ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা বনাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

অনেক রাতে মোবাইলটা বেজে উঠল। ভয়ে ভয়ে উঠে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি এক প্রবাসীর কল। কলটা ধরতে তখন সাহস হলো না। পরিচিত জন কী সংবাদ দেওয়ার জন্য এত রাতে ফোন করতে পারে। একবার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে যাবার পর আবার রিং হওয়া শুরু হতে, বাধ্য হয়ে হ্যালো বলতেই তিনি বললেন আপনাদের অনেক রাত জেনেও বাধ্য হয়ে ফোনটা দিলাম। আপনি শুধু আমাকে বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন কত? আমি তখন জানাই হিসাব মতো, আগামী বছর আদমশুমারি হওয়ার কথা, তবে সাধারণভাবে সবাই ১৬ কোটি বলে থাকেন। ঠিক আছে বলে রেখে দিতে চাইলে জানতে চাই ঘুম থেকে তুলে হঠাৎ বাংলাদেশের কথা মনে হলো কেন? তখন তিনি জানান, বাংলাদেশ থেকে কয়েক দিন হলো এক ডাক্তার এসেছেন, সে কথা বলার এক পর্যায়ে আমাদের বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ মিলিয়ন। আমাদের বিশ্বাস না হওয়ায় আপনার ঘুম ভাঙাতে বাধ্য হলাম। বললাম ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছে, তাই কোটি আর মিলিয়নের পার্থক্য জানে না। 

তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সনদপ্রাপ্ত এমবিবিএস ডাক্তার। তার মেধা নিয়ে সাধারণ বাঙালিদের কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। দেশের মেধাবী সন্তানরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের পেশা গ্রহণ করে থাকেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সনদেও কোনো সমস্যা নেই। মূল সমস্যা হচ্ছে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা। এখনকার শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ জানেন না। তারা তাদের স্বপ্নের দেশ সম্পর্কে খুব ভালো জানেন। ডাক্তার তো তার স্বপ্নের দেশে পৌঁছে গিয়েছেন। এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি নয় ১৬ মিলিয়ন বলে মেধাবী হিসেবে নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রবাসে বিতর্ক করতেই পারেন। দেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে এই মেধাবী সন্তানরা আমেরিকার শাসন ব্যবস্থা ভালো জানে, কানাডার জলবায়ু সম্পর্কে ভালো জানে, ব্রিটেনের অর্থনীতি ভলো জানে, জার্মানির শিল্পনীতি ভালো জানে, চীনের বাণিজ্যনীতি ভালো জানে। এত কিছু জানার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে জানার কী আছে? এসব শিক্ষার্থীর জন্য বাংলাদেশে প্রয়োজন একজন বিত্তবান প্রভাবশালী অভিভাবক মাত্র। 

দেশে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা ব্যক্তিরা সন্তানদের জন্য বিদেশকেই প্রথম পছন্দ করে থাকেন। সন্তানদের জন্য পাকাপাকিভাবে বিদেশে থাকার ব্যবস্থা করতে না পারা পর্যন্ত দেশের বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। জীবনের সব অর্জন-বিসর্জন দিয়ে হলেও সন্তানদের জন্য এই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামেও এখন এ শিক্ষাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রচুর ভিড়। দেশের সর্বত্র সন্তানের জন্য শিক্ষার সূচনাতে কিন্ডার গার্ডেনে ভর্তি করাতে অভিভাবকদের ভীষণ আগ্রহ দেখা যায়। যদিও সামর্থ্যবানরা ছাড়া শেষ পর্যন্ত অনেকেই সেখানে যেতে পারেন না; কিন্তু সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে শুরুটা এখান থেকে করার চেষ্টা করেন এবং করছেন। কারণ দেশে এই শিক্ষারই একমাত্র ভবিষ্যৎ আছে। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার সব দ্বার খোলা। এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে উদার আকাশের মতো ভবিষ্যৎ আছে। 

আমাদের দেশে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে রাজার ছেলে রাজা হয়। পীরের ছেলে পীর হয়। জমিদারের ছেলে জমিদার হয়। এই ঐতিহ্যকে ধারণ করে এখনো পরিবারতন্ত্রের জয়জয়কার চলছে। এক জনপ্রতিনিধির পরিবর্তে পরিবার থেকে জনপ্রতিনিধি হচ্ছে। ক্ষমতার বলয়ের শীর্ষে অবস্থান ধরে রাখতেই এ পথে হাঁটা। দাবিদার যেন কোনোভাবে মাথাচাড়া না দিতে পারে, তার জন্য অন্যতম কৌশল বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে সংবিধান বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিবেচ্য নয়। সাধারণ জনগণের জন্য রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর সংবিধানের ধমক খেয়ে পরিবারতন্ত্রের পথ সুগম করতে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাকে বহাল রাখা হয়েছে। ক্ষমতার বলয় থেকে কেউ কোনো কথা বলতে চায় না, বলেও না। এদের যত চিন্তা সাধারণ শিক্ষা নিয়ে, স্বপ্নে পাওয়া পথে কীভাবে শিক্ষাকে পণ্য করা যায়। শিক্ষা ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকে কতটা সুগম করা যায়।

আমাদের দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণ, কারিগরি, ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মিডিয়াম ও মাদ্রাসা এ সব ধারা চলমান। এ সব ধারা থেকে অন্য ধারায় যাওয়া যাবে; কিন্তু সমন্বয়ের বিশাল অভাব। যেসব শিক্ষার্থী সাধারণ ধারায় নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারছে না বা অর্থনৈতিক কারণে কর্মজীবনে প্রবেশে আগ্রহী তারা কারিগরি ধারার শিক্ষার্থী হয়ে থাকে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাইতে এই শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে বিষয়ের আধিক্য বিদ্যমান। আবার সাধারণ ধারার শিক্ষার নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতাকে প্রত্যাখ্যান করে সব শিক্ষার্থীকে ইসলামী মানসিকতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার কাজ চলছে। পাঠ্যপুস্তকে সরকার হেফাজতের বিষয়গুলোকে স্বাগত জানাচ্ছে। সব মিলিয়ে সাধারণ জনগণের জন্য আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে সংবিধানও নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও নেই। 

সাধারণ জনগণের শিক্ষা ব্যবস্থা যখন সাম্প্রদায়িক ও অন্তঃসারশূন্য করে ফেলা হচ্ছে, তখন অভিজাত শ্রেণির উচ্চবিলাসী মনন তৈরি ইংরেজি শিক্ষার জয়জয়কার স্বাভাবিক। পরিবেশ পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে আনার চাইতে জীবনবাজি রেখে মই ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছে মানুষ। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, বিজ্ঞানমনষ্ক, মুক্তচিন্তার বিকাশ ও স্বাধীন দেশ উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবনার মধ্যে আনতে পারছে না। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আজ হাত গুটিয়ে বসে আছে। মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ইথারে হারিয়ে যাচ্ছে। সামর্থ্যবানরা পরিবারসহ সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দেশের অনক্ষর, অনাহারি মানুষের শ্রমের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের প্রাপ্তিযোগ নিশ্চিত না হলে কেউ দেশের সেবায় নিজেকে নিবেদিত করতে আসেন না। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই এদের একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকে বিদেশে নিজেদের শ্রম নিবেদন করা। এসব দেশপ্রেমিকের দেশপ্রেম নিয়ে কথা বলার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে কিনা জানি না। তাই বাংলাদেশকে জানতে হবে এমন দাবিও করা যাচ্ছে না। 

দেশে রেমিট্যান্স খাত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের খাত হিসেবে স্বীকৃত। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে এই খাতকে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যায় দেশের উচ্চশ্রেণির মানুষদের অংশগ্রহণ কতটা নগণ্য । এরা যে পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠায়, তার কয়েকগুণ অর্থ দেশ থেকে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ মনে করে দেশ এদের কাছ থেকে কোনো সেবাই পায় না। সম্প্রতি করোনাকালে এক বাংলাদেশি ইতালির নাগরিক হিসেবে এসে বিমানবন্দরে যে ভাষায় কথা বলল, তার কোনো বিচার হলো না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোন ক্ষমতাবানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলে গ্রেফতার করে বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে, সেখানে দেশের বিরুদ্ধে কথা বলে পার পেয়ে গেল? বিদেশি নাগরিক হলেই আমার দেশকে অপমান করার অধিকার রাখে না। আমাদের দেশে আমাদের আইন চলতে হবে। এসব প্রীতির কারণও সাধারণ মানুষ বোঝে না। দ্বৈত নাগরিকত্ব বিষয়টা বিবেচনা করার সময় এসেছে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টি করছে। মানুষে মানুষে এই শ্রেণিভেদ কোথায় গিয়ে থামবে, জানি না। সমাজের শ্রেণিভেদে ক্ষমতাসীনরা সংকটের গভীরে হারিয়ে যেতে বসেছে। মুক্তির উপায় খোঁজার প্রয়োজন হয়ে পড়লেও সবাই উটপাখির মতো বালির মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। শিক্ষার ধারাবাহিক অধোগতিতে বিচলিত হচ্ছে না। নিজেদের জন্য বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করবে। মানুষকে তাদের জীবনের সমস্ত অর্থ ও বেঁচে থাকার উৎসের বিনিময়ে বোকা করে রাখবে। মুক্তি পরাহত নয়। মুক্তি আসবে। সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয় হবে। সাধারণ মানুষের কল্যাণের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। শ্রেণি বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিজ্ঞানমনষ্ক ও মুক্তচিন্তা বিকাশের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু নিশ্চয়ই হবে।

লেখক
এম আর খায়রুল উমাম
সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //