লজ্জা ও লোকনিন্দার ভয় থাকলে বড় হওয়া বা বড় কোনো কাজ করা যায় না বলে প্রবীণ ব্যক্তিরা নবীনদের সবসময় উপদেশ দিয়ে থাকেন।
এক্ষেত্রে তারা প্রবাদবাক্য হিসেবে বলে থাকেন- লজ্জা-নিন্দা-ভয়, এই তিন থাকতে নয়; কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে লজ্জাহীনতা ও নিন্দার ভয় এত আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে যে, প্রবাদবাক্যটির তাৎপর্য বদলে গেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথায় মানুষ মনে হয় লজ্জা পেতেও ভুলে গেছেন।
দেশের বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন ধরনের কাজে জনমানুষের মধ্যে আস্থার অভাব আছে; কিন্তু কিছু করার নেই, এই ভেবে মানুষ এসব সংস্থার কার্যকলাপ দেখে ও বিরক্তির পরিবর্তে কৌতুক অনুভব করে। বেদনাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে উপশম করতে চায়। যেমন ব্যাংকের ভল্টে সোনার ক্যারেট পরিবর্তন হলে, এটা হলো ভোজবাজি, খনি থেকে কয়লার হিসাব না মিললে বলে, কয়লা গায়েব ইত্যাদি। তেমনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথাতেও এখন কৌতুক বা নির্মল আনন্দের উপকরণ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে বলে, তিনি সরল বিশ্বাসে বলেছেন।
দেশের নির্বাচন সংক্রান্ত কাজের সবচেয়ে বড় দায়িত্বপূর্ণ পদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এটি একটি সাংবিধানিক পদ। এই পদে যিনি থাকবেন, তিনি শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবেন তা নয়, তার সিদ্ধান্ত, বক্তব্য ও আচরণ জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। কোনো ধরনের আইন ভঙ্গ করে বা নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে পার পাওয়া যাবে না- এই কঠোর অবস্থান রক্ষা করার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবেন নির্বাচন কমিশন, এটাই তো জনগণ প্রত্যাশা করে। সে কারণেই জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করা হয় তাদের ব্যয় নির্বাহের জন্য।
এবার ২০২০-২১ অর্থবছরে নির্বাচন কমিশনের জন্য বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে- ১ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। দেশের ১৭ কোটি মানুষ ধরলে প্রত্যেকেই গড়ে ১০৭ টাকা, ভোটার ১১ কোটি ধরলে প্রতি ভোটার ১৫৬ টাকা ও শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৩৫ লাখ ধরলে প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষ ২৬৪ টাকা দিতে বাধ্য হবেন নির্বাচন কমিশনের ব্যয় নির্বাহের জন্য। তাদের কষ্টের টাকায় কৌতুক উপভোগ করার জন্য নিশ্চয় তারা রাজি হবেন না; কিন্তু তা তাদের করতে হচ্ছে।
যেমন ঢাকা-১৮ আসনে নির্বাচনের সময় আমেরিকার নির্বাচনের সাথে তুলনা করে কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘আমাদেরও শেখার আছে আমেরিকা-ইউরোপ থেকে। কোনো সন্দেহ নেই, যেকোনো জায়গা থেকে ভালো শিক্ষা তো আমরা গ্রহণ করি। আর আমারও একটা কথা আছে, আমাদের কাছ থেকেও তাদের শিক্ষাটা নেয়া উচিত। কারণ আমেরিকা ৪-৫ দিনেও ভোট গণনা করতে পারে না। আর আমরা ইভিএমের মাধ্যমে চার-পাঁচ মিনিট থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে গণনা করে কেন্দ্রে ঘোষণা দিয়ে দেই। এই জিনিসটা তো আমেরিকার নেই। তাদের প্রায় আড়াইশ’ বছরের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতায় তো সেটা অ্যাড্রেস করতে এখনো পারেনি।’
তার এই বক্তব্যে অবাক হওয়া উচিত নয়। অবশ্যই দ্রুততম সময়ে ভোট গণনার জন্য নির্বাচন কমিশন গর্ব বোধ করতে পারেন। ভোটারবিহীন ভোট, মৃতভোট এবং সময়ের আগেই ভোট হয়ে যাওয়া ও তাকে সাফল্য হিসেবে দাবি করার কৃতিত্ব তো তাদের ঝুলিতেই।
এখানেই শেষ নয়।
তিনি আরো বলেন, ‘দ্বিতীয়ত তাদের কোনো কেন্দ্রীয় ইলেকশন কমিশন নেই। এটা কাউন্টি লেভেলে হয়। ১৩ হাজার কাউন্টি, সেখানে তারা ভোট গণনা করে। তাদের আইন মতো। সুতরাং তাদের কাছ থেকে অবশ্যই আমাদেরও শিক্ষণীয় আছে।’ এখান থেকে কী শিক্ষা নেয়া যেতে পারে? প্রধান শিক্ষা তো হতে পারে, কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশনের বিলুপ্তিকরণ। এই শিক্ষা দেশের জন্য উপকারী বা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে কি-না তা নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে নিশ্চয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিশ্চয়ই ফালতু কথা বলতে পারেন না। আমেরিকার নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বুদ্ধিদীপ্তভাবে আলোচনা করলেও তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বাংলাদেশে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম কেন, তার সঠিক কারণ তিনি বলতে পারেননি।
ইভিএমের মতো আধুনিক পদ্ধতিতেও ভোটার উপস্থিতি কম থাকার বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘কেন কম, তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।’ অবশ্য তার এই মন্তব্যে মনে করা ঠিক হবে না যে, ভোটার কম আসার কারণ তিনি জানেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এবার সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের আগে সহিংসতা, নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ, নির্বাচনের পরে ফলাফল না মানার ঘোষণা সবই হয়েছে নির্বাচনে। যদিও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভোট কারচুপির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সির (সিআইএসএ) বিবৃতিতে বলা হয়, ভোটে কারচুপি বা জালিয়াতির কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত মেলেনি। নির্বাচনে ডেমোক্রাট প্রার্থী জো বাইডেন সুনিশ্চিত জয় পেয়েছেন। অন্য দিকে ভোটের ফল এখনো মেনে না নেওয়াকে সার্কাস বলছেন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। নির্বাচনে কারচুপি সম্পর্কে সিআইএসের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছে দেশটির হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস ইলেকশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সেক্টর কো-অর্ডিনেটিং কাউন্সিল ও ইলেকশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গভর্নমেন্ট কো-অর্ডিনেটিং কাউন্সিল এক্সিকিউটিভ কমিটি। মার্কিন ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ বিবৃতিতে সিআইএসএ বলেছে, ৩ নভেম্বরের নির্বাচন মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে নিরাপদ নির্বাচন হয়েছে। চূড়ান্ত ফলাফলের আগে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে দুবার পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। যখন কোনো রাজ্যে নির্বাচন শেষ হয় ফলাফল ঘোষণার পর প্রতিটি ভোট সংরক্ষণ করা হয়। কোথাও কোথাও একাধিকবার গণনা করা হয়েছে। প্রয়োজনে কোনো ভুল বা ত্রুটি দেখতে চাইলে তা ফের পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। নির্বাচন সুরক্ষার জন্যই এ অতিরিক্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া সংশোধনের জন্য কাজ করবে। ভোট দেয়ার পর তা মুছে ফেলা হয়েছে বা কোনোভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে- এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিবৃতিতে সিআইএসএর অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর বব কোলাস্কি বলেন, নির্বাচনে অন্যান্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়াও নির্বাচন-পূর্ব পরীক্ষাও ছিল। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের পরে কি এমন কথা বলতে পারবেন? নির্বাচন যাই হোক না কেন, চোখ ও কান বন্ধ করে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেই অনুযায়ী ফল ঘোষণার সাহস বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের আছে? এ ধরনের সাহস দেখানোর ক্ষেত্রে আমেরিকা বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিতেই পারে।
আমেরিকার নির্বাচন মূলত গাধা ও হাতি প্রতীকের নির্বাচন। প্রচুর টাকা, বিপুল প্রচার, বর্ণ ধর্ম অভিবাসী প্রসঙ্গ নিয়ে বিদ্বেষ আর দীর্ঘদিনের দলীয় বিভক্তি নিয়ে দেশটি দ্বিদলীয় বৃত্তে আবর্তিত। সে কারণেই এত ঘটনার জন্ম দিয়ে এবং অসংলগ্ন কথা ও কাজ করেও ট্রাম্প ৭ কোটির বেশি ভোট পেতে পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও দ্বিদলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে চলছিল। যেখানে টাকা, পেশি শক্তি, প্রচার আর মার্কা প্রধান বিবেচ্য এবং টাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু সাম্প্রতিক ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নির্বাচনে মানুষের আগ্রহ কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। ঢাকা-১৮ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৪.১৮ শতাংশ। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সেখানে পেয়েছেন ৫৩৬৯ ভোট আর বিজয়ী যিনি ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত, তিনি পেয়েছেন ৭৫ হাজার ৮২০ ভোট। সিরাজগঞ্জের অবস্থা তো আরো করুণ। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩২৫ ভোট আর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পেয়েছেন ৪৬৮ ভোট। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও ফল ঘোষণা করতে; কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কোনো কষ্ট হবে না।
নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ; কিন্তু নির্বাচন থাকলেও যে গণতন্ত্র থাকে না, তা বোঝার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ দরকার নেই। বাংলাদেশই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গণতন্ত্র না থাকলে কোথাও কোনো জবাবদিহি থাকে না। অর্থনীতিতে লুটপাট নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। শ্রমিক, কৃষকসহ সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা নয়, পার্লামেন্ট হয়ে পড়ে কোটিপতিদের ক্লাব। সেখানে আইন প্রণয়নের জন্য বিতর্কের চাইতে আনুগত্যের প্রকাশ ঘটানোর প্রতিযোগিতা হয় বেশি। আর তাদের নির্বাচিত করিয়ে আনতে যে ধরনের নির্বাচন করা দরকার, তা তো সবাইকে দিয়ে হবে না। এ সবের উপযুক্ত নির্বাচন কমিশন ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার দরকার তাদের তো নিন্দায় বিচলিত হওয়া বা লোক লজ্জার ভয় পেলে চলে না।
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, বাসদ
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh