কভিড-১৯ কেড়ে নিলো আরো একটি মূল্যবান প্রাণ। বেসরকারি সংস্থা সিদীপের (সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন এন্ড প্র্যাকটিসেস) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় গত ২২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন দেশের উন্নয়নক্ষেত্রে আপন কর্ম-গৌরবে ভাস্বর এক ব্যক্তিত্ব। চিন্তাশীল সমাজকর্মীদের মাঝে ছিলেন অগ্রগণ্যদের একজন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তিনি এ দেশের সেইসব পথিকৃৎদের সারিতে যারা দান-অনুদান, ত্রাণ, বিদেশি সাহায্য, নির্দেশিত উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদির ওপর আস্থা হারিয়ে নতুন পথের সন্ধান করে সাহসের সাথে এগিয়ে যান। অগ্রগণ্য পথিকৃৎদের অনুসরণে তিনিও বুঝতে পারেন যে, গ্রামপ্রধান এ দেশের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটির বিচ্ছিন্ন সমাধান নেই, তা বহুমুখী সার্বিক জীবনের অংশ।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার মৌল চিন্তাটি ছিলো আত্মনির্ভরতা। শুরুতেই তিনি বুঝতে পারেন অনুদান, ত্রাণ, বিদেশি সাহায্য ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদে মানুষের উন্নতিকে সাহায্য করে না, বরং প্রকারান্তরে তাকে আরো পরনির্ভর করে তোলে। ফলে ওইসব ক্ষণস্থায়ী উদ্যোগ মানুষকে একসময় আরো শোষণ ও দমনের শিকার করে তোলে। উন্নয়ন প্রচেষ্টা বলতে তিনি বুঝতেন পিছিয়ে পড়া মানুষের শক্তিকে একত্র করা ও তাদের নিজ পায়ে দাঁড়ানো। এই মৌল দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে গ্রামের দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ মানুষের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে টেনে আনে। তবে কেবল ক্ষুদ্রঋণের ক্ষুদ্র ঘেরাটোপে আটকে ছিলো না তার ব্যতিক্রমী ভাবনা। ক্ষুদ্রঋণকে তিনি সার্বিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার একটামাত্র অংশ মনে করেছেন।
নিজের উন্নয়ন সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি গ্রামের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় সহায়তার কথা ভাবেন। ভাবেন তারা স্কুলে ভর্তি হলেও বড় একটা অংশ দিনেদিনে ঝরে পড়তে থাকে কেন। এরকম কিছু ছেলেমেয়ের সাথে কথা বলে বুঝতে পারেন বাড়িতে নিরক্ষর বা কর্মব্যস্ত মা-বাবা তাদেরকে পড়ালেখায় কোনো সহযোগিতা করতে পারেন না। অথচ প্রাথমিক স্কুলেও নানা ধরনের সংকট।
ভাবেন, যদি স্কুলের পর বাড়িতে কেউ তাদের স্কুলের পড়াটা তৈরি করে দেয়, শিখিয়ে দেয়, এসব শিশুও পিছিয়ে থাকবে না, তারাও ক্লাসে ও পরীক্ষায় ভাল করবে। সেজন্য গ্রামের কয়েকজন শিক্ষিত স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ও গৃহবধূর সাথে কথা বললেন। তাদের উৎসাহে ২০০৫ সালে চালু করেন তার শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি যার আওতায় গ্রামেরই উন্মুক্ত উঠানে বা বাগানে একজন স্থানীয় শিক্ষিত মেয়ে কিছু প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছেলেমেয়েকে স্কুলের পড়া তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব নেন। এভাবে এখন ১৯টি জেলায় সংস্থার সব কর্ম-এলাকায় প্রায় ৬০ হাজার গ্রামের শিশু এ সহযোগিতা পেয়ে পড়ালেখায় ভালো করছে। বর্তমানে এ কর্মসূচির সাথে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রকৃতি পাঠ, প্রবীণ সংবর্ধনা ইত্যাদি অনেক কিছু যুক্ত হয়ে একে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়ের স্কুলের পড়া তৈরি করে দেয়ার এ মডেলটি পরবর্তীতে দেশের অনেক এনজিও অনুসরণ করে ও তাদের মতো করে আরো বিস্তৃতভাবে এ ধরনের কর্মসূচি চালু করে। সব মিলিয়ে এখন বহু গ্রামে কোনো বেসরকারি সংস্থার পরিচালনায় এরকম শিক্ষাকেন্দ্রে সারা দেশের বহু শিশু পড়ালেখায় সহায়তা পাচ্ছে, যা প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়া কমিয়ে আনতে ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়াও নানমুখী প্রচেষ্টার ফলে একসময়কার পিছিয়ে পড়া শিশুরাও এখন সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং সৃজনশীল মেধা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারছে। ২০১৫ সালে এই উদ্ভাবনী চিন্তা ও কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তার সংস্থা ‘শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা’ হিসেবে দশম সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার লাভ করে।
গ্রামের দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের দোরগোড়ায় কীভাবে স্বল্পমুল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া যায় তা নিয়ে তিনি অনেক দিন ধরে ভাবছিলেন। এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারদের সহায়তায় একটি স্বাস্থ্যকর্মসূচি তার সংস্থায় চালু হলো। কিন্তু তা সফল হলো না। এরপর তিনি SACMO অর্থাৎ উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তাদেরকে পূর্ণ নিয়োগ দিয়ে নতুন করে এ কর্মসূচি চালু করলেন। যা সাফল্য লাভ করে ও গ্রামপর্যায়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে সংস্থার সব কর্ম-এলাকায় এ কর্মসূচি চালু যা থেকে কর্মজীবী পিছিয়ে পড়া নারী-পুরুষ-শিশু তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ পাচ্ছে।
কয়েক বছর আগে তিনি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের নাচ-গান ইত্যাদি শেখার ও চর্চার জন্য ঢাকায় একটি স্কুল শুরু করেছিলেন, যা অবশ্য পরে নানা কারণে বন্ধ করে দিতে হয়। প্রান্তিক কর্মজীবী মানুষের জীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও সেসবের সমাধান নিয়ে তিনি ভাবতেন এবং একজন কর্মবীর হিসেবে বিভিন্ন সময়ে তার কিছু সমাধানে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। গ্রামের বার্ধক্যে উপনীত মানুষ যাতে স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক আনন্দ লাভ করে বেঁচে থাকে ও কারো অবহেলার শিকার না হয় সেজন্য তিনি একটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগের চিন্তা করছিলেন। যাতে আমাদের গ্রামজীবনে প্রবীণ-প্রবীণার প্রতি সম্মান দেখানোর প্রচলিত রীতি-সংস্কৃতির সাথে পশ্চিমী সংগঠিত চেষ্টার একটা মেলবন্ধন করে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়। পোষাকশিল্পের নারী শ্রমিকরা যাতে স্বল্পমূল্যে দুপুরের ও রাতের খাবার কিনে খেতে পারে সেকথা ভেবেছিলেন অনেক দিন।
মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার একটি শিশুর মতো মন ছিলো, শিশুদেরকে তিনি ভালবাসতেন ও তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশে যেতে পারতেন। তার ছিলো অদম্য জ্ঞানতৃষ্ণা ও বই পড়ার ইচ্ছা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা ও পথের সন্ধান করতেন। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তিনি ছিলেন গভীর অনুরাগী, আবার দেশে বিজ্ঞানচর্চা প্রসারের জন্য অত্যন্ত উৎসাহী। তবে প্রায় সব কাজই তিনি করতে চাইতেন নীরবে, ঢাকঢোল না বাজিয়ে। নিজেক সহজে সামনে তুলে ধরতে চাইতেন না, আর সে কারণেই জনসমাজে তিনি তার সতীর্থদের চেয়ে অনেক কম পরিচিত।
তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন মোহাম্মদ ইয়াহিয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহপাঠীদের সাথে মিলে বোমা তৈরির অভিযোগে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক আটক হন ও বন্দি অবস্থায় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। এসব কথার কিছু আগামী প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর-উপন্যাস ‘একাত্তরের হজমিওয়ালা’ বইতে চিত্রিত করেছেন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী ও লেখক আশরাফ আহমেদ।
তিনি ছিলেন একজন ভালো লেখক। ঘোরপ্যাঁচ না করে সরলভাবে সহজ ভাষায় তিনি লেখায় তার মনের কথা প্রকাশ করতেন। শিশুদের জন্য ‘মহাকাশে মহাজয়’ শীর্ষক একটা বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী লিখেছেন। ‘কষ্টের অতল ধ্বনি’ তার একটি কবিতার বই। শিক্ষা বিষয়ে আমার সাথে যৌথভাবে সম্পাদিত তার দুটি সংকলন-গ্রন্থ হচ্ছে: ‘আমাদের শিক্ষা: বিচিত্র ভাবনা’ ও ‘আমাদের শিক্ষা: নানা চোখে’। পরিকল্পনা ছিলো তার সাথে ভবিষ্যতে আরো কিছু সৃজনশীল কাজের।
হাসিঠাট্টার এক সহজাত ক্ষমতায় ঋদ্ধ ছিলেন তিনি। সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা মেরে ও মানুষের সাথে মিশে থেকে সময় কাটাতে চাইতেন। সে কারণে তার সংস্থার কার্যালয়ে প্রায়ই বিভিন্নরকম গান-কবিতা-কৌতুক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ, ঈদ এরকম নানা উপলক্ষে। আমি যখন সংস্থার শিক্ষাবিষয়ক বুলেটিন ‘শিক্ষালোকে’ যারা লিখেন ও নানাভাবে যেসব লেখক-শিল্পী এর সঙ্গে জড়িত তাদেরকে নিয়ে একটা আড্ডা আয়োজনের প্রস্তাব দিলাম, সাথে সাথে তিনি তা লুফে নিলেন। তার উৎসাহ ও উদার সহযোগিতার ফলেই আমার পক্ষে এ পর্যন্ত তিনটি ‘শিক্ষালোক লেখক-শিল্পী সম্মিলন’ আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে। যেখানে কথা, গান, আবৃত্তি, কৌতুক ইত্যাদিসহ দিনভর আড্ডায় মেতে উঠেছেন ঢাকার বিভিন্ন লেখক, শিল্পী ও বিদগ্ধজন। তাদের চিন্তায় সমৃদ্ধ হয়েছি আমরাও।
আগামী লেখক-শিল্পী সম্মিলনে তাদের অনেকের চোখ হয়তো মাঝেমাঝে ভিজে যাবে তার বন্ধুত্বময় প্রাণবন্ত উপস্থিতির অভাবে। তারপরও তিনি সবসময় আমাদের মনের মাঝেই থাকবেন। আর আমি কোনো নতুন চিন্তায় আলোড়িত হলে ও নতুন কিছু শুরুর কথা ভাবলে চারপাশের বাধাসমূহ উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার মূল্যবান প্রেরণা পাবো তার কাছ থেকে যেখানেই থাকুন তিনি।
মোহাম্মদ ইয়াহিয়া আর নেই, সত্য। কিন্তু আছে তার কাজ, উদার হাসি, আনন্দময় চোখ, সহানুভূতিময় কণ্ঠ ও নতুন পথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ার আহ্বান। সামাজিক ও মানব উন্নয়নের পথে তিনি সবসময় হয়ে থাকবেন প্রেরণার উৎস।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh