বিজয়ের ৪৯ বছর: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

আনত মস্তকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আমাদের প্রাণপ্রিয় জেঠামণি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মদানকারী সব শহীদের প্রতি। 

নানা সংগ্রামের পথ পেরিয়ে এলো ’৬৯-এর গণআন্দোলন। সে আন্দেলনেই বুঝতে পেরেছিলাম এবার নিশ্চয়ই চূড়ান্ত পথের দিকে হাঁটতে হবে। বাস্তবে হলোও তা-ই। 

’৬৫ সাল থেকেই রণদা প্রসাদের ব্যবসা খুবই মন্দা যাচ্ছিল। বহু কষ্টে তিনি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এলো ’৭০-এর নির্বাচন। বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিল জেঠামণির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু দাদা সম্বোধন করতেন তাকে। যখনই প্রয়োজন হয়েছে জেঠামণি বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে সে কথা লিখতে ভোলেননি। তার নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। নারায়ণগঞ্জ কুমুদিনীতে সকলে মিলে খাওয়া-দাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বৌদি শ্রীমতী কিরণ বালা সাহার আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়েছিলেন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল জণগণের অপার ভালোবাসা নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দেশের মানুষ আশা করেছিল এবার পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের, শোষণের অবসান হবে; কিন্তু সে যেন অলিক স্বপ্ন হয়ে রইল আমাদের কাছে! শুনলাম বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক।

তারপর এলো সেই কালরাত। ’৭১-এর ২৫ মার্চ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি। নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দৃঢ় শপথ তখন প্রতিটি হৃদয়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করল তাদের অভিযান- বাঙালি নিধন। বাঙালিরাও বাধা দিল। বাঁধলো লড়াই। যুদ্ধক্ষেত্র ছড়িয়ে পড়ল সারা বাংলায়। বাঙালির রক্তে বাংলার মাটি রঙিন হতে থাকল। এ জনযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ল গোটা জাতি। রণদা প্রসাদ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় এগিয়ে এলেন। কুমুদিনী হাসপাতাল উন্মুক্ত রইল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। রণদা প্রসাদ সাহা আজীবন আর্তের সেবায়, মানবতার জন্যই তো নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। এ সময়ে প্রথমেই শুরু হলো দেশত্যাগের হিড়িক। বহু মানুষ শরণার্থী হয়ে চলে যাচ্ছেন ভারতে। রণদা প্রসাদ সাহাকেও দেশত্যাগ করার জন্য শুভাকাক্ষীরা অনুরোধ করেন, বলেন তার মতো মানুষের বেঁচে থাকার খুবই প্রয়োজন; কিন্তু তিনি ব্যাপারটি সেভাবে দেখলেন না। এসব শুনে তিনি এক রকম রেগে গিয়েই বললেন, ‘জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় যাব? আমি তো কারও ক্ষতি করিনি। আমাকে কেউ মারবে না।’

প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল রণদা প্রসাদ সাহার; কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি এই পরার্থে সর্বস্বত্যাগী মানুষেরও প্রতিপক্ষ থাকে, শত্রু  থাকে। রণদা প্রসাদ সাহা জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে চাইলে যেতে পারতেন ১৯৪৭ সালে, দেশভাগের পরই। সেখানেও তার সম্মান কিছু কম জুটতো না; কিন্তু তিনি থেকে গেলেন মাটি কামড়ে দেশেরমানুষের সাথে। একাত্তরের সেই ভয়াল দিনগুলোয় কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস, টাঙ্গাইলে কুমুদিনী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ- সর্বোপরি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের শত শত প্রিয়জনদের মৃত্যুর মুখে রেখে দেশত্যাগ তার পক্ষে অকল্পনীয় ছিল। 

জীবনকে বাজি রেখে এমনই এক কঠিন পরিস্থিতিতে রণদা প্রসাদ হানাদার বাহিনীর নজর এড়িয়ে সাহায্য করছিলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। সাধারণ রোগীর ছদ্মবেশে আহত মুক্তিযোদ্ধারা আসত কুমুদিনী হাসপাতালে। পেত চিকিৎসা, ওষুধ-পথ্য ও অর্থ। এ ব্যাপারটি অবশ্য বেশিদিন গোপন থাকেনি। রাজাকার-আলবদরদের চেষ্টায় এক সময় ফাঁস হয়ে যায় সব কিছু। যারা একদিন কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা পেয়েছিল বিনামূল্যে, পেয়েছিল নতুন জীবন, আজ তারাই হয়ে দাঁড়ালো তার চরম শত্রু।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হানাদার বাহিনী মির্জাপুরের আশপাশের গ্রামের নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচার চালালেও গ্রামটি তখন পর্যন্ত শান্ত ছিল। ঢাকা-মির্জাপুর সড়কটি ছিল বেশ উন্নত। পাকিস্তান আর্মি খুব সহজেই মির্জাপুরে এসে থানার মাঠে তাঁবু গাড়ে। প্রথমেই তারা কুমুদিনী হাসপাতালে আসে। সাহসী ও দক্ষ প্রশাসক ডাক্তার হাফিজুর রহমান ছিলেন মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট। আমি তখন ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষ। প্রথম দিন ডা. হাফিজুর রহমানের সাথে ক্যাপ্টেন আইয়ুবের কথা হয়। সে এখানকার হিন্দুদের অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয় আলোচনা করে হাসপাতাল চত্বর ছেড়ে কাউকে বাইরে না যাওয়ার হুকুম দেয়। রণদাকন্যা জয়াপতি ডাক্তারসহ তাদের সাথে কোনো অসহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। হাসপাতালের রোগী ও ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীদের স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেসব ছাত্রী সেই সময়ে বাড়িতে যেতে পারেনি, তাদের সাথে অসীম সাহস নিয়ে হোস্টেলে অতি গোপনে ছিলেন কিছু শিক্ষয়িত্রী। এই ছাত্রী-শিক্ষকরা হাসপাতালে অতিগোপনে চিকিৎসার্থে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করা খাবার ও তৈরি করা উলের পোশাক সরবরাহ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের এভাবে সম্পৃক্ত করায় তাদের জন্য প্রতিষ্ঠান আজও গর্ববোধ করে।

পুত্র ভবানী প্রসাদ (রবি), পুত্রবধূ শ্রীমতী সাহা ও তাদের আড়াই বছরের ছেলে রাজীবসহ রণদাপ্রসাদ থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। সপ্তাাহান্তে তারা মির্জাপুর আসতেন। এদিকে সেপাইরা কুমুদিনী চত্বরে এসে প্রতিদিনই ভয়ভীতি দেখাত। ২৯ এপ্রিল পুত্রসহ রণদা প্রসাদকে হানাদার বাহিনী আটক করে ঢাকা থেকে। ৫ মে তারা ছাড়া পান। মৃত্যুগুহা থেকে ছাড়া পেয়ে পিতা-পুত্র ফিরে যান নারায়ণগঞ্জে। জেঠামণি তখনো এতটুকু ভয় পাননি। কোথাও লুকিয়ে জীবনরক্ষার কথা একবারও ভাবেননি।

৭ মে তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মির্জাপুর থেকে কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জে যান। সাথে পুত্র রবি। ঠিক সেদিনই মির্জাপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রাজাকার ওদুদ মওলানা টাঙ্গাইল থেকে আর্মিদের নিয়ে আসে। দুপুর ২টায় গোটা মির্জাপুর গ্রাম হানাদার বাহিনী ঘিরে ফেলে বাড়িতে বাড়িতে আগুন, লুটতরাজ ও নরহত্যার বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই পৈশাচিক কর্মকাণ্ড। নিরীহ মানুষদের আর্তচিৎকারে মির্জাপুরের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কমপ্লেক্স থেকে হানাদার বাহিনীর দোসররা রাত ১১.৩০ মিনিটে পুত্রসহ রণদাপ্রসাদকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। রণদাপ্রসাদের পরিবার ও মির্জাপুরবাসী দীর্ঘদিন তাদের ফেরার পথ চেয়েছিলেন। ৫ মে ঘাতকদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার ঘটনাতেই হয়তো এই আশাবাদ লুকিয়ে ছিল। 

রণদাপ্রসাদ সাহা যখন পুত্রসহ অপহৃত হলেন, তখন তার বয়স ৭৪ বছর, পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবি ২৭ বছরের। সে তখন ৩ বছর বয়সের এক পুত্রসন্তানের জনক। এই বিপুল, মহৎ উপমাহীন আত্মদান, ত্যাগের এই অসামান্য জয় মানবতার যে অভ্রচূড়া মহিমা শাশ্বত উচ্চশির তুলে রইল- রণদাপ্রসাদ সাহা তো তারই অন্য নাম।

লেখক : পরিচালক, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //