অতিমারির পরবর্তী সমাজ বাস্তবতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!

পৃথিবীজুড়ে করোনার স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক প্রভাব নিয়ে সমন্বিত ও স্বতন্ত্র গবেষণা হচ্ছে। চিকিৎসক, ভাইরলজিস্ট, অর্থনীতিবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা তাদের নিজস্ব দর্পণে সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছেন। বিগত প্রায় আট মাস ধরে ঘরে অবস্থান করে এবং জনবিচ্ছিন্ন থেকে মানুষের মধ্যে যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, সে বিষয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করা প্রয়োজন। 

আমার মতে, বাংলাদেশে শিশুদের এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েরই অনলাইন ক্লাসসমূহ তেমন ফলপ্রসু হচ্ছে না। কিছু কিছু স্কুলে ‘জুম’ প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ‘ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার’ ব্যবহার করে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। শিশুরা বাবা-মায়ের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করছে। তাতে বাবা-মায়ের প্রাইভেসি তো নষ্ট হচ্ছে, এর সঙ্গে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অসংখ্য ফেসবুক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফলে তাদের মোবাইল ফোন আসক্তি মারাত্মক রকম বেড়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- ‘জুম’, ‘গুগল ক্লাসরুম’, ‘গুগল মিট’- ইত্যাদি জনপ্রিয়, পরীক্ষিত এবং সুবিধাজনক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বাদ দিয়ে ফেসবুক মেজেঞ্জারে ক্লাস করার উপদেশ, নির্দেশ কিংবা আদেশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকম-লীকে কে দিয়েছে? যেখানে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা ফেসবুকের অমোঘ আকর্ষণ এবং নিদারুণ সময় ক্ষেপণ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না, সেখানে এসব কোমলমতি ছেলেমেয়ের এই বয়সেই ফেসবুকে আসক্ত করে ফেলার জন্য এসব স্কুল কর্তৃপক্ষকে একদিন বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা। পড়াশোনার পাশাপাশি ‘জুম ব্রেক হাউ সেশন’ ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত করা যায় কিনা সে ব্যাপারেও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সেটা করতে পারলে ছেলে-মেয়েদের সামাজিক পরিসর ও মেলামেশার একটা সুযোগ তৈরি হবে, যেটা তাদের সামাজিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন ক্লাসরুম কিছুতেই শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা যাচ্ছে না। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয় করতে না পারলে এই কার্যক্রম ফলপ্রসু করা সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে সব বিষয়েই এক ধরনের নন-সিরিয়াসনেস কাজ করে। প্রথমে বেশ উৎসাহের সঙ্গে উদ্যোগ নেয়া হয়। ক্রমেই সেই সব কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে। অনলাইন ক্লাসও সেই রকম একটা উদাহরণ। এ বিষয়ে বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর কারো তেমন উৎসাহ চোখে পড়ছে না। 

সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া মানুষের শরীরের পেশির গঠনের মতোই স্বল্প ব্যবহারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। অতিমারির পর মানুষের আবার আগের মতো সামাজিক মানুষ হয়ে উঠতে সময় লাগবে। কারাগারের বাসিন্দা, সৈনিক, অভিযাত্রী, নভোচারী তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দীর্ঘদিন একাকী থাকার কারণে তাদের পারস্পরিক মেলামেশা করার ক্ষমতা তিরোহিত হয়। অতিমারির পরও একই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। মানুষ সহজেই অসহনশীল, অতিরিক্ত স্পর্শকাতর ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। একজন আরেকজনের সঙ্গে মেশার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে; কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে যখন সামনা সামনি দেখা হবে, তখন তাদের একজনকে আরেকজনের প্রায় অসহনীয় লাগবে। মানুষ ইতোমধ্যেই ‘জুম’-এর অতি ব্যবহার, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, এক জনের প্রতি আরেকজনের অহসনীয় আচরণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিষয়গুলোকে হালকাভাবে নিচ্ছি, যদিও এর সুদূরপ্রসারী ঋণাত্বক প্রভাব রয়েছে। ইতোমধ্যেই মানুষের ব্যবহারিক অনেক পরিবর্তন দেশে দেশে মানুষকে বদলে দিচ্ছে। 

এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে অন্তর্মুখী সেও অন্যের সঙ্গ পেতে চায়। এটার একটা বিবর্তনমূলক মনস্তত্ত্ব আছে। কারণ ঐতিহাসিকভাবেই যারা একাকী থাকত তারা অন্য প্রাণির আক্রমণ থেকে সহজে বাঁচতে পারতো না আর তাদের খাবার সংগ্রহ করতেও অসুবিধা হতো। ফলে যখন আমরা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক সেটাকে একটা শঙ্কা হিসেবে গ্রহণ করে। একাকীত্ব আমাদের মস্তিষ্ককে ‘ক্ষুধা’ বা ‘তৃষ্ণা’র মতো একটা সংকেত দেয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মস্তিষ্কের গতিময়তা পরীক্ষাগার’ এর বিজ্ঞানী স্টিফেন ক্যাকিওপ্পো’র মতে, ‘ক্ষুধা পেলেও না খাওয়ার মতো এবং তৃষ্ণা পেলেও পান না করার মতো যে পরিস্থিতি, আমরা এখন সেই সময় আর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি’।

এই পরিস্থিতিতে মানুষের কিছু ভালো লাগে না এবং সব কিছু থেকে নিজের বিযুক্ততা অনুভব করে। এমনকি একটি বন্ধুসুলভ ফোনকলও মানুষ ঠিক ধরতে চায় না। কেমন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে ভালোবাসে আর নিজেকে গুটিয়ে রাখে। মোদ্দা কথা হলো মানুষ একে অন্যের সঙ্গ কামনা করলেও কেউ কাউকে মোকাবেলা করতে চায় না। এক পর্যায়ে মানুষের আত্মপ্রত্যয় কমে যায় এবং মানুষ ক্রমেই ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। 

এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, দিনের একটা সময় মানুষ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে এবং টেলিফোনে কিংবা ইন্টারনেটে পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য কিছুটা হলেও সময় ব্যয় করে। লম্বা সময়ের বিচ্ছিন্নতা এমনকি আমাদের মূল্যবোধও পরিবর্তন করে দেয় এবং আমাদের ব্যক্তিত্ব বদলে দেয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বিগত কয়েক মাসে মানুষের ‘সিজোফ্রেনিয়া’ আর ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ অনেক বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে আমেরিকাতে ‘ইউনাইটেড হেলথ গ্রুপ’ এর এক জরিপে দেখা গেছে, দুশ্চিন্তা নিরোধক ড্রাগ যেমন জেনাংক্স, ক্লোনোপিন এবং স্লিপিং পিল ও এন্টিডিপ্রেশন মেডিকেয়ার শতকরা ১৫ ভাগ ক্রয় বেড়ে গেছে। আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একটি সাম্প্রতিক জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে- ‘উচ্চ মাত্রার মনস্তাত্বিক চাপ’ শতকরা ৪ ভাগ থেকে বেড়ে শতকরা ১৪ ভাগে পৌঁছেছে। এবং এটা বাড়তেই থাকবে কারণ আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, অতিমারির ক্ষেত্রে সত্য হলো এটা কোন স্প্রিন্ট নয়, এটা একটা ম্যারাথন।

তাছাড়াও এই অতিমারির কারণে বাড়ির অভ্যন্তরে সহিংসতাও বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বহু আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংগঠনের জরিপ ও গবেষণায় দেখা গেছে যে, দীর্ঘদিন ঘরে থাকার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন রকম মানসিক টানাপড়েন বেড়ে গেছে এবং বাড়িতে সাহায্যকারী লোকজন ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না থাকায় সেই সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। মারধর, মানসিক অত্যাচার, হত্যা, জখম ইত্যাদি আগের তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডির গবেষণা মতে, কোভিডের সময় বাংলাদেশে সব ধরনের সহিংসতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা ও দাতা সংস্থার মতে, করোনার কারণে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের শতকরা ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। ফলে করোনা পরিস্থিতির কারণে এখানে প্রচুর কর্মহীনতা দেখা দেয়ায় বাংলাদেশে বেকার সমস্যা যে মারাত্মক আকারে বেড়ে যাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উপরন্তু বিদেশে কর্মরত এবং দেশে প্রত্যাগত অনেকেই কাজে ফেরত যেতে না পারায় দেশে কর্মসংস্থানের বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। মানুষ এক নিদারুণ জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হবে। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা ভেবে এখন থেকেই নানারকম আন্তর্জাতিক ও জাতীয় উদ্যোগ নেয়া খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এদেশের মানুষের অদম্য প্রাণশক্তি এবং যে কোনো বিপদে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াকু মানসিকতা। করোনার অন্য পাড়ে সরকার, এনজিও এবং উন্নয়ন সহযোগীরা সেইসব জাগ্রত, অদম্য, লড়াকু মানুষের পাশে একটুখানি দাঁড়ালে এই মানুষই হয়তো দেশটাকে বাঁচিয়ে দেবে।


লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //