ব্যবসাবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হোক বিজ্ঞানশিক্ষা

বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের দেশ বেশ পিছিয়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রায় সবাই একমত। শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্যই যে এ চর্চা প্রয়োজন, তা নয়। সামগ্রিকভাবে আমাদের ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মন-মানসিকতায় আমূল পরিবর্তনের জন্য সবক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির জন্যও এটি প্রয়োজন। 

অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জীবনযাপন ইত্যাদি বিষয়ে আমরা যেসব ধারণা নিয়ে চলি তার অনেক কিছুই সঠিক, আবার কিছু বিষয় প্রশ্নবিদ্ধ ও কিছু ভ্রান্ত। তবে ভ্রান্ত ধারণাসমূহ আপনা আপনি সমাজ থেকে উবে যায় না; সেগুলোর অনেক শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক থাকে। সে জন্য সেগুলো দূর করা সহজ নয়। 

সমাজে সব ধারণাকে বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে নিতে হয়। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকে। কারণ সমাজ চলমান ও নিয়ত পরিবর্তনশীল। এ পরিবর্তনের স্রোতে অনেক বদ্ধমূল ধারণা প্রায় প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। মানুষ কর্তৃক গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে পরিশালীত হয়। বিজ্ঞানের যুক্তি প্রক্রিয়া হচ্ছে সেই বিচার-বিশ্লেষণের হাতিয়ার বা গ্রহণ-বর্জনের ছাঁকনি। মানুষের বৃদ্ধিবৃত্তিকসহ সব বিষয়েই বিজ্ঞানের যুক্তি প্রক্রিয়ার একটা দৃঢ় স্থান আছে। তবে যুক্তি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে তা নয়, কারণ যুক্তি হাতিয়ার মাত্র, শেষ কথা নয়; কিন্তু এ বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রক্রিয়ার হাতিয়ার ব্যবহারে প্রত্যেক সমাজ সদস্যের কমবেশি কিছু দক্ষতা না থাকলে সামাজিক অগ্রগতি শ্লথ হতে বাধ্য। 

সমাজ ও রাষ্ট্রে বিজ্ঞানচর্চার প্রসার সে কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমেই বিজ্ঞানচর্চার কাক্সিক্ষত প্রসার হচ্ছে মনে করার কোনো সুযোগ নেই। শুধু এ টুকুর মধ্যে বিজ্ঞানচর্চাকে সীমাবদ্ধ রাখলে সমাজের বৈষম্য, বিভাজন আরও স্থায়ী ও দৃঢ় হয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ও চিন্তার সুফলকে গণমানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় না। এ রকম বিজ্ঞান দেখে মনে হবে- এ হচ্ছে চিন্তার সার্কাস যা সার্কাসওয়ালাদের মতো কেবল বিশেষ প্রতিভাবানদের পক্ষে অর্জন ও চর্চা করা সম্ভব, যা গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন। অথচ প্রকৃত বিজ্ঞানচর্চার সাফল্য হচ্ছে একে জনমানুষের জীবনচর্চার ও দৃষ্টিভঙ্গির অংশে পরিণত করা। এ ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় কী তা ভেবে দেখা দরকার।  

বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার ঘাটতি ও দুর্বলতা নিয়ে প্রায়ই কথা শোনা যায়। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের ঘাটতির কথা বলা হয়। বিজ্ঞানের দুরবস্থা নিয়ে কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করেন ও স্বীকার করেন যে, এছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। এ সব যারা বলেন তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির কথাই ভাবেন। তাই তাদের বক্তব্য আংশিক সত্য। সাধারণত চিকিৎসা, প্রকৌশলবিদ্যা, কম্পিউটার-বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে পড়ালেখা করাকেই বিজ্ঞানশিক্ষা মনে করা হয়। গভীরভাবে দেখলে, এসব পড়ালেখার উদ্দেশ্য কী? অভিভাবকরা চান ছেলেমেয়ে এসব বিষয়ে পড়ালেখা করে বড় পদের চাকরি করার যোগ্যতা অর্জন করুক। যাকে তারা ‘বড় মানুষ’ বলে মনে করেন। এই চাওয়ার কারণ এ নয় যে, বিজ্ঞানের প্রতি তাদের অগাধ অনুরাগ, ভালোবাসা আছে। আসল কারণ এসব বিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে আর্থিকভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের নিশ্চয়তা পাওয়া। এসব বিদ্যা পছন্দ ও নির্বাচনের পেছনে আর্থিক স্বার্থচিন্তাই মূল; জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সে তুলনায় খুবই কম। উল্লেখ্য, এদেশে ‘বড় লোক’ কথাটির প্রচলিত মানে অনেক টাকার মালিক, সত্যিকার বড় মনের মানুষ নয়। 

অভিভাবকদের জন্য এটি দোষের কিছু নয়, বরং সন্তানের জীবনে আর্থিক সাফল্যের আকাক্ষাই স্বাভাবিক ব্যাপার; কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামজিক ভূমিকাও মোটামুটি এর মাঝেই সীমাবদ্ধ। মৌলিক আবিষ্কার-উদ্ভাবনের জন্য এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রণোদনা নেই। ব্যক্তির পেশাগত আয় বৃদ্ধির বাইরে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিজ্ঞানের এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও দর্শনের আর কোনো ভূমিকা গুরুত্ব পায় না। বিজ্ঞান এখানে একদিকে কুয়ার ব্যাঙের মতো ও অন্যদিকে একটি ব্যবসায়িক শাস্ত্র মাত্র।

বিজ্ঞানচর্চার এই ব্যবসায়িক চরিত্র লাভের সাথে বাণিজ্যক্ষেত্রের সম্পর্কটি স্পষ্ট বোঝা যায়। তবে সে বাণিজ্য ব্যক্তিগত পর্যায়ের। রাষ্ট্রীয় মৌলিক ও বৃহৎ অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্ক সামান্য। অথচ সবকালেই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও আবিষ্কার সামাজিক, অর্থনৈতিক বিপ্লবের চালিকাশক্তি ছিল। অন্যদিকে বিজ্ঞানের সঙ্গে মানবিক বিদ্যার সম্পর্ককে প্রায়ই বিবেচনার মধ্যে আনা হয় না। অনেকেই জ্ঞানের দুই ধারাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখেন। আবার স্কুল-কলেজে ভালো ফল অর্জনকারী ছেলেমেয়েকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করানোর আগ্রহ থেকে মনে হয়, মানবিক বিদ্যাটি বিজ্ঞানের মতো আশরাফ নয়। অভিভাবক সমাজের মনে বিদ্যা নিয়ে প্রচলিত আশরাফ-আতরাফের এই বিভাজন যেমন আমাদের সমাজকে, তেমনি জ্ঞানচর্চাকেও ভয়ানক পিছিয়ে রেখেছে। এর ফলে বিজ্ঞান এ দেশে একটি ব্যবসায়িক বিদ্যা হিসেবে বেশি পরিচিত ও চর্চিত।

কেন এমন হচ্ছে? কারণ প্রকৃত বিজ্ঞানচর্চা কোনো স্বাধীন বিষয় নয়, পুরোটাই একটি রাষ্ট্রের সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু বিচ্ছিন্নভাবে বিজ্ঞানচর্চার জন্য কান্না তাই মেকি ও নিষ্ফল। বৃহত্তর দৃষ্টিতে সব জ্ঞান ও শাস্ত্রই মানবিক দর্শনবিদ্যার অন্তর্গত। ভুল হবে বিজ্ঞানকে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে না দেখে একে বিচ্ছিন্ন একটি মেধার কসরৎ হিসেবে দেখলে। সেই ভুলই হচ্ছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে। এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাঁদে মানুষ পাঠানোর অভিযানের কথা, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টার ফলও। আর ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানের যা কিছু অর্জন তার সবই পুঁজিবাদের অব্যাহত আগ্রগতির চালিকা শক্তি। পশ্চাৎপদ, পরাধীন ও ঔপনিবেশিক বা নয়া-ঔপনিবেশিক দেশে তাই বিজ্ঞানচর্চাও ভয়ানক পিছিয়ে রয়েছে।

বিজ্ঞানী কেবল তাই ব্যক্তির মাথার জোরে সৃষ্টি হয় না। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য জাতীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক উর্বর ভূমি প্রয়োজন। আলবার্ট আইনস্টাইনরা পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের পশ্চাৎপদ দেশগুলোতেও জন্মগ্রহণ করেন; কিন্তু তারা বিকাশের উপযুক্ত জমি পায়নি। বিজ্ঞানকে সামগ্রিক জাতীয় অবস্থা ও বৃহত্তর জ্ঞানচর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিছক মেধার জিমন্যাস্টিকস হিসেবে দেখা হলে বিজ্ঞানচর্চার জন্য আমরা আরও শত বছর ধরে কুমিরের কান্নার সুযোগ পাব, কিছুই ফল হবে না। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের সমাজে আয়-রোজগার ও ব্যবসাবৃত্তির নিছক দাসগিরি থেকে বিজ্ঞানশিক্ষাকে মুক্ত করা।

মানতেই হবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে প্রকৃত বিজ্ঞানচর্চা এবং তার প্রসার জরুরি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা ও গণতান্ত্রিকতা সবার অগ্রগতির জন্য অপিরহার্য। বিজ্ঞান, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, নীতিবিদ্যা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যার যার মতো আলাদা পথে হাঁটে না। দৃঢ়ভাবে বলা যায়, বিজ্ঞান, রাষ্ট্র ও সাহিত্য-সংস্কৃতি একাত্ম। বিজ্ঞানচর্চা প্রসারের প্রয়োজন তাই কেবল বিজ্ঞানের স্বার্থে নয়, সবার স্বার্থে। আবার সম্প্রসারিত বিজ্ঞানচর্চার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অনুকূল পরিবেশ তৈরিও অতীব জরুরি।

লেখক: আলমগীর খান

সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //