করোনাকালের প্রচারমাধ্যম

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী শিগগিরই দেশ থেকে করোনাভাইরাস বিদায় নেবে। করোনা বিষয়ে সাধারণ মানুষের গা-ছাড়া ভাব, নির্লিপ্ততা বা নির্ভয়ের দৃশ্য থেকে সেটি মনেও হচ্ছে। এটি হয়তো আশার কথা। 

কিন্তু মন্ত্রী-নেতা-আমলাসহ করোনাভাইরাস ইস্যুর সাথে সম্পর্কিত সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্য, কথাবার্তা, মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম এই করোনাকালে কী ধরনের সাংবাদিকতা করল বা করতে পারলো বা পারলো না, তার একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। 

অস্বীকার করার উপায় নেই, সাংবাদিকতা বরাবরই চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। করোনাভাইরাসের মহামারি সেই চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। সেটি শুধু হাসপাতালসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহের কারণে সাংবাদিকের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিই নয়, বরং এ রকম ক্রান্তিকালে যে ধরনের সাংবাদিকতা কাক্ষিত, তা হয়নি। বিশেষ করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সরকারি ভাষ্যের বাইরে গিয়ে সাংবাদিকের নিজস্ব অনুসন্ধানের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে কভিড-১৯ সম্পর্কিত নানারকম গুজব ও প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যেভাবে দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল, প্রচারমাধ্যম সেটি কতটা পেরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। 

করোনাভাইরাসে আয় কমে গেছে- এই অজুহাতে অনেক সংবাদমাধ্যম থেকে অসংখ্য কর্মী ছাঁটাই হয়েছেন। অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের বেতন ঝুলে গেছে। ঈদের বোনাসও পাননি অনেকে। ফলে নিজের চাকরি ও মজুরি নিয়েই যখন অনিশ্চয়তা, তখন সেই সাংবাদিকদের কাছ থেকে কতটা বস্তুনিষ্ঠ, সাহসী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করা যায়? 

অন্যের অধিকার নিয়ে সর্বদা সোচ্চার থাকা এই মিডিয়াকর্মীদের অধিকার নিয়ে অন্য কোনো পেশার মানুষ কখনো ভাবে না বা তাদের ভাববার অবকাশও নেই। যেকোনো পেশার মানুষ বিপদে পড়লে প্রথম ফোনটা একজন পরিচিত সাংবাদিককে করেন, অথচ সেই সাংবাদিকের যখন চাকরি থাকে না বা বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তখন সেই সাংবাদিকের সামনে একজন সিনিয়র সহকর্মী কিংবা কোনো সাংবাদিক সংগঠনের সাথে আলাপ করা ছাড়া ওই অর্থে কোনো পথ খোলা থাকে না। ফলে বছরের পর বছর ধরে একদিকে ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ এবং অন্যদিকে চাকরির অনিশ্চয়তার ভেতরে থাকেন যে পেশার মানুষ, তারা করোনাভাইরাসের মতো একটি আন্তর্জাতিক সমস্যাকালে কতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে পারবেন- যেখানে করোনাভাইরাসের ইস্যু নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যেও ক্ষমতার খেলা চলে- তা বলাই বাহুল্য।

করোনাকালে যে ধরনের সাংবাদিকতা মানুষ প্রত্যাশা করেছে বা করছে, সেটির পথে প্রধান অন্তরায় ছিল মৃত্যুভীতি। অন্যান্য বড় ঘটনার ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা যেমন ঘটনাস্থলে সরাসরি উপস্থিত থেকে সত্য বের করে আনার চেষ্টা করেছেন বা করেন, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভব হয়নি আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুঝুঁকির কারণে। 

স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনেকেই ঘটনাস্থল যেমন হাসপাতাল, মর্গ ও কবরস্থানে গিয়ে সংবাদ কাভার করলেও সব প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের জন্য এটি অনুমোদন দেয়নি। দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকের প্রধান শক্তি যে সূত্র বা সোর্স, করোনাভাইরাসের কারণে সেসব সোর্সের কাছেও সাংবাদিকদের পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সরকারি অফিস মাসের পর মাস বন্ধ থেকেছে; খুললেও সেখানে কর্মী উপস্থিতি ছিল কম। ফলে সাংবাদিকদের পক্ষে সরকারি ভাষ্যের বাইরে গিয়ে নিজস্ব অনুসন্ধানে রিপোর্ট করার সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। 

যারা সুযোগ পেয়েছেন তারা করেছেন ও এখনো করছেন। তা সত্ত্বেও যেহেতু প্রচারমাধ্যম এখন এক ধরনের বড় অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আরো নানাবিধ সংকটের ভেতর দিয়েই তাকে যেতে হচ্ছিল। ফলে নিজেদের বিবিধ সংকট, ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে কাহিল দেশের মূলধারার সব মিডিয়ার পক্ষেও কাক্ষিত সাংবাদিকতা করা যে সম্ভব হয়নি, তা আশা করি কেউ অস্বীকার করবেন না। 

তার মানে বস্তুনিষ্ঠ, সাহসী, সৎ ও জনআকাক্ষার মিডিয়া চাইলে আগে সাংবাদিকের নিজের চাকরি ও বেতনের নিশ্চয়তা থাকতে হবে; তার নিজের ভেতরে পেশাদারিত্বের চর্চা থাকতে হবে। কিন্তু যারা মনে করে মিডিয়া শক্তিশালী হলে অপরাধ করে পার পাওয়া কঠিন হবে, তারা সব সময়ই চাইবে এটি দুর্বল থাকুক এমন সব সংকটে এটি খাবি খেতে থাকুক, যেন অন্যের সমস্যা নিয়ে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টাও না করতে পারে।

এই সময়কালে কতটা নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা হচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাংলাদেশের সাংবাদিকতা যে একটা ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, সেটি বেশ বড় পরিসরেই দৃশ্যমান হয়েছে। টেলিভিশন-পত্রিকাসহ সব মাধ্যমকেই ইন্টারনেট দুনিয়ায় অনেক বেশি সময় দিতে হয়েছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণের পদ্ধতিও পাল্টে গেছে। শুধু অডিও নয়, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের স্মার্টফোনের মাধ্যমে ভিডিও করিয়ে তা দিয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। অনেক সাংবাদিক বিভিন্ন বিষয়ে তাদের পরিচিতজনদের নির্দেশনা দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রচারের উপযোগী অডিও-ভিজ্যুয়াল সংগ্রহ করেছেন। টকশোতে টেলিভিশনের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া। অনেক মূলধারার মিডিয়াও সোশ্যাল মিডিয়াকে টকশোর বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফলে ডিজিটাল দুনিয়ায় এই যে বিরাট একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো, এতে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সক্ষমতা পরীক্ষার সুযোগ পেলো- এটি করোনাভাইরাসের অবদান। পক্ষান্তরে শারীরিক বা জনদূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে প্রচারমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে জনবিচ্ছিন্নও হয়েছে।

মিডিয়াবিষয়ক ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স বলছে, করোনাকালে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশের মতো বাংলাদেশেও সাংবাদিকদের ওপর খড়গ নেমে এসেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর যে খড়গ নেমে এসেছে, তা করোনাভাইরাসে নয়; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা এসেছে সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে (আরএসএফ, ৮ এপ্রিল ২০২০)। 

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিউজরুমে নানামুখী চাপ ও ক্ষমতাসীনদের চাপ ছাড়াও বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আরো দুটি সমস্যার মুখোমুখি। এক. অর্থাভাব, চাকরিচ্যুতি ও করোনাভাইরাসের প্রভাবে সৃষ্ট মন্দাভাব এবং দুই. একের পর এক সাংবাদিকের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়া। আবার করোনাভাইরাস বিষয়ক সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে হামলা ও মামলার নামে সাংবাদিকদের হয়রানির শিকার হওয়ারও অনেক ঘটনা ঘটেছে। ত্রাণ চুরি ও প্রশাসনের সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশ ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য অন্তত আট সাংবাদিকের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

স্বল্প পরিসরে করোনাকালের সাংবাদিকতা নিয়ে সব কথা নিশ্চয়ই বলা সম্ভব নয়। ফলে এই প্রত্যাশা করাই বাঞ্ছনীয় যে, করোনাকালের সাংবাদিকতা: বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা হবে। অথবা এ ধরনের কাজ হয়তো চলছেও। আমরা বরং সেই গবেষণার ফলাফল দেখার প্রত্যাশায় থাকতে পারি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //