কেন নারীরা বিয়ের প্রলোভন জয় করতে পারেন না?

গত কয়েকদিনের টেলিভিশন সংবাদে বেশ কয়েকটি যৌন প্রতারণার খবর উঠে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে ঘটেছে আত্মহত্যার ঘটনা। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সেই পুরুনো ছকবাঁধা গল্প। সমাজ নারীকে প্রতিনিয়ত নানা পুরস্কারের লোভ দেখায়। বুদ্ধিদীপ্ত নারী থেকে নির্বোধ নারীকে বেশি পছন্দ করে, আর নির্বুদ্ধিতাকে রমণীয় বলে প্রশংসা করে। ৯০ দশকের বাংলা চলচ্চিত্রে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন একটা মিথের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে বিয়ের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিচারের আশা করা কিংবা অপমান সইতে না পেরে অথবা প্রতারিত হওয়ার বেদনা সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়াটা একটা চলচ্চিত্রিক ফর্মুলা বলা যায়। এইসব চলচ্চিত্র থেকে তরুণী দর্শকরা সচেতন হয়েছেন তেমনটা বলা যাচ্ছে না। এখনো গণমাধ্যমের সর্বাধিক পঠিত সংবাদের শীর্ষে থাকে ধর্ষণ শব্দ ব্যবহৃত সংবাদ শিরোনাম। কেননা ধর্ষণের সংবাদ পুরুষদের গোপনে গোপনে উত্তেজিত করে।

কেন নারীরা বিয়ের প্রলোভন জয় করতে পারেন না? পারেন না কারণ বিয়ে এক ধরনের সামাজিক চাপ। এই সমাজে বিয়েকে মনে করা হয় সর্ব রোগের মহৌষধ, সব সমস্যার সমাধান। বৈবাহিক চুক্তিতে রয়েছে পারস্পরিক নিরাপত্তার জন্য প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। তার খানিকটা নান্দনিক, বাকিটা অর্থনৈতিক। বাস্তবে বিয়ে পুরুষের দায় বাড়ায়, আর নারীর বাড়ায় দাম। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় যে তাদের প্রকৃতি পুরুষের বিপরীত; নারীরা নিয়ন্ত্রণ করবে না, তারা আত্মসমর্পণ করবে অন্যের নিয়ন্ত্রণের কাছে। সব ধরনের নীতিশাস্ত্র শেখায় যে পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণই তাদের কর্তব্য। আর্থিক জীবন, সামাজিক উপযোগিতা, বিয়ের মর্যাদা প্রভৃতিতে আছে যে- সুবিধাজনক স্থান, তাতে নারীরা উৎসাহ বোধ করে । নারীকে নিজের অস্তিত্বের ভার নিজে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তাকে কখনো বোঝানো হয় না। তাই সে সানন্দে নিজেকে অর্পণ করে কিছু না করে আত্মসিদ্ধির আশায় মোহিত হয়। তাই হয়তো বিয়ে নামক প্রথায় প্রায়ই দ্বিগুণ স্নায়বিক চাপের মূল্যে পৌঁছোনো হয় এই মীমাংসায়, যেখানে নারীটি বোধ করে পুরুষটি তাকে সুলভ মূল্যে পেয়েছেন এবং পুরুষটি মনে করে নারীটির দাম অত্যন্ত বেশি।

প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে কি ধর্ষণ বলা যায়? বিয়ের কিংবা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীকে যে যৌন ব্যবহার করা হয় গণমাধ্যম তাকে মোটা দাগে বলে দিচ্ছে ধর্ষণ। যদিও আইনি ভাষায় প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ হিসেবে আখ্যায়িত করাই যায়। ধর্ষণ কী? ধর্ষণ একটি অপরাধমূলক যৌনসঙ্গম। বিভিন্ন ধরনের ধর্ষক রয়েছেন সমাজে। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের উপাদানগুলো হচ্ছে- নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সম্মতি ব্যতীত, মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে, ভুল বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যদি মেয়েটির বয়স ১৪ বছরের কম হয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনানুযায়ী, যদি কোনো পুরুষ বিয়ে ছাড়া ষোলো বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর অসম্মতিতে বা ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণামূলকভাবে সঙ্গমের সম্মতি আদায় করে, ষোলো বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করে, তাহলে তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে বিবেচিত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এর ৯ ধারামতে ধর্ষকের শাস্তি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড। এছাড়াও অর্থদণ্ডও রয়েছে। এছাড়াও পুলিশ হেফাজতে যদি কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তবে হেফাজতকারীদের সর্বনিম্ন ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। 

একজন নারী বা শিশু ধর্ষিতা হবার পর আদালতে বিচার প্রার্থনা করলে বহুলাংশে নাজেহাল হয়ে থাকেন। তার যৌন জীবনের বিবরণ আদালতে ব্যক্ত করতে বাধ্য করা হয়। তদুপরি গোটা সমাজ তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। ধর্ষণকে যতটা না নারীর প্রতি সহিংসতা হিসেবে দেখা হয়, তার চেয়েও বেশি সামাজিক নৈতিকতা, নারীর শারীরিক পবিত্রতা, সম্মান, সম্ভ্রম, সতীত্বের কাঠামোর মধ্যে দেখা হয়। এবং এই বাস্তবতায় ধর্ষণ মামলাগুলো প্রায়ই ভিকটিমের চরিত্র হরণের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

ভিকটিমের বিগত যৌন ইতিহাস নিয়ে কথোপকথন ও জিজ্ঞাসাবাদের সংস্কৃতি চালু থাকার দরুন শতকরা ৯০ ভাগ মেয়ে শিশু ও নারী ধর্ষণ মামলার অভিযোগ আনতে ভয় পান। কেউ কেউ মামলা মাঝপথে বন্ধ করে দেন। ধর্ষণের শিকার মেয়ে শিশু ও নারীদের টু ফিঙ্গার্স টেস্ট নামে একটি বিতর্কিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এখনো বহাল আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পরীক্ষাটির কেতাবি নাম পার ভ্যাজাইনাল টেস্ট হলেও এটি টু ফিঙ্গার্স টেস্ট নামে প্রচলিত। এতে ধর্ষণের শিকার মেয়ে শিশু বা নারীর যোনিতে চিকিৎসক আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে কতগুলো সিদ্ধান্ত জানান। বিশেষ করে নারী বা শিশুটি শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত টানেন চিকিৎসক।

একটা সমাজ কতটা সভ্য, তা নির্ভর করে ওই সমাজের মানুষ কতটা নিরাপদ, তার ওপর। ধর্ষণ সংবাদের শিরোনামই বলে দেয় যে এটা এখন নিরবিচ্ছিন্ন ঘটনা। সমাজ নারীকে সতীত্ব নির্মিত মিথ্যে ধারণা দিয়ে বড় করে। একটি মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে বড় করা হয় যে নারীর জীবনে সতীত্বই হলো আসল। তাহলে সতীত্ব জিনিসটা কী? সতীত্ব সমাজ নির্মিত একটা মিথ। প্রতিটি যৌন নিপীড়নের দায় নিতে হয় নির্যাতিতাকে। সমাজে নির্যাতকের কোনো লজ্জা নেই, সেই সমাজে সব লজ্জা নির্যাতিতার। নারীকে বোঝানো হয়, অপমানের জীবনের চেয়ে মৃত্যুই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এই অপমানটা যারা করলেন, সমাজ একবারও মুখ ফুঁটে তাদের বারণ করেনা। পরিবার ধর্ষণের মামলার আসামিকে বাঁচাবার জন্য দক্ষ আইনজ্ঞ নিয়োগ দেয়। অথচ নারীকে সম্মান করার শিক্ষাটা পরিবার থেকে পাওয়ার কথা ছিলো। নারীরা সেক্স অবজেক্ট নয়। একজন মেয়েকে কি কেবল শারীরিকভাবে ধর্ষণ করা হয়? বরং রোজ মানসিকভাবেও ধর্ষিত হতে হয়। ধর্ষণকে অবশ্য অনেকেই অপরাধ বলে ভাবে না। না এদেশে অনার কিলিং নেই, যা আছে তার নাম পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া।

ধর্ষণের শিকার মেয়েটি কেমন থাকে? একটি ধর্ষণের ঘটনা ততদিনই আলোচিত থাকে যতদিন অন্য আরেকটি ঘটনা না ঘটে। ধর্ষণ এখন সামাজিক মাধ্যমেরও আলোচনার বিষয়। আমরা তো বিচার চেয়ে ক্লান্ত হয়ে দু-চার কলম লিখে দেশ উদ্ধার করে ফেলি। কিন্তু যার সাথে এই ঘটনা বাস্তবে ঘটে, তারপর কী কী ঘটে যায় তার জীবনে, সেই খোঁজ কেউ রাখে না। বরং নিরাপদ দূরত্বে থেকে চলে আহা-উহু! তাতে কী আসে যায় যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েটির। নির্যাতিত নারীর জীবনটা বন্দি হয়ে যায় কফিনে। পরিবার সেই কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়। জগতে পারিবারিক অসহিষ্ণুতার মতো অসহনীয় আর কী আছে?

আসলে অসুস্থ চিন্তার কদর্য উপস্থাপনের নামই ধর্ষণ। কেউ জোর করে ধর্ষণ করেন, কেউ সুযোগ বুঝে, কেউ প্রলোভনে ফেলে আর কেউবা বিপদের জাল বিছিয়ে। প্রতিবছর অন্তত ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে ধর্ষণের শিকার নারীদের সংখ্যা। সমাজটা বদলে সবাই আসে না। বরং সবাই মিলে প্রাচীন প্রথা ধরে রাখতে চায়। মানুষই পারে খুব যুক্তি দিয়ে অযৌক্তিক কথা বলতে। আমরা সংস্কৃতির চেয়ে ঘটনার বিরুদ্ধে বেশি দাঁড়াই। যৌন নির্যাতন সংস্কৃতির বিপক্ষে জোরালো হোক কণ্ঠস্বর। অবশ্য যারা নিজের পৌরুষ নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাদের থেকে আর কেউ নারীর প্রতি বেশি আক্রমণাত্মক বা বিদ্বেষ পরায়ণ নয়। অবশ্য নারীরা যা তীব্রভাবে ঘৃণা করেন, তা তারা সততার সাথে প্রত্যাখ্যানের চেষ্টা করেন না। 

লেখক
সহকারী অধ্যাপক
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ,
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : মতামত

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //