হাসন রাজা স্থুল মস্তিষ্কের অধিকারি ব্যক্তিত্ব ছিলেন না

গত ৮ অক্টোবর ‘সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল’ পত্রিকায় লেখক হেলাল মহিউদ্দীন ‘কী ঘর বানাইলাম আমরা?’ কলামটি প্রকাশিত হয়। এ কলামটির পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নের পাঠপ্রতিক্রিয়াটি প্রকাশিত হলো:

লেখক হেলাল মহিউদ্দীন কলামটিতে মরমি শিল্পী দেওয়ান হাসন রাজা সম্পর্কে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলেছেন। এর পেছনে সত্যিকারের কোনো প্রমাণ পত্রের হদিস দেননি। হাসন রাজাকে decharecterise করার লক্ষ্যে Conspirative tendency কিছু লোকের মধ্যে অনেক আগে থেকে লক্ষ্য করা যায়। তার জীবদ্দশায় ১৭-১৮ বছর বয়সেও হাসন রাজার যখন ধন আর সম্পদের অভাব ছিল না, তখন তার জ্ঞাতি হিন্দু বংশগত চাচা ওি তাদের বন্ধুবাৎসল্যগণ হাসন রাজার পেছন লেগে যায়। সত্যি কথাটি হলো, অফুরন্ত ধন সম্পত্তিই ছিল তার জন্যে কাল। তার মায়ের জীবনে আপনজন হারানো ও সেই সাথে হাসন রাজার নিজের ১৭ বছর বয়স থেকে একান্ত আপনজন হারাতে হারাতে ধন দৌলতের প্রতি তার এক ধরনের নির্লিপ্ততা এসে যায়। 

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন- ওই ধন দৌলতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই খেকশিয়ালদের মতো তার জ্ঞাতি, প্রতিবেশী জমিদাররা হাসন রাজাকে বিপদে ফেলার জন্য, এমনকি তার জীবনহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে নানান পাঁয়তারা শুরু করতে থাকে। তার নিজের মানুষজনকে টাকার লোভ দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে মিথ্যে ধর্ষণের মামলা দেয়, ব্যর্থ হয় কোর্টের মামলায়। মোল্লা-মুন্সিকে লেলিয়ে দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে। অন্য দিকে হিংসুক জমিদার ও জোতদাররা হাসন রাজার নিজের প্রজাকে টাকা দিয়ে, লোভ-লালসা দেখিয়ে তাকে হত্যা করার জন্যে পাঠায়; কিন্তু ব্যর্থ হয়। প্রজা হত্যা উন্মূক আকবর হাসন রাজার কাছে অনুতাপ প্রকাশ করে ক্ষমা ভিক্ষা চায়।

আমি আগেই বলেছি, হাসন রাজার দুর্ভাগ্য তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অঢেল সম্পত্তি। আর তাই হয়েছে তার জন্য কাল কিংবা অদৃষ্টের পরিহাস। অথচ কোনো দিনই এসবের প্রতি তার কোন লোভ লালসা জাগেনি। এর জন্য তিনি বাস্তবিক জীবনে কোনো জৌলুস দেখাননি, না দালানকোঠা, না অট্টালিকার সাজসজ্জার দাপট কিংবা বাগান বাড়ি নির্মাণের প্রতি! বরং সাধারণ জীবনের কাছাকাছি থাকতেই তিনি ভালোবাসতেন। এর জন্য ঘর-বাড়ি কিংবা বাগান বাড়ি না থাকার প্রমাণ শুধু নয় কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীর কথাই যথেষ্ট না হলেও, তিনি যে নিজে বার বার তার গানে বলে গিয়েছেন সেটা সব বুদ্ধিজীবী লেখকেরা কিংবা হেলাল মহিউদ্দীনরা উপেক্ষা করতে চান, বিশেষত তারা সত্যের কাছে যেতে ভয় পান। তারা ফ্যান্টাসি করতেই পছন্দ করেন। আমি অবাক হই এ সব লেখকদের জন্য। কারণ কোন সূত্র থেকে তারা এসব তথ্য পান, তা আমি জানি না। শুধু বলব হাসন রাজার বেলায় এদের এই যে দৈন্যতার প্রকাশ, তাতে বোঝা যায় যে আমাদের দেশের গবেষণার গর্ভে সত্যিকারের সূত্রের কি যে অভাব! 

হেলাল মহিউদ্দীন উল্লেখ করেছেন হাসন রাজার বাগান বাড়ির কথা, কবিকে মিশিয়েছেন এ কালের widespread violent crime, armed robbery, assult and rape এর সঙ্গে। এখন পরীক্ষা করলে দেখা যায়, mainstream population এর মধ্যে এমন লোক পাওয়া যায়, যারা ওপরের এ সমস্ত অপরাধকে ফ্যান্টাসি হিসেবে দেখে এবং নিজে এ সবে না জড়াতে পেরে আফসোস করে। খুব বড় করে তুলে ধরে এসবকে নিজের আফসোস নিবৃত্ত করতে গিয়ে।

হেলাল মহিউদ্দীন সাহেব তার মধ্যে পড়েন কিনা জানি না। তবে হাসন রাজার সম্পর্কে এই খবরটুকু রাখেন না তিনি যে, কবি হওয়া সত্ত্বেও মরমি কবি হাসন রাজা রাজদণ্ড হাতে নিয়েছিলেন একবার, শুধু তার একজন প্রজা ধর্ষণমুখী হওয়ার কারণে। হাসন রাজা কোনো দিনই অত্যাচার-অবিচারের ধারে কাছেও অবস্থান নেননি। এর পক্ষে প্রত্যক্ষদর্শীর লিখিত সাক্ষ্য আছে। এছাড়া হাসন রাজার এমন বেহায়াপনার অনুপস্থিতিতে রক্ষণশীল তার মা কোনো দিনই চার দেয়ালের ভেতর হতে কোনো দিন বাহির হননি। হাসন রাজা এতখানি স্থুল মস্তিষ্কের অধিকারি ব্যক্তিত্ব ছিলেন না যে, বিপরীতে মা তার সন্তানের মুখরোচক অভিনয়ের কারণেই হাসন মরমি কবি হয়ে উঠলেন। এসব কল্পিত বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। 

অন্যদিকে হেলাল মহিউদ্দীন সাহেবের উত্থাপিত বাগান বাড়ির প্রসঙ্গটি সম্পর্কে আসা যাক। হাসন রাজার ছেলে আপতাবুর রাজা থেকে শুরু করে নাতি আমার বাবা দেওয়ান আনোয়ার রাজা যারা হাসন রাজাকে নিজেদের চোখে দেখেছেন, তারাসহ আমরা কেউ-ই জানি না, হাসন রাজার বাগান বাড়ির অস্তিত্ব বিষয়ে। আমার দাদা হলেন, হাসন রাজার শেষ তথা তিন নম্বর বউয়ের সন্তান। তখন হাসন রাজার মৃত্যুর ২৪ বছর পার হয়ে গেছে। হাসন রাজা তার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মানে আমার দাদাকে মূল বাড়িতে না রেখে অন্যত্র একটি নতুন বাড়ি বানিয়ে দিলেন এবং তার শেষ স্ত্রী মানে আমার দাদিকে সেখানে নিয়ে গেলেন। দাদার প্রথম স্ত্রী আমার দাদি ও দ্বিতীয় স্ত্রী এবার বেশ কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। আজকাল হাসন রাজার ছেলে আমার দাদার তৈরি বাড়িটিকে অনেকে বাগান বাড়ি বলতে শুরু করেছে। আর তা যদি আপতাবুর রাজার নতুন বাড়িকে বাগান বাড়ি বলা হয়ে থাকে, তা না হয় মেনে নেয়া যায়; কিন্তু এটি হাসন রাজার বাগান বাড়ি বললে তো মেনে নেয়া যাবে না। 

১৯২২ সনে হাসন রাজার মৃত্যু এবং আমার দাদা হাসন রাজার সর্বকনিষ্ঠ ছেলের বিয়ে ১৯৪৬ সনে। আমরা এত বছর ধরে জানি, হাসন রাজার পূর্বপুরুষদের একটি বাড়ি বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা গ্রামে, আর আরেকটি বাড়ি আমার জন্ম নেয়া সুনামগঞ্জের (লক্ষণ শ্রী) তেঘরিয়ার কুড়ে ঘরের বাড়ি, যেখানে হাসন রাজা নিজে জন্ম নিয়েছিলেন ১৮৫৪ সনে। হেলাল মহিউদ্দীন সাহেবেরা যদি একটু কষ্ট করে আমার কাছে এসে হাসন রাজার বাড়িতে দেখা দেন, তাহলে সহজেই নথিপত্রসহ সবকিছু দেখিয়ে দিতে পারব। এমনকি মায়ের বিষয়টিও। 

আপনি অধ্যাপক মানুষ, মিছামিছি কোনো প্রমাণ ছাড়া একজন সাধক কবির উপর আপনার কালের বস্তাপচা অপরাধ, এমনকি ধর্ষণের বিষয়টিও তার ওপর চাপিয়ে দিলেন। নিজে পারছেন সমাধান দিতে, কথায় আছে, ‘নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা’। তাই হাসন রাজার মনন, দর্শনকে না বুঝতে পেরে ‘হাসন রাজা উঠোন’ এর ওপর উঠে ব্যাঙের মতো লাফালাফি করছেন কেন?

লেখক: হাসন রাজার প্রপৌত্র ও চেয়ারম্যান, হাসন রাজা মিউজিয়াম, সুনামগঞ্জ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //