাদ।


পদোন্নতি বিষয়ক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভুলে যাওয়া হয়েছিল, বিভাগের বারান্দা থেকে শুরু করে অফিস ও শ্রেণিকক্ষ পর্যন্ত হিমেল তাঁর কাজের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বিভাগের শিক্ষার্থী-সংসদ, পাঠক্রম, গবেষণা-পত্রিকা, অন্যান্য প্রকাশনায় তাঁর দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ অন্য যে কারো চেয়েই ছিলো বেশি; এই সত্য যিনি অস্বীকার করবেন, তিনি সত্যভ্রষ্ট। অন্য অনেকের মতো আলংকারিক সদস্য হিসেবে কোনো কাজ তিনি করতেন না, নামের কাঙাল তিনি ছিলেন না, একই কমিটিতে থেকে অন্য সবার চেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতেন; কারণ কাজকে তিনি দায়িত্ব মনে করতেন। তাই একই দাঁড়িপাল্লা দিয়ে হিমেল ও অন্যদের এক সঙ্গে মাপা যায় না, মাপা ন্যায়সঙ্গত নয়।

পদোন্নতি বিষয়ক অস্থিতিশীলতায় আমি হিমেলকে বিষণ্ণ ও মর্মাহত হতে দেখেছি; মামলার মতো ঘটনাকে তিনি মানতে পারেন নি। স্বভাবে অন্তর্মুখী ছিলেন বলে সহজে কাউকে কিছু বলেনও নি। কিন্তু আমার জানা মতে, রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তাঁর চেনাজানা লোকের অভাব ছিলো না। সমকালীন বাংলাদেশের প্রচলিত প্রথা মেনে চাইলেই তিনি সেসব ‘ক্ষমতা’ ব্যবহার করে সকল কিছুর ‘ঠাণ্ডা’ সুরাহা করতে পারতেন। তিনি তা করেন নি। কারণ তিনি তা করতে চান নি। তিনি চেয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বিধান ও নিয়ম মেনে বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়ে যাক।

আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, সামগ্রিকভাবে হিমেল গভীর অসন্তুষ্টি নিয়ে বিগত হয়েছেন। আমি তাঁকে সাধারণত হতাশ হতে দেখি নি; কিন্তু গত দেড়-দুই বছরে পেশাজীবন নিয়ে তাঁর মধ্যে চূড়ান্ত হতাশা তৈরি হতে দেখেছি আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত অপরাজনীতির অন্তর্ঘাত তাঁর সৃষ্টিশীল ও মননশীল চর্চাকে স্থবির করে দিতে চেয়েছিল। আশার কথা ছিলো, কয়েক মাস ধরে তিনি লেখালেখির সচল জীবনে ফিরে এসেছিলেন। অনেক অনেক অসমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত ও সমাপ্ত কাজের হদিস এরই মধ্যে পেয়ে গেছি আমরা। আমাদের দুর্ভাগ্য, মৃত্যু এসে তাঁকে গ্রাস করে নিয়ে গেলো।

হিমেলের মৃত্যু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু শেখার আছে। অবশ্য সে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করবে কিনা সন্দেহ! শিক্ষাটা এই : যার যা প্রাপ্য, তাকে তা-ই দেয়া হোক। যার যা প্রাপ্য নয়, তাকে সেই আসন দিলে বাকি সব আসনও নিজের মনে করতে আরম্ভ করে দেয়, নিজেকে সব কিছুর জন্য যোগ্যতম মনে করার মানসিকতা পেয়ে বসে, অন্য অনেক মেধাবীকে ডিঙিয়ে শীর্ষতম স্থানে নিজেকে দেখার ‘হিটলারি’ মনোবিকার চেপে বসে কারো কারো মনে। হিমেল নিজের যোগ্যতা ও মেধার অতিরিক্ত কোনো কিছু দাবি বা প্রত্যাশা করেন নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি পর্ব তাঁর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। সেই পর্বটি যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা সব কিছু জানেন। এখন হয়তো হিমেলকে নিয়ে অনেকের দীর্ঘশ্বাস শোনা যাবে, কিন্তু মরার পর মনুমেন্ট গড়ে লাভ কী, যদি মৃত্যুর আগে প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা না দিতে জানি!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //