কী ঘর বানাইলাম আমরা?

লম্পট ও ধর্ষক থেকে দেওয়ান হাসনরাজা কেন মরমি সাধক-কবি হয়ে গেলেন? পিতামহের কাছে একটি লোকগল্প শুনেছিলাম। সত্য-মিথ্যা যাই হোক, সেই গল্পটি এ রকম- ক্ষমতার দাপটে দেওয়ান হাসনরাজা চূড়ান্ত লম্পট হয়ে ওঠেন। বিয়ের আসর থেকে কনে তুলে নিয়ে গিয়ে বাগানবাড়িতে ওঠাতেন। একবার এক পিতা গেলেন হাসনের মায়ের কাছে। কেঁদে বুক ভাসিয়ে আর্জি জানালেন- আজ আমার প্রাণাধিক কন্যাটির বিয়ের রাত। হাসনের ভয়ে আমরা নিদ্রাহীন। আপনিই আমাদের শেষ ভরসা, মাননীয়া! আমার কন্যাটির ইজ্জত রক্ষা না করলে আমরা সবংশ গলায় দড়ি দেব। 

চিরাচরিত নিয়মে হাসনের লোকজন বিয়ের আসর থেকে ঘোমটায় মুখ ঢাকা কনেটিকে তুলে নিয়ে এলেন বাগানবাড়িতে। তারপর উদ্যত হলেন তার কুপ্রবৃত্তি মেটাতে; কিন্তু এ কী! ঘোমটা সরাতেই হাসন দেখল যুবতী কন্যা নয়, একজন পরিণত নারীকে তুলে নিয়ে এসেছে তার লস্কররা। নারীটির দুই চোখে হাবিয়া দোজখের আগুন। সেই নারী আর কেউ নন। তারই গর্ভধারিণী মা! 

মায়ের চোখের আগুনে হাসনের ক্ষমতার প্রাসাদ যেন মুহূর্তেই ভস্ম হয়ে গেল! উন্মাদ হয়ে গেলেন হাসন! বাগানবাড়ি ছেড়ে সেই যে অন্ধকার দিগন্তের দিকে দৌড়ানো শুরু করলেন, আর ফিরলেন না পতিত জীবনে। গান বাঁধলেন- কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝারে! 

শৈশবে পিতামহের বলা লোকগল্পটি হতে কী শিখেছি? বরং উলটো করে বলি- কী শিখিনি? 
হাসনের কালের মতো মায়ের কনে সেজে বসা এখন তো সমাধান হতে পারে না! দায়ও তো মায়েদের নয়! হাসনের গল্প শুনেই আমার শিশুমনে নিদারুণ অভিঘাত তৈরি হয়েছিল। মনে প্রশ্ন জেগেছিল- মাকে কেন এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হলো? কী তার অপরাধ? দায় তো মায়ের নয়! মা তো হাসনকে নষ্ট হয়ে যাবার সব পথ থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টার কমতি করেননি। সীমাহীন দেওয়ানি ক্ষমতাই তো তাকে দানব বানিয়েছিল! 

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনাসহ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকা ধর্ষণ বিভীষিকায় ক্ষোভে-দুঃখে-আক্ষেপে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন- এদের জন্ম কি কোনো মায়ের পেটে? আপনাদের অনুরোধ, দয়া করে মায়েদের যাতনা আর বাড়াবেন না। মায়েরা নিষ্পাপ শিশুই পেটে ধরেছিলেন। ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ নামক একটি দানব কোলেপিঠে রেখে দুধকলায় পুষে এই দানবদের ধর্ষক বানিয়েছে। ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ই এদের পালক পিতা-মাতা।

হাসনের লোকগল্প শোনার সময় আমার শিশুমনে আরও একটি প্রশ্ন জেগেছিল- মায়ের কাছে কেন যেতে হলো? সমাজে কত কত মানুষ! তাদের ঘরে দা-ছেনি-খন্তা-কুড়াল-আগুন-পানি কী নেই? তবু কেন তারা হাসনের লাম্পট্য ঠেকাতে তার মায়ের কাছে আর্জি জানাতে গিয়েছিল? পিতামহকে প্রশ্নটি করেও ছিলাম। তিনি জানালেন- ‘ভয়’! নির্যাতন ও বিচারহীনতা জারি করে রেখেছিল হাসনরাজা। অপকর্মের শাস্তিবিধান সে কীভাবে করবে? নিজেই তো সে অপকর্মের হোতা। 

সেদিনের হাসনের শিক্ষা হয়েছিল। মা সার্থক হয়েছিলেন। হাসন নিবৃত্ত হয়েছিল। এ যুগের হাসনরা অনেক বেশি ক্রুর, নিষ্ঠুর ও বীভৎস। দুনিয়াবি লোভে লোভাতুর এই যুগের হাসনদের নিবৃত্ত হবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। শিশুমনের সেই একই প্রশ্ন এখনো একইভাবে জেগে উঠছে। এখনো ভাবছি আমাদের সামাজিক প্রতিরোধের বীরত্বগাথা কীভাবে হারিয়ে গেল? এই আমরাই কী একাত্তরে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম? 

কী ঘর বানাইলাম আমরা? কী ঘর বানানোর কথা ছিল আমাদের? এই ঘর বানানোর জন্যই কী লাখো বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন?

সামাজিক প্রতিরোধ কেন দরকার?
অবশ্যই এই দেশটি কয়েক দশক আগেও অন্যরকম ছিল। যুবক, তরুণরা অপরিচিত বয়স্কদের দেখলে হাতের বিড়ি-সিগারেট দূরে ছুড়ে ফেলত। সম্ভ্রমে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে যেত। পরিচিত হবারও প্রয়োজন ছিল না। আমাদের শৈশবের কথা মনে আছে। খানিক সন্ধ্যা নামলেই চিনি না, জানি না বয়স্ক কেউ এসে জানতে চাইতেন- এখনো বাইরে কেন? ঘরে যাও? কোন স্কুলে পড়? কোন বাড়ির ছেলে? বাবার নাম কী? 

কী অসাধারণ সামাজিক অধিকার এবং দায় ও দায়িত্ব নিয়েই না তারা শাসন করতেন! তাদের শ্যেন দৃষ্টি উপেক্ষা করে অপকর্ম করার সাহস হতো না যুবা-তরুণদের। 

আমরা যারা সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র, এক দশকে লক্ষ্য করছি গ্রামে-গঞ্জে পাড়ায় মহল্লায় মুরুব্বিজন বা বয়স্করা বখাটেদের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন। ছাত্রদের সঙ্গে মাঠকর্মে গিয়ে, বহুজনের সঙ্গে হাটে-মাঠে আলাপে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের বক্তব্য- কিশোর-তরুণ-যুবাদের দেখলে তারাই এখন উলটো মাথা নিচু করে সরে পড়েন, ইজ্জত-সম্মান খোয়ানোর ভয়ে। আক্রান্ত হবার ভয়ে। রোষের শিকার হবার ভয়ে। নানারকম মানসিক নির্যাতনের ভয়ে। মিথ্যা অপবাদ ও অভিযোগে মামলার ভয়ে। তাদের বক্তব্য- ছেলে-মেয়েগুলো চরম বখাটে ও বেয়াদব! সীমাহীন আস্কারা পায় তারা এলাকার বড় ভাইদের কাছ থেকে। ওপরের নেতাদের কাছ থেকে। বিনিময়ে তাদের অপকর্ম নির্বিঘ্নে করতে যতরকম সহযোগিতা, সহায়তা, সাহচর্য দেয়। মূলত তারাই পালে-পোষে এদের।

সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনায় একজন ‘গুড সামারিটান’ ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, পুলিশে জানিয়েছিলেন বলেই অপরাধীরা ধরা পড়েছে। পত্রপত্রিকায় খবর হয়েছে যে, তাদের ছায়া ও আশ্রয় দেওয়া ক্ষমতাশালীরা আপসের চেষ্টায় এবং অপরাধীদের রক্ষাচেষ্টায় কমতি রাখেননি। একজন এগিয়ে এসেছেন বলেই অপরাধীরা ধরা পড়েছে। বেগমগঞ্জে একজন নারীকে দলবদ্ধ উপর্যুপরি ধর্ষণ, তারপর আবার শারীরিক নির্যাতন যে কোনো নৃশংস সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানায়। ঘটনার সময় কেউ এগিয়ে এলেন না। বত্রিশটি দিন গেল। ধর্ষকরা ছাতি ফুলিয়ে হেঁটেছে। পুলিশ-প্রশাসন কেউই টের পেল না? নারীটির একজন প্রতিবেশিও কেন এগিয়ে এলো না? কেন পুলিশকে জানাল না। কারণ ধর্ষকদের ভয় পাওয়া ছাড়া মোটেই অন্যকিছু নয়। ভয় পাবার কারণ তারা ক্ষমতার রাজনীতির পাইক-বরকন্দাজ! এই ভয়টি এখনই কাটানো না গেলে, অনন্ত নিরাপত্তাহীনতা ও জঙ্গলের শাসনের মধ্যেই সবাইকে বসবাস করতে হতে পারে।

দুনিয়া দেখছে কী ঘর বানাইলাম আমরা!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগের একটি কূটনৈতিক নিরাপত্তা ব্যুরো আছে। ব্যুরোর ‘ওভারসিজ সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল’ বা ‘ভিনদেশবিষয়ক নিরাপত্তা উপদেশ পর্ষদ’ আছে। পর্ষদটির কাজ কোন দেশ নিরাপদ আর কোন দেশ অনিরাপদ তার নিয়মিত হালনাগাদকৃত তালিকা তৈরি করা। এই বছরের আগস্টের ৮ তারিখে বাংলাদেশবিষয়ক হালনাগাদকৃত তথ্য পৃথিবীর যে কোনো মানুষকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে ভীতিগ্রস্ত করে তুলবে। সেখানে পর্যটকদের উদ্দেশ্যে উপদেশ- ‘অপরাধ, সন্ত্রাস এবং অপহরণের কারণে বাড়তি সতর্ক থেকো’ (Exercise increased caution in Bangladesh due to crime, terrorism, and kidnapping)। ‘সহিংস অপরাধ যেমন সশস্ত্র দস্যুতা, প্রাণঘাতী আক্রমণ এবং ধর্ষণ সর্বব্যাপ্ত (Violent crime, such as armed robbery, assault, and rape, is widespread)।

ঘরে ঘরে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আর কোনোই বিকল্প নেই!

হেলাল মহিউদ্দীন
লেখক ও অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //