বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির সন্ধানে

বাংলাদেশের রাজনীতি যতই নিকৃষ্ট হোক, এই রাজনীতির ধ্বংসাত্মক, নির্দয় সহানুভূতিহীন সমালোচনা আমরা কখনো উৎসাহ বোধ করি না। আমরা স্বদেশি রাজনীতির উন্নতি চাই। 

রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ যে দুর্গতির গভীরে, তাতে তাদের দৃষ্টি দিতে হবে। রাজনীতির প্রতি জনগণের মনেভাব এবং জাতীয় চরিত্রকে তলিয়ে দেখতে হবে। জনজীবনে শক্তির উৎস খুঁজতে গেলে ভালো ও মন্দ উভয় দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। তারপর করণীয় ও কর্মপদ্ধতি স্থির করে কাজ করতে হবে। চলমান রাজনীতি দিয়ে জনগণের কোনো মঙ্গল হবে না।


বাংলাদেশের রাজনীতির বিরূপ সমালোচনায় কথিত সিভিল সোসাইটি সংস্থাগুলো, কথিত দাতাগোষ্ঠী ও উন্নয়ন-সহযোগীরা যে তথ্য পরিবেশন করে, তা বিকৃত করে প্রচার করে। সিভিল সোসাইটি সংস্থাগুলোর বিশিষ্ট নাগরিকদের মনের অবস্থার সঙ্গে জনমনের অবস্থাকে সঙ্গতিপূর্ণ মনে করা ভুল। ক্ষমতা ও সম্পদের লোভে যারা বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে রক্ষা করার ব্যাপারটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে, শেষ পর্যন্ত এক সময় তাদের বিপদে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। জনগণ জেগে উঠলে ওই শক্তি তাদের কর্তৃত্ব রক্ষা করতে পারবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিকে যদি সুস্থ ও উন্নত করতে হয়, তাহলে আত্মশক্তির ওপর নির্ভর করে তাদের উত্থাপিত অভিযোগগুলো খণ্ডন করতে হবে এবং সমস্যার সমাধান করতে হবে। তা যদি না করতে পারি, তাহলে বৃহৎ শক্তিবর্গ আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নেবে। 
স্বদেশি রাজনীতি শেষ হয়ে গেলে রাষ্ট্র হিসেবে স্বদেশ শক্তিমান থাকবে না। দেশ থাকবে, রাষ্ট্র থাকবে না। আমাদের বুঝতে হবে যে দেশ ও রাষ্ট্র এক নয়। আমাদের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রকে রক্ষা এবং শক্তিশালী করতে হবে। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি আর রাষ্ট্র মানুষের। জনজীবনের প্রয়োজনবোধ থেকেই বাংলাদেশের ভূভাগে রাষ্ট্রের উৎপত্তি। এই রাষ্ট্রকে রক্ষা করা, বিকশিত করা, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করা আমাদের কর্তব্য। আমরা বিশ্বাস করি, আজ যদি বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল শুধু এ রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করার জন্য সুুস্পষ্ট কর্মসূচি ও কর্মনীতি নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ আরম্ভ করে, তাহলে সেই দল অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল জনসমর্থন লাভ করবে।

রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ যে দুর্গতির গভীরে, তাতে তাদের দৃষ্টি দিতে হবে। রাজনীতির প্রতি জনগণের মনেভাব এবং জাতীয় চরিত্রকে তলিয়ে দেখতে হবে। জনজীবনে শক্তির উৎস খুঁজতে গেলে ভালো ও মন্দ উভয় দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হবে। আন্তর্জাতিক অবস্থাকেও বিবেচনায় ধরতে হবে। তারপর করণীয় ও কর্মপদ্ধতি স্থির করে কাজ করতে হবে। চলমান রাজনীতি দিয়ে জনগণের কোনো মঙ্গল হবে না। 
স্বদেশি রাজনীতিকে সাধারণত যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয় না। যখন কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে বলেন, আপনি আমার সঙ্গে রাজনীতি করছেন, তখন ওই ব্যক্তি রাজনীতিকে ধুর্ততা কিংবা প্রতারণা অর্থে ব্যবহার করেন। ‘যে লঙ্কায় যায় সেই হয় রাবণ’- এ কথাটা এদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। লঙ্কা বলতে রাষ্ট্রক্ষমতা এবং রাবণ বলতে দুঃশাসনকে বোঝানো হয়। হুজুগে বাঙাল কথাটাও বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্রের একটা লক্ষণ প্রকাশ করে। বাঙালি ঈর্ষাপরায়ণ এ কথাটাও চালু আছে। বাঙালিকে কলহ পরায়ণও বলা হয়। বাঙালির ইতিহাসে যারা খুব আগ্রহী হয়েছেন, তারা বলেছেন, বাঙালির সংঘ শক্তি ভালো না। বাঙালি অভিহিত হয়েছে আত্মবিস্মৃত আত্মদ্রষ্টা হিসেবে। বাঙালিকে অনেকেই বলেছেন- আত্মকেন্দ্রিক, সমাজবিমুখ, উগ্র, অসহিষ্ণুু, নেতিপ্রবণ রঙ্গপ্রিয়, ভোগলিপ্সু, কর্মকুণ্ঠ, অলস, তর্কপ্রিয়, ভীরু, পরশ্রীকাতর হিসেবে। বাঙালির মস্তিষ্কের উর্বরতা ও দক্ষতা সম্পর্কেও বলা হয়েছে অনেক কথা।

ইতিহাসের সব পর্যায়ে বাঙালির চরিত্র কখনোই সমপর্যায়ে এক রকম ছিল না। ইতিহাসের সব পর্যায় এক রকম থাকে না। কোনো কোনো ঐতিহাসিক সময়ে বাঙালি উন্নত পরিচয় দিয়েছে। বাঙালি চরিত্রে প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যও আছে। ভালো দিকগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার এবং মহৎ সম্ভাবনার খোঁজ দরকার। 
বাংলার হিন্দু-মুসলমান সমাজ সংস্কারক জনসাধারণের ওপর গভীর আস্থা নিয়ে লিখতেন এবং কাজ করতেন। উন্নত ভবিষ্যতের অন্তহীন আশা ছিল তাদের মনে। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান এরা বাংলার জনসাধারণের শক্তি ও সম্ভাবনার ওপর বেশি আস্থাশীল ছিলেন। জনসমর্থনও তারা লাভ করেছিলেন। জনজীবনে তারা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবও বিস্তার করেছেন। তবে তারা কেউই সহজভাবে বাঙালি জাতির মূল রাজনৈতিক প্রবণতার ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কথা ভাবেননি। তাদের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় চরিত্রেরই ঘনীভূত প্রকাশ ঘটেছে। তবে জাতীয় জীবনে তাদের প্রত্যেকেরই নানা অর্জন আছে। মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, নজরুল ইসলাম বাংলার মানুষের অন্তহীন শক্তি ও সম্ভাবনায় আস্থাশীল ছিলেন বলেই তাদের বিস্ময়কর রকম সুন্দর ও কল্যাণকর সাহিত্য সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। বাঙালি-চরিত্র নিয়ে যারা গভীরভাবে চিন্তা করেছেন তাদের অনেকে বলেছেন, তাদের সামাজিক চেতনা ও গুণাবলি কম, তারা স্বভাবত আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিতান্ত্রিক। তাদের মধ্যে যারা যোগ্য তারা কেউ কাউকে মানতে চায় না। আমরা দেখতে পাই, অনেক সময় সভা সমাবেশে শামিল হওয়ার মতো এক দলের পক্ষে অপর দলের বিপক্ষে সরব হওয়ার বাইরে কোনো প্রকার রাজনৈতিক দায়িত্বের কথা এদেশের লোক ভাবতে পারে না। লোকে হীন-স্বার্থান্বেষী ধূর্ত লোকদের তৈরি করা হুজুগে সহজে মাতে। নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সাধারণ মানুষের যে দায়িত্ব আছে, এই কথাটাও কেউ চিন্তা করতে চায় না। রাজনীতিকে নিরাপদ ভাবতে না পেরে সবাই রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেই শ্রেয় জ্ঞান করে। ভালো মনে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার উল্লেখযোগ্য কোনো ঐতিহ্য বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে নেই। ভুল-ক্রটি স্বীকার ও সংশোধন করার প্রতিভাও এদেশের রাজনীতিতে এখনো দুর্লভ। 

সামরিক শাসনের সময় রাজনীতিবিদরা, শাসক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা এবং সাধারণ লোকেরাও কেবল সেনাপতিদের ক্ষমতাকে দায়ী করেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের, রাজনৈতিক দলগুলোর এবং রাজনীতির দুর্বলতাকে বিবেচনাই করেনি। সিরাজ-উদ-দৌলা-মীরজাফরদের কিংবা সেন রাজাদের রাজনীতি ও নেতৃত্বের দুর্বলতার কথা অল্পই ভেবে দেখেন। নীহারঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত History of Bengal গ্রন্থে লক্ষণ সেনদের ও সিরাজ-উদ-দৌলার কাল সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বলে মনে হয় না। 

নানা বিষয়ে বাঙালির সমৃদ্ধ চিন্তা আছে। বিশেষ করে উনিশ ও বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিন্তকদের নানা বিষয়ে অত্যন্ত গভীর, সূক্ষ্ম ও ব্যাপক চিন্তা আছে; কিন্তু বাংলা ভাষায় স্বদেশি রাষ্ট্রচিন্তা কিংবা রাষ্ট্রনীতি অল্পই খুঁজে পাওয়া যায়। রাষ্ট্রগঠন ও রাষ্ট্রপরিচালনা বিষয়ে বাঙালির চিন্তা নগণ্য। স্বকীয় দৃষ্টি প্রক্রিয়ার সমন্বয় করতে পারলে বিদেশি সিদ্ধান্তও স্বদেশি হয়ে ওঠে। বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে সে রকমটা অল্পই ঘটেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ে ভাবনা অল্পই আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রচিন্তা নিতান্তই বাকচাতুর্য নির্ভর। বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকবাদ সম্পর্কে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাজে লাগতে পারে এমন  চিন্তা কম দেখা যায়। 

১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে সিভিল সোসাইটি রাজনীতিকদের দুর্বলতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অনুসৃত কাজের সুযোগ নিয়ে সব ধরনের রাজনীতি ও সরকারি কাজকর্মের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে সাধারণভাবে রাজনীতির বিরুদ্ধে জনসাধারণের মনকে বিষিয়ে তুলেছে। এ কাজে বিবিসি অত্যন্ত সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা- এসব প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের বিশ্বগ্রাসী কার্যক্রমের জন্য কাজ করেছে। এ কাজের জন্য তাদের সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র সঙ্গে ছিল। 

অন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীরা। সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার পরেও রাজনীতিবিদদের বিদেশি প্রতাশ্যা চলমান আছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এবং রাষ্ট্রের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল থেকে দুর্বলতার হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রভৃতি রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার সামর্থ্যও রাখে না। এ অবস্থায় ভারত, চীনের মতো আধিপত্যবাদীরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সব ব্যবস্থার উপর কর্তৃত্ব নিয়েছে। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের কথিত নির্বাচন দ্বারা দৃশ্যমান এই শক্তি প্রদর্শনী করেছে মাত্র। সরকার ও রাষ্ট্র দুটোই কথিত এই নির্বাচনের ফলে দুর্বলতার মধ্যে পড়েছে।

এদেশে লোকে চিরকাল আশা করেছে যে, কেউ অবতীর্ণ হয়ে তাদের উদ্ধার করবে। নেতৃত্ব সম্পর্কে তাদের চেতনায় অজান্তেই অবতার বা পয়গাম্বরের ধারণা কাজ করে। নিজেদের চেষ্টায় নিজেদের তথ্য থেকে, নিজেদের জন্য নেতা, দল, কর্মসূচি ও নেতৃত্ব সৃষ্টির কথা তার ভাবতে চায় না। Live and let others live, Love and be loved peaceful co-existence. এসব বোধ এদেশে কল্পনাই দেখা গেছে; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় না।

এই বাস্তবতার মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশের সরকার জনগণের রাজনীতির বোধহীনতা ও নতুন নেতৃত্ব তৈরির শূন্যতা থেকে বারবার তার ফায়দা লোটার সুযোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে নতুনভাবে বিনির্মাণের স্বার্থেই নতুন রাজনীতির প্রয়োজন। আর তাই বাংলাদেশের রাজনীতির গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে ফিরে আনার এখানেই সব দেশপ্রেমিক নাগরিককে উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক ও রাষ্ট্রচিন্তক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //