বেসরকারি কলেজ-মাদ্রাসা শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রসঙ্গ

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ এর সংশোধন কার্যক্রম প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে চলমান। ইতোমধ্যে জানা গেছে, উচ্চমাধ্যমিক কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে সহকারী অধ্যাপকের পদ বিলুপ্ত করে সিনিয়র লেকচারার এর একটি পদ তৈরি করা হবে এবং তাদেরকে সহকারী অধ্যাপক এর স্কেল অনুসারে আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হবে।

এক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে, যেহেতু উন্নতবিশ্বে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহকারী অধ্যাপকের পদ নেই এবং বাংলাদেশের সকল সরকারি উচ্চমাধ্যমিক কলেজেও সহকারী অধ্যাপকের পদ নেই, সেহেতু বেসরকারি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ ও মাদ্রাসায় এই পদ থাকা উচিত নয়। বর্তমান বাস্তবতায় এটি মোটেও যুক্তিযুক্ত হবে না। একজন মানুষের জন্য আর্থিক সুবিধা এবং পদবী দুটোই মর্যাদার বিষয়। বিনা কারণে কারো পদবী কেড়ে নেয়া মানেই তাকে অমর্যাদা করা। এটি তারা মেনে নিবে না কোন ভাবেই।

বেতন-ভাতা, পদোন্নতি, বদলি সবই আমাদের মত চলবে আর একটি পদবীর ক্ষেত্রে কেবল উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করা হবে তাও যুক্তিযুক্ত হয়না। সেসব দেশে তো উচ্চমাধ্যমিক স্তর বলতে কিছু নেই। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর এবং দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর হিসেবে বিবেচিত হয়। আমাদের দেশের সরকারি কলেজেও সিনিয়র লেকচারার নামক কোন পদ অফিসিয়ালি আছে বলে আমাদের জানা নেই। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো কোনো সরকারি কলেজে আবার সহকারী অধ্যাপক পোস্টিং দেয়া উদাহরণ আছে।

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি কলেজে সহকারী অধ্যাপকের পদ নেই বলে বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চমাধ্যমিক কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে সহকারী অধ্যাপকের পদ বিলুপ্ত করা হবে যে যুক্তিতে; সেই একই যুক্তিতে তো একথা বলা চলে যে, ডিগ্রী বা তদূর্ধ্ব পর্যায়ের সরকারি কলেজসমূহে যেহেতু সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপকের পদ আছে সেহেতু সে পর্যায়ের বেসরকারি কলেজ ও মাদ্রাসাতেও সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপকের পদ আগে নিশ্চিত করা হোক। তারপরেও যাদেরকে সহকারী অধ্যাপক পদবী দিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের সেই পদবী কেড়ে নেয়া উচিত হবে না কোনোভাবেই। যদি আর্থিক সুবিধা দেয়া যায় তো পদবি বহাল রাখতে এত অনীহা কেন?

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাষক হবার শিক্ষাগত যোগ্যতা তো একই থাকবে। এত যুক্তি থাকার পরেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সহকারী অধ্যাপকের বিদ্যমান পদ বিলুপ্ত করে, শিক্ষকদের সংক্ষুব্ধ করে, শিক্ষাক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরি করে, কার কী লাভ হবে তা বোধগম্য নয়। বেসরকারি শিক্ষকগণের আর্থিক সুবিধা, পদমর্যাদা ও পদোন্নতি কোনোটিই যদি না থাকে তো তারা সুস্থভাবে বেঁচে থাকবেন কিভাবে, কর্মোদ্যমী হবেন কিভাবে? সুস্থ দেহে সুস্থ মন- তৈরি করে শিক্ষার সংজ্ঞা বাস্তবায়ন করবেন কিভাবে? তাঁদের দ্বারা কিভাবে নিশ্চিত হবে মানসম্পন্ন শিক্ষা?

আরো একটি বিষয় জানা গেছে যে, বেসরকারি কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের পদোন্নতিতে দীর্ঘদিন চলে আসা অনুপাত প্রথাটি আর বজায় থাকছে না। সম্ভাব্য পরিবর্তিত নিয়মে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোট প্রভাষকের ৫০ পার্সেন্ট সহকারী অধ্যাপক হওয়ার বিধান করা হচ্ছে। এই সংবাদে খুশি হয়েছেন বেসরকারি কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকগণ। তবে নিশ্চিত করতে হবে, এটিকে যেন আবার ২:১ অনুপাত হয়ে না যায়। যদি তাই হয় তো আবারো জটিলতা তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকবে।

যেমন, দীর্ঘদিন ধরে ৫:২ নীতি অনুসরণ করে মোট (৫+২) ৭ জন প্রভাষক থেকে ২ জনকে সহকারী অধ্যাপক করা হচ্ছে। আসন্ন সংশোধিত নীতিমালায় যদি আগের হিসাব কৌশল অনুসারে ২:১ নীতি প্রণয়ন করা হয় তো মোট (২+১) ৩ জন প্রভাষক থেকে ১ জন সহকারী অধ্যাপক হতে পারবেন। যা মোট শিক্ষক সংখ্যার ৫০% হবে না, ৩৩.৩৩% হবে। এমতাবস্থায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনুপাত প্রথা সম্পূর্ণ বাতিল করে সরকারিদের মতো শুধুমাত্র শতকরা হার প্রবর্তন নিশ্চিত করাই উত্তম। একই কথা বারবার বলছি একারণে যে, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হতে হতে আস্থাহীন হয়ে পড়েছি প্রায়।

সেইসাথে আরো বলছি যে, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা আবশ্যক। তাতে আরো বেশিসংখ্যক প্রভাষক সহকারী অধ্যাপক হতে পারবেন। কোন প্রভাষকের চাকরি ১০-১২ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও যদি ৫০% হিসাবের কারণে সহকারী অধ্যাপক হতে না পারেন তো ৫০% হিসাবের নিয়ম শিথিল করে তাকে পদোন্নতি দেয়া উচিত; যেমনটি অনেক সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রেও করা হয়ে থাকে। একজন প্রভাষক সারাজীবন একই পদে চাকরি করবেন অথবা একটিমাত্র পদোন্নতি পাবেন এমনটি খুবই হতাশাজনক! যেখানে পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা লাভের সম্ভাবনা থাকে না সেখানে কর্মী যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে না, কাজের প্রতি আগ্রহ দেখায় না, উৎকর্ষ সাধনে আন্তরিক থাকে না। তাই শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের জন্যই নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকদের সম্মানজনক পদবী, প্রাপ্য পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা।

মো. রহমত উল্লাহ: কলাম লেখক, সাহিত্যিক এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //