দুর্যোগকালে রাজনৈতিক-সামাজিক নৈরাজ্যের বিস্তৃৃতি সম্পর্কে

আমরা এখন এক কঠিন সময় পার করছি। বিদ্যমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অকার্যকারিতায় সামাজিক নৈরাজ্য ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অস্থিরতা, হতাশার পাশাপাশি প্রায় সব ক্ষেত্রে বেপরোয়া অপতৎপরতার আশঙ্কাজনক বিস্তৃৃতি ঘটে চলেছে। মানুষের জীবন-জীবিকা, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। কখন কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে- তা নিয়েও রয়েছে সংশয় ও গভীর অনিশ্চয়তা। আপাতত এর কোনো নিদান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না; কোনো সমাধানও আপাতত দেখা যাচ্ছে না। 

সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ সমগ্র স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর গণঅনাস্থা ও হতাশা মারাত্মক হয়ে উঠেছে। পারতপক্ষে মানুষ হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। নীতি নির্ধারকদের প্রশংসা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে হরিলুট, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খল অবস্থার ভয়াবহ সব চিত্র গণমাধ্যমে আংশিক উঠে আসছে। এ সবের দায়িত্ব নেবার কেউ নেই। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ অধিকাংশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

 

করোনার মধ্যেই দুর্নীতি আর লুটপাটের মহামারিতে দেশ ডুবে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ষণ আর নারী-শিশু নিপীড়নের মহামারি। মহামারির মধ্যে দুর্যোগকে দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্তরা যেমন সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হয়ে উঠছে, তেমনি সমাজবিরোধী ‘ধর্ষক’, নারী নিপীড়ক লম্পটরাও এই পরিস্থিতিকে তাদের দুষ্কর্মের জন্য অবারিত সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের শাসকরা যেমন বেপরোয়া আর জবাবদিহিবিহীন, তেমনি অর্থনৈতিক দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ আর ধর্ষণকারী সামাজিক দঙ্গলেরাও লাগামহীন, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শাসকদের মতো তাদেরকেও নীতি-নৈতিকতা, আইন-কানুন, থানা-পুলিশ-আদালত লাগাম টেনে ধরতে পারছে না; কোনো কিছুকেই এরা পাত্তা দিচ্ছে না। স্বেচ্ছাচারিতা, চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট, দলবাজি, দলীয়করণ, হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, দখল, জবরদখল যেন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। সিন্ডিকেটগুলো পুরোপুরি বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। এরা যা খুশি তাই করছে। যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই আলু-পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, চালসহ প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে প্রতিদিন মানুষের পকেট থেকে বাড়তি শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে বাস্তবে কার্যকর কিছু নেই। এরা সবাই ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দিয়ে খেতে ব্যস্ত। 

বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সামনে শীত মৌসুমে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা আগামী শীতে সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু পরিত্রাণের উপায় কী, চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল হকিকতই বা কী? আগামী বছর টিকা ক্রয়ের ঘোষণা ছাড়া আশাব্যঞ্জক আর কি রয়েছে! করোনা সংক্রমণের আট-নয় মাস পরেও গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো ছত্রভঙ্গ ও বেহাল দশায় নিপতিত রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ সমগ্র স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর গণঅনাস্থা ও হতাশা মারাত্মক হয়ে উঠেছে। পারতপক্ষে মানুষ হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। নীতি নির্ধারকদের প্রশংসা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে হরিলুট, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খল অবস্থার ভয়াবহ সব চিত্র গণমাধ্যমে আংশিক উঠে আসছে। এ সবের দায়িত্ব নেবার কেউ নেই। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ অধিকাংশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। 

করোনার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়েছে অর্থনীতির ক্ষেত্রে। নানা জরিপ বলছে করোনায় দরিদ্রতা দ্বিগুণ হয়েছে। ৭৫ শতাংশ নিম্নবিত্ত মানুষের আয় কমেছে। দরিদ্রদের ৮৯ ভাগ অতিদারিদ্র্যের কাতারে নেমে এসেছে। ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে খাবারের তীব্র সংকট। শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান হারিয়ে অনেকে গ্রামমুখী হয়েছেন। সেখানেও জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। এই সময়কালে কর্মহীন বেকার মানুষের সংখ্যা উল্লম্ফন দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমের বাজারে এই এক বছরেই নতুন করে ২০-২১ লাখ নারী-পুরুষ যুক্ত হচ্ছে। 

করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের লক্ষ-কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজে সংকটগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক ছোট উদ্যোক্তা বিশেষভাবে লাভবান হননি। এই প্রণোদনার বেশিরভাগটাই গেছে ‘তেলের মাথায় তেল ঢালতে’। এই দুর্যোগকালীন সময়ে প্রকৃত উৎপাদক শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকশ্রেণিসহ শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষ, কৃষকসহ প্রকৃত উদ্যোক্তাদের যে সহায়তা পাওয়া জরুরি ছিল, তা হয়নি। দরিদ্র, হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের বড় অংশের কাছেই খাদ্য ও নগদ অর্থ পৌঁছানো যায়নি। যেটুকু যা বরাদ্দ ছিল তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুরি, দুর্নীতি ও দলীয়করণের কারণে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কারণে মহামারি দুর্যোগের মধ্যে শ্রেণি মেরুকরণ আরো প্রকট হয়েছে; ধনী-দরিদ্র্যের বিভাজন আরো নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে। 

এক অভূতপূর্ব দুর্যোগের মধ্যেও স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, খাদ্য, কর্মসংস্থানসহ উৎপাদনমুখী খাত ও সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতসমূহকে প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকার ও বরাদ্দ না দিয়ে সরকার কথিত উন্নয়নের লক্ষ্যে সব মেগা প্রকল্পসমূহে বরাদ্দ ও অগ্রাধিকার বহাল রেখেছে; অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে; রাজস্ব ব্যয় না কমিয়ে বরং ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে; নানাভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদের অপচয়ের ধারা বজায় রেখেছে। 

সরকার পরিচালনায় রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল থাকায় রাষ্ট্রের মধ্যেই যেন অনেক রাষ্ট্র তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর মধ্যে ভারসাম্য ও সমন্বয়ের পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতা ও পেশাগত কোটারি হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকেই যেন স্বাধীন ও আলাদা সত্ত্বা হিসেবে উঠে আসতে চাইছে। সন্দেহ নেই সরকারের দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কারণেই এসব অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব প্রবণতা একদিকে গোটা সরকার তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অকার্যকারিতাকে যেমন উদোম করে দিয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রের জনবিচ্ছিন্নতাও আরো মারাত্মক ও প্রকট করে তুলছে। সর্বোপরি দেশ তথা সরকার পরিচালনায় রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে বেসামরিক-সামরিক আমলা ও প্রশাসননির্ভর জবাবদিহিতাহীন ব্যবস্থাকে আরো জোরদার এবং সংহত করছে; এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র আরো অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী ও দখলমূলক জনবিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠানেও পর্যবসিত হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশে গণতান্ত্রিক ও দায়বদ্ধ রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেমন দুর্বল হবে, ভোটাধিকারসহ গণতান্ত্রিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিসর যেমন সংকুচিত হবে- বিপদগ্রস্ত হবে, তেমনি জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের দানবীয় চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হবে। কোনো সচেতন, দায়বদ্ধ বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে এই পরিস্থিতি কাম্য হতে পারে না। সরকারের এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করছে সাম্রাজ্যবাদী-অধিপত্যবাদী পরাশক্তিসমূহ। এরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশকে তাদের ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে তৎপর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের তৎপরতা রীতিমতো ঔদ্ধত্ব্যমূলক এবং  জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার পরিপন্থী। 

সরকারের দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থান এবং অনুগত পররাষ্ট্র নীতি-কৌশলের কারণে সরকার সমতা, ন্যায্যতা ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান থেকে এসব পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছে না; কোনো না কোনোভাবে তাদের শর্তে ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে।

বহুমুখী এসব সংকট ও দূরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে আশু করণীয় হিসেবে দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তার জন্য প্রয়োজন মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা; একেবারে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা; ভেঙে পড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিনির্ভর কর্তৃত্ববাদী শাসনের উৎস সংবিধানের যাবতীয় অগণতান্ত্রিক সংশোধনী বাতিল, নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে মুক্ত করা; বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ রাষ্ট্রের দমনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথেচ্ছ ক্ষমতার প্রয়োগ বন্ধ করাসহ জরুরি গণতান্ত্রিক কর্তব্যগুলো নিষ্পন্ন করা। আশু ন্যূনতম এই লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানে একেবারে ন্যূনতম ইস্যুতে দেশের সব গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা আজ জরুরি কর্তব্য হিসেবে হাজির হয়েছে। এই কর্তব্য এগিয়ে নিতে যত বিলম্ব হবে দেশ, জনগণ ও তাদের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎও তত বিপন্ন হবে।


লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //