বাইডেন জিতলেও হারেননি ট্রাম্প

‘জেতাটা সহজ, হারা মোটেই সহজ নয়। আমার পক্ষে তো নয়ই। কত মিলিয়ন মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছেন, আর একদল বাজে লোক এখন তাদের মতকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। না, আমরা কিছুতেই তা হতে দেবো না। আমরা না জিতলেই বোঝা যাবে, ভোট জালিয়াতি করা হয়েছে।’ 

নির্বাচনের পরদিন এমন মন্তব্যই করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভোটের আগে নিজের স্বভাবসূলভ জানিয়েছিলেন- সংবিধান যা-ই বলুক, ১২ বছর টানা শাসন করবেনই। তার আগে কেউ তাকে হোয়াইট হাউস থেকে বের করতে পারবে না। পাড়ার মাস্তানের মতো আবার এক সময় বলেন- ‘সব ভোট আর গুনতে দেয়া হবে না।’ 

তার এমন কথার প্রতিবাদে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে হয়। হবেই বা না কেন! তার আমলেই যে অর্থনীতির উল্টো যাত্রা, চাকরির হাহাকার; দেশজুড়ে আগুন জ্বলেছে বর্ণ-বিদ্বেষ, জাতি-বিদ্বেষ, অভিবাসী-বিদ্বেষের; কভিড-১৯-এর ব্যর্থ মোকাবেলা, সম্পূর্ণ ভুল নীতি প্রণয়নের ফলে বিপুল প্রাণক্ষয়, হয়েছে বিশ্বে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সংক্রমণ। এখন সরল অংক কষে যে কেউ বলে দিতে পারবেন এসব কারণেই হেরেছেন ট্রাম্প; কিন্তু এসবের কিছুই যে বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে যায়নি, ভোটের হার সেটিই প্রমাণ করে। 

ভোট বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ট্রাম্প কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বিপন্ন করছেন, ওইসব সাত-পাঁচ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দলে দলে বেরিয়ে এসে তার কপালেই সিল মেরেছেন ভোটাররা। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ভোট পাওয়ার রেকর্ড গড়েছেন ঠিকই। কিন্তু সেটি হয়েছে কেবল শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ায়। একই কারণে ট্রাম্পের ঝুলিও ভরে ওঠে বিপুল ভোটে। ২০১৬ সালে ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতলেও, এবার তার পক্ষে আরো দুই শতাংশ বেশি ভোটার রায় দিয়েছেন। যেকোনো ক্ষমতাসীন শাসকের পক্ষে এটিকে বিশাল কৃতিত্ব বলতেই হবে! 

ক্ষমতাসীন নেতার বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার যে সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়, গোটা বিশ্বে, তা যেন মোটেই কাজ করেনি ট্রাম্পের বেলায়! উল্টো দুই প্রার্থীর মধ্যে ৮.৪ শতাংশের ব্যবধানের পূর্বাভাসও মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে মার্কিন সমাজ। এত কিছুর পরও অর্ধেক আমেরিকান ট্রাম্প-শাসনকেই চেয়েছেন!

ব্রিটিশ তরুণ কলামিস্ট ও রাজনীতিক বিশ্লেষক ওয়েন জোন্স দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এক কলামে লিখেন, “করোনাভাইরাস না থাকলে ট্রাম্প নিঃসন্দেহে আরেক দফা প্রেসিডেন্ট বনে শ্বেত ঘরের হর্তা হয়েই থেকে যেতেন। সম্ভবত বেহাল মার্কিন গণতন্ত্রকে এক প্রজন্ম বা তারও বেশি সময়ের জন্য ধূলিসাৎ করে দিতেন তখন! এবার তার বিরোধীদের একচেটিয়া জয় পাওয়ারই কথা ছিল। তবে ভোটে ট্রাম্প পরাজিত হলেও ‘ট্রাম্পবাদ’ ঠিকই বেঁচে থাকবে।” ক্ষমতাসীনদের বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, মুসলিম-বিদ্বেষ, বিদেশিদের প্রতি অহেতুক ভয়, মেক্সিকানদের ধর্ষক আখ্যা দেয়া, কর ফাঁকি- ভোটের ময়দানে এগুলো ছিল ডেমোক্র্যাটদের হাতিয়ার। করোনাভাইরাস সামলানোর ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ে। এমনকি মহামারিকে উস্কে দিয়ে মাস্ক পরা নিয়ে মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কুকথার রাজনীতিতেও ট্রাম্পের ভাবমূর্তি বারবার ধাক্কা খেয়েছে; কিন্তু পাল্টাননি কখনো। তাতেও পপুলার ভোট বেড়েছে তার।

২০০৮ সালে প্রথমবার বিজয়ের পর বারাক ওবামা তার বিখ্যাত বিজয় ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমেরিকায় পরিবর্তন এসেছে।’ তার সেই কথাটি সেদিন ফাঁকা আওয়াজ বলে মনে হয়নি কারও। কেননা যুক্তরাষ্ট্র যে সত্যিই একজন কৃষ্ণাঙ্গকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বরণ করে নিল, সেটি এক বৃহৎ পরিবর্তনেরই প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছিল। তাই পরবর্তীকালে হিলারি ক্লিনটনের মতো একজন শক্তিশালী প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে ডেমোক্র্যাট শিবির বেশ নিশ্চিন্তই ছিল- অনভিজ্ঞ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয় সহজেই আসবে। ‘পরিবর্তিত’ আমেরিকা তার তালে অন্তত নাচবে না। আত্ম-অহঙ্কারে দলের অনেকে তাই সেবার ভোট দিতেও যাননি। কিন্তু তারা এটি টের পায়নি যে, উগ্র-জাতীয়তাবাদীরা একজন কৃষ্ণাঙ্গের শাসনামলকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। মনে মনে তারা ফুঁসছিল আট বছর ধরে। সেইসাথে বেকরত্ব, দুর্নীতির ইস্যু তো ছিলই। এ সুযোগে খোলাখুলি বিদ্বেষের কার্ড খেলে দিলেন। 

মার্কিন মুল্লুককে নতুনভাবে গড়বেন বলে তুললেন ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে বদলও এনেছেন অনেকটা। মুসলিম-বিদ্বেষ, সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিজ দেশে বিভেদ সৃষ্টি, উস্কানির পাশাপাশি তিনি সমস্ত সৌজন্যতা-শালীনতাকে বিসর্জন দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে। হয়ে উঠেছিলেন শ্বেত আধিপত্যবাদীদের পথপ্রদর্শক।

ট্রাম্পের আগে যারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, নীতির দিক থেকে তাদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। গোটা বিশ্বে যুদ্ধ বাঁধানো, বিভিন্ন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ, হত্যা, সরকার ফেলে দেয়া, অস্ত্র ব্যবসা, উত্তেজনা সৃষ্টি ও জিইয়ে রাখা, ভয়-ভীতি দেখানো, গোয়েন্দাগিরি- এসব ক্ষেত্রে সবাই ছিলেন ঝানু। ট্রাম্প সরাসরি যুদ্ধ করেননি; কিন্তু বিশ্বময় যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়িয়েছেন। ইসরায়েলের পাশে থেকে ফিলিস্তিনিদের অধিকার পদদলিত করেছেন। আমেরিকায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন হিটলারের বিভীষিকাময় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। তার বিতর্কিত এসব কর্মকাণ্ডকে অনেক বিশ্লেষক ‘ট্রাম্পবাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই নির্বাচন দুটি বিপরীত চিত্রকে তুলে ধরেছে। ভোটদাতাদের প্রায় অর্ধেক ট্রাম্প ও তার চেতনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। সেই ৭১ মিলিয়ন মার্কিন সমাজেরই মানুষ, ওই দেশের নাগরিক। অবশ্য তাদের কাছে যা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে তা হয়নি। ওই অংশ চেয়েছে ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করতে। রিপাবলিকান পার্টির নৃশংস চেহারাই তারা আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে- এমন একটি দল যারা সম্পদের উৎকট বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, উগ্র জাতি-বিদ্বেষ পোষণ করে, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা পুষে রাখে, নারী-বিদ্বেষে বিশ্বাস করে, নিশ্চিত করতে চায় যে, সাদা এলিটরা মার্কিন সমাজে নিজেদের দাপট বহাল রাখবে, গোটা বিশ্বের ওপর ছড়িটা ঘোরাবে কেবল তাদের দেশই। 

অপরদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টি মুখে না বললেও প্রায় একই আধিপত্যের চেতনা ধারণ করে, তবে তারা উগ্রপন্থী নয়, নরমপন্থী। এসব নানা কারণেই এবার লড়াইটা ছিল হাড্ডাহাড্ডি।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেতে হয়। বাইডেন এরই মধ্যে ৩০৬ টি ভোট নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের প্রাপ্ত ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা ২৩২। এবার মোট ভোট পড়েছে সাড়ে ১৪ কোটির মতো। এর মধ্যে ১০ কোটিরও বেশি ভোট পোস্টাল, অর্থাৎ ভোটের দিনের আগেই ডাকযোগে পাঠানো। শেষ দিকে যে রাজ্যগুলোতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়, তার বেশিরভাগেই যথেষ্ট এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। তাই গণনা শুরুর মাঝরাতে তিনি যে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ‘জিতে গেছি’ বলেছিলেন, তাতে খুব একটা ভুল ছিল না। তখন তো আর জানা ছিল না যে, আগে দেয়া ভোটের বড় অংশই তার বিরুদ্ধে গেছে। যখন সেটি বুঝতে পারলেন তখন থেকেই তার দাবি, ভোট না গোনার। হেরে যাবে বলে ‘খেলবো না’- ট্রাম্পের শিশুসূলভ সেই অভিমানকে কেউ পাত্তা না দেয়ায় গণনা শেষে হেসেছেন বাইডেনই। মিশিগান ও পেনসিলভেনিয়াতে বিপুল ভোটে পিছিয়ে থেকেও শেষ মুহূর্তে প্রতিদ্বন্দ্বীকে টপকে যান বাইডেন। 

তবে প্রশ্ন উঠেছে এই ভোট নিয়ে। কেননা আগে থেকে কাগজে ছাপ মেরে রায় পাঠানোর মধ্যে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, যিনি অধিক ক্ষমতাশালী তিনি অনেক সহজেই কম শক্তির মানুষকে দিয়ে নিজের খুশি মতো ভোটটা দিইয়ে নিতে পারেন।

ট্রাম্প এখনো দু’মাসের ওপর ক্ষমতায় থাকবেন। ভোটফল বেরিয়ে গেলেও সে দেশে ক্ষমতার হাতবদল হয় পরের বছর। সুতরাং ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা। আদালতে না গিয়ে যদি ক্ষমতা ছাড়েন, তা হলে পরীক্ষা শুরু বাইডেনের। এত কৌশলের পরও সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব হয়নি। উভয় দলের আসনসংখ্যা সমান। রিপাবলিকানরা এই সুযোগ যে নেবে তা বলাই বাহুল্য। ওবামাও কিন্তু সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন নিজের রাজত্বের শেষ দু’বছরে। এবারের নির্বাচনে বিভাজন আরো স্পষ্ট। ফলে বৃদ্ধ বাইডেন মনের সুখে নাক ডেকে আর ঘুমাতে পারবেন বলে মনে হয় না। 

প্রশ্ন উঠছে- ট্রাম্পের নীতি আমূল সংস্কার করে নতুন আমেরিকা গঠন করতে পারবেন কি তিনি? আবার তাকে ব্যালট বাক্সে ট্রাম্প সমর্থকের সংখ্যাটিও মনে রাখতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্কে তা মিলিয়ে বাইডেন এগিয়ে যেতে পারবেন কি-না, তা এখনো সময়ের অপেক্ষা। তারপরও একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ট্রাম্পের রাশ টানা যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত সীমানা ও অবাধ বাণিজ্যের দিনগুলোকে কিন্তু বাইডেন ও তার দল আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা হয়তো শিথিল করতে পারেন, অভিবাসন নীতিকে আমূল বদলে দেয়া অসম্ভব। ওয়ার্ক ভিসার কয়েকটি বিভাগে কিছুটা রদবদল করতে পারবেন; কিন্তু মার্কিন কর্মক্ষেত্রে বিদেশিদের একচেটিয়া রাখতে পারবেন না। 

ট্রাম্প তার প্রশাসনকালে যেসব নিয়মনীতি চালু করেছেন, তাও বাদ দিতে পারবেন না বাইডেন। বাণিজ্যিক কৌশলেও কিন্তু ট্রাম্পেরই ছায়া। আবার বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের হলেও বাইডেনের বাণিজ্যিক কৌশল কিন্তু প্রায় একই। সেক্ষেত্রে এই নীতিতেও খুব একটা বদল ঘটার সম্ভাবনা কম। 

বাইডেনের জয়ের চেয়ে এখন ট্রাম্পের পরাজয়ই বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি আলোচিত হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়- আমেরিকার মানুষ, সেই সাথে বিশ্ববাসী ট্রাম্পের হুঙ্কার ও বিরক্তিকর বক্তব্য থেকে অন্তত মুক্তি পেতে পারে; কিন্তু নীতিগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা সামান্যই। আর সে ক্ষেত্রে এটি বলতেই হচ্ছে- বাইডেন জিতলেও হারেননি ট্রাম্প।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //