শক্তি-ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতিরূপ ধর্ষণ

ব্রাউন মিলার ধর্ষণের স্বরূপ দেখাতে গিয়ে দাবি করেন যে, প্রকৃত ধর্ষণকারী কোনো ব্যক্তি নয়, প্রকৃত ধর্ষক হচ্ছে পুরুষতন্ত্র তথা পিতৃতন্ত্র। তার মতে, ধর্ষণ পিতৃতন্ত্রের জন্য দরকার। কেননা ধর্ষণ পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যকে ত্বরান্বিত করে এবং এর পক্ষে কাজ করে সেনাবাহিনীর মতো। ‘পৌরুষ’কে যে দেখে মুগ্ধ চোখে, আর পোষণ করে নারী বিদ্বেষ। তাতে গড়ে ওঠে এমন এক গণ মনস্তত্ব, যা উৎসাহিত করে ধর্ষণকে। 

পুরুষের মধ্যে কেউ কেউ ধর্ষণ করে, সবাই করে না; তবে সব পুরুষই সম্ভাব্য ধর্ষণকারী। তার হাতে প্রাপ্য অসীম ক্ষমতা ও আধিপত্য তাকে ধর্ষণে উৎসাহিত করতে পারে। যেমন সুযোগ পেলে, যুদ্ধের সময় অবরোধকারী সেনাবাহিনী উল্লাসের সঙ্গে করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়ায় জাপানি বাহিনী এবং ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা।

ব্রাউন মিলার ও অন্য নারীবাদীদের মতে, ধর্ষণ কিছু বিকৃত মনোব্যাধিগ্রস্ত মানুষের কাজ নয়, সমাজেরই কাজ। ধর্ষণ বিকারগ্রস্তের রোগ নয় পিতৃতন্ত্রেরই রোগ। 

ধর্ষণ একটা সচেতন ভীতিপ্রদর্শন প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে পুরুষ নারীকে রাখে সন্ত্রস্ত অবস্থায়। নারী বাস করে ধর্ষণকারীর দীর্ঘ ছায়ার নিচে। ধর্ষণ নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের মূল অস্ত্র; ধর্ষণ এক রাজনীতিক অপরাধ। নারীকে অধীনে রাখার পুরুষের চরমতম উপায়। 

এগুলো হলো ধর্ষণের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার একাংশ, যার সঙ্গে আমরা সবাই প্রশ্নহীনভাবে একমত হতে পারি। আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরে ধর্ষণের যে মহোৎসব চলছে, তার পেছনে শুধু যৌন বিকৃতি ছাড়াও বাকি যে বিষয়গুলো জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে ওপরের তত্ত্বের যথেষ্ট মিল রয়েছে। আর মিলটা যে অবাধ ক্ষমতা ও আধিপত্যের এটা বোঝাই যাচ্ছে। সম্প্রতি একটা পত্রিকা সংবাদের শিরোনাম করেছে, ‘ধর্ষণের সঙ্গে কেন জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম’। গত ২৭ দিনে ৩৫টির বেশি ধর্ষণ হয়েছে এদেশে। একটা বৈশ্বিক মহামারির সময়েও থেমে নেই ধর্ষণ। পাহাড় ও সমতলে একই তালে চলছে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রদর্শনের চর্চা। যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উঠে আসছে ক্ষমতাসীন সংগঠনের সদস্যদের নাম। এক্ষেত্রে বলা যায়, বলপ্রয়োগে ঘটানো অপরাধের সঙ্গে ক্ষমতা সম্পর্কযুক্ত। আর সেই ক্ষমতা যখন নিরঙ্কুশ ও জবাবদিহিহীন হয়ে ওঠে, তখন ক্ষমতার সুবিধাভোগিরা সব রকমভাবে একে উপভোগ করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা একে অন্যকে সমর্থন দেয়, তা বোঝা যায় ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দ্বারা নারীর ওপর সহিংসতার মধ্য দিয়ে।

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের গণধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে উঠেছে; কিন্তু তখন দেখা যায়- এমন কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলো বা অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে তারাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যাদের নাকি বিচারের ব্যবস্থা করার কথা। উপরন্তু তারা অনেক সময় নির্যাতিতকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আপোষ রফায় বাধ্য করে বা ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। ফলে অপরাধী ও সমর্থকরা আরও অপকর্মে উৎসাহিত হয়। অনেক সময় আবার অপরাধীকে দলের কর্মী হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানাতে বা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে দেখা যায়। এটা মূলত আরও হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ক্ষমতাশালীরা এক সময় এদের অনুপ্রবেশ করতে দিয়েছে তাদের ক্ষমতা জিইয়ে রাখার জন্য- ভিন্ন মতাবলম্বী ও সাধারণকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য। এরা ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। সুতরাং অপরাধীরও দল থাকতে পারে। তারা কোনো আদর্শের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। যে আদর্শ বল প্রয়োগের মতো অপরাধ যেমন ঘটায়, তেমন অপরাধী তৈরিও করে। অপরাধী কোনো দলের নয়, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় এই ধরনের ফাঁকাবুলির ফাঁকফোকর দিয়েই বের হয়ে যায় সব অপরাধী।

পাহাড়ে যেসব ধর্ষণগুলো হয় সেখানেও দেখা যায় ক্ষমতা ও আধিপত্যের শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে আসে ধর্ষণ। এসব ধর্ষণে অংশগ্রহণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি, ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকা লোকেরা এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরাও জড়িত থাকে। সুতরাং ধর্ষণ এখানে একটা রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এই নির্যাতন যতটা না ব্যক্তি নারীটির ওপরে তার চেয়ে বেশি তার গোষ্ঠী ও শ্রেণিভুক্ত সব মানুষের ওপরে বর্তায়। এখানে ধর্ষণ আসছে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে। অথচ আমরা এসব ধর্ষণের বিচার হতে দেখি না! দু-একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়া কোনো ধর্ষকের বিচার হতে আমরা দেখি না। যদিও আইন বলা হয়েছে যে, ‘দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা মামলাগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আইনের নির্ধারিত সময়সীমার (বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের) মধ্যে দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।’

‘ট্রাইব্যুনালগুলোকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ধারা ২০-এর বিধান অনুসারে মামলার শুনানি শুরু হলে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে হবে।’ 

তাই যদি হয়, এসব আইনের যদি যথাযথ প্রয়োগ ঘটে, তাহলে দেশে এত ধর্ষণ সংগঠিত হয় কীভাবে? মূলত বিচারহীনতা লাগামহীন ধর্ষণের একটা বড় কারণ। বিচারিক প্রক্রিয়া প্রলম্বিত করার বা দ্রুত বিচারিক কর্মকা- সমাধা না হওয়ায় ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের একটা আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা ছিল গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিনে বিরোধী পক্ষকে ভোট দেওয়ায় সূবর্ণচরে ধর্ষণের ঘটনা। যেখানে পরবর্তীতে ধর্ষিতা নারী নিহত হন; কিন্তু সেই ধর্ষণের বিচার এত দিনেও আমরা কোথায় দেখেছি? অর্থাৎ কি না ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকলে সব অপরাধ যেখানে ঢাকা পড়ে যায়, সেখানে এমন অপরাধ তো বাড়তেই থাকবে।

নারীবাদীদের মতে, ধর্ষণকে শুধু কিছু ব্যধিগ্রস্ত মানুষের বিকৃত কাজ বলে একপাশে সরিয়ে রাখা যায় না। ব্যাপারটিকে বুঝতে হবে লৈঙ্গিক সম্পর্ক, লৈঙ্গিক রাজনীতি, কলঙ্কিত ও নিন্দিতকরণ, সন্ত্রাস ও অপরাধের ভাষায়। এখনকার বাংলাদেশ ধর্ষণপ্রবণ হয়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়া একটা বিশেষ কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আধিপত্যবাদ কায়েমের এটা একটা কৌশল হিসেবে দেখা দিয়েছে। 

জীববিজ্ঞানের সূত্র ধরে বলা যায়, হত্যা, স্বৈরাচার, পীড়ন, লুণ্ঠন, শোষণ প্রভৃতি প্রবণতা উদ্ভূত হয়েছে বিবর্তনের ধারায়। তবে বিবর্তনের সূত্রের সাহায্যে সামাজিক-রাজনীতিক অন্যায়কে যেমন বিধানসম্মত করা যায় না, তেমনি রাজনৈতিক ক্ষমতাকেও পীড়নের কারণ হয়ে উঠতে দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। মানুষ প্যানোর্পা নয়, মানুষ সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রাণি; এবং মানুষের বর্তমান পর্যায়ে কেউ অন্য কারও ওপর আধিপত্য কায়েম করার অধিকার রাখে না। 

সুতরাং এ ক্ষেত্রে বলা যায়, একটা দেশের উন্নয়ন শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন তো নয়। শিক্ষা, নীতি নৈতিকতার বোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, নারী স্বাধীনতা সব কিছু মিলিয়েই হয় উন্নয়ন। সেখানে সর্বত্র লোভ ও লাভের হাতছানি, অপরাজনীতির ঘেরাটোপ, নীতিহীন ব্যবস্থা গোচরে বা অগোচরে একজন লুটেরা, একজন ধর্ষকেরই জন্ম দেবে, আর সে জন্য দায়ী থাকবে রাষ্ট্র, শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা।


লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //