করোনাকালীন পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রসঙ্গে

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করলো। যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩০ হাজার কোটি টাকা (৪১%), ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ২০ হাজার কোটি টাকা (২৭%), রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা (১৮%), রপ্তানি পণ্য পরিবহনে ৫ হাজার কোটি টাকার (৭%) ঋণসুবিধা ও রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পরিশোধে ৫ হাজার কোটি টাকা (৭%) আপৎকালীন প্রণোদনা বরাদ্দের ঘোষণা পেলাম। কথা উঠল কৃষিখাত ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কই? তখনি ত্বরিতগতিতে সরকার কৃষিখাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলো। 

স্বাস্থ্যখাতের কথাটা আর গেরাজ্জি করলো না। এখানে কথাটি যদি এমনভাবে বলা হয় আশা করি ভুল হবে না যে, সর্বসাকুল্যে সরকারের এই প্রণোদনার শতকরা ৮৭ ভাগেরও বেশি অর্থ চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে, বাকি মাত্র ১২ থেকে ১৩ ভাগ অর্থ কৃষক, শ্রমিকদের স্বার্থে ব্যয় হবে। অথচ আমার মতো অনেকে আশা রেখেছিলো এ মুহূর্তে সরকার দেশের গরিব অসহায় মানুষদের জন্য অন্তত চল্লিশ বা পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখবে। কথা হচ্ছে এতগুলো টাকার ভাগীদার এই ব্যবসায়ীশ্রেণী কারা? এরাই কি তারা নন যারা ভারী ভারী পোশাক কারখানার মালিক, তারাই আবার কেউ মন্ত্রী, কেউ উপদেষ্টা, কেউ মেয়র, কেউ কাউন্সিলর ইত্যাদি। যাদের ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে, বিএমডব্লিউ গাড়ি আছে, পাঁচ তারকা হোটেল আছে। কৃষক, শ্রমিকদের জন্য যে সামান্য অর্থ বরাদ্দ সেটাও তাদের হাতে পৌঁছাবে কিনা তাতে সন্দেহ থেকে যায়। 

প্রধানমন্ত্রী বললেন চুরি করা চলবে না, তাতে চুরি কি আর থেমে থাকবে? চোর কি আর সন্ন্যাসী বা চাটুকার কারো কথা শোনে? সরকারি দলের নেতাকর্মীদের চাল চুরির কথাটাই চিন্তা করুন। যেখানে পাকিস্তানের সরকারও পারলেন ফোনে ফোনে মানুষের কাছে টাকা পৌঁছে দিতে, অথচ আমাদের সরকার তা পারলেন না।

পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি-এ কথাটা আসলে কতোটুকু সত্যি সেটা যাচাই করার এখনি আশা করি উপযুক্ত সময়। বর্তমানে এ খাতে ৪০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে এই কথাটির ব্যাপক প্রচার রয়েছে। প্রচার নেই যে পোল্ট্রি শিল্পে ৫০ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে কিংবা প্রায় একই পরিমাণ কর্মসংস্থান আছে দেশের ডেইরি ফার্মগুলোতে। সর্বসাকুল্যে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান রয়েছে দেশের প্রায় অর্ধেক কর্মজীবী মানুষের। যে পোশাকশিল্প নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি, সেখানকার প্রতি ১০ জন নারী শ্রমিকের ৮ জনই রক্তস্বল্পতায় ভোগেন, ৮৭ শতাংশ ঋণগ্রস্থ, ৪৩ শতাংশই দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির শিকার, অধিকাংশেরই তিনবেলা খাবার জোটে না। গ্রাম থেকেও বহুলোক শহরে আসে পোশাক কারখানায় কাজ করতে। 

অথচ সামান্য কিছু অর্থসাহায্য পেলে তারা নিজ নিজ বাড়িতে পোল্ট্রি বা ডেইরি ফার্ম করে নির্দ্বিধায় ভালো চলতে পারতো। তখন তাদের এমনভাবে রক্তশূন্যতা, অপুষ্টি, অনাহারের সম্মুখীনও হতে হতো না।পোশাকশিল্প এদেশে পুঁজিপতিদের স্বার্থে, শ্রমিকদের স্বার্থে নয়। একথা সত্যি দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অধিকাংশ আসে পোশাক শিল্প হতে। কিন্তু সেই রপ্তানি আয়টা দেশের স্বার্থের জন্য কতোটুকু সেটা জানা প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদ মাহা মির্জার মতে, দেশের বৈদেশিক আয়ের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় বৈদ্যশিক ঋণ পরিশোধে। যেটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেয়া কারসাজি নয় কি? তার মানে ব্যাপারটা এই যে স্থানীয় শিল্প হতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি প্রত্যাহার করে রপ্তানি শিল্পে ভর্তুকি দাও। অর্থাৎ যত পারো বিদেশে রপ্তানি করো, দেশের কৃষক-শ্রমিকের ভাত মেরে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দাও, ফলে জিডিপি বাড়াও। সেকারণে দেশে যে এতো এতো রপ্তানি আয় তা আসলে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর অর্থাৎ গণমানুষের স্বার্থে কাজে আসে না, স্বার্থটা এখানে রক্ষিত হয় দেশের গুটিকয়েক ব্যবসায়িক শ্রেণির। আর আমাদের ইকোনমিক গ্রোথের ধারাটা বজায় থাকলে বিশ্বের গরিব দেশগুলো বিশ্বব্যাংকে ও আইএমএফ থেকে যে ঋণগুলো নিয়েছে তা পরিশোধ করতে পারবে।

এই বিপদজনক অবস্থার ভিতরে দেশের ব্যাংকগুলো খোলা রয়েছে, চা বাগানের শ্রমিকরা কাজ করছে, পোশাক মালিকরা মুনাফার লোভে কারখানা চালু রাখছে, বিজিএমই শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করছে। অথচ ব্যাংকগুলো বন্ধ রেখে মোবাইল ব্যাংকিং-এর বিশেষ সুবিধার আওতায় জনগণের মাঝে ব্যাংকসুবিধা আজ নিশ্চিত করা যেত। মানুষের জীবনের থেকে প্রবৃদ্ধি কিংবা এই উৎপাদনের গুরুত্ব বেশি নয়, তাই শ্রমিকদের দিয়ে কলকারখানা, চা বাগানের কাজসহ তাদের সকল কাজ আপাতত বন্ধ রাখা জরুরি। সাথে সাথে তাদের অর্থসুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।

আমাদের দেশের করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডাক্তার রয়েছে। বিষয়টির মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতিতে ডাক্তারদের প্রতি রাষ্ট্রের যে চরম অবহেলা সেটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়। এই যে সরকারি তত্ত্বাবধানে কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষগুলো ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে না, সাধারণ রোগীরা সামান্য চিকিৎসাটুকু পাচ্ছে না এসবের দায়টা কার? তাই পরিস্থিতির ভয়াবহতা রুখতে ডাক্তারদের সার্বিক সুরক্ষাসহ সরকার হতে স্বাস্থ্যখাতে এখনি মানসম্মত বরাদ্দ দিতে হবে। উল্লেখযোগ্যহারে করোনার টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এছাড়া দরকার সরকারি-বেসরকারিখাত একীভূত হয়ে একটি সার্বজনীন ফ্রি চিকিৎসাব্যবস্থা।

সবকিছু সঠিকভাবে সম্পাদন করার জন্য দরকার একটি মানসম্মত নীতিমালা এবং তার যথাযথ কার্যকরকরণ। শুরু থেকেই আমরা অন্তঃসারশূন্য পলিসি নিয়ে চলছি, এখনো সেটাই বলবৎ রয়েছে। যখন বিদেশ থেকে লাখ লাখ লোক দেশে ফিরল পরীক্ষা ছাড়াই বহু মানুষকে ঘরে ফিরতে দেওয়া হল। ঢাকা থেকে দলে দলে শ্রমিক-কর্মজীবী মানুষ বাড়ি ফিরলো, একইভাবে আবার ঢাকায় ফিরে এলো। ধর্মীয় বক্তারা বললেন করোনা মুসলিমদের দুশমন নয়, সরকারের কেউ একজন বললেন তারা করোনার থেকেও শক্তিশালী। আজ তারই ফলশ্রুতিতে পুরো দেশ যখন করোনায় আক্রান্ত তখনও কেউ চিকিৎসা পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছেনা—কেউ খাবার পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। চলছে ১০ টাকার চাল নিতে মানুষের হাহাকার—হুমড়োহুমড়ি—ঠেলাঠেলি! সাহায্যের নামে নেতা-কর্মীদের জমকালো ফটোসেশন!

মনকে মন—টনকে টন চাল চুরির পাল্লাপাল্লি! কিছুদিন বাদে অনাহারে মানুষ মরার মিছিল শুরু হবে। সবে শুরু হওয়া মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ তার ইঙ্গিতমাত্র। ভয়াবহতা সামনে। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই এখনি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (যেমন তাদের দুই-তৃতীয়াংশ) ও কালবিলম্ব না করে এখনি প্রয়োজনীয় স্বেচ্ছাসেবক (চার থেকে সাড়ে চার লাখ বিবেচনা করা যেতে পারে) গঠন করে দেশের প্রতিটি গ্রামে, শহরের প্রতিটি মহল্লায় একসাথে কাজ করতে হবে। খাবার সরবরাহ (চালসহ সরকারি যেকোনো ত্রাণ/সাহায্য), রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছাতে আম্বুলেন্সসহ অন্যান্য সুবিধা, সাধারণ লোকের চিকিৎসাব্যবস্থা, হোম কোয়ারেন্টিন তদারকি, মানুষের আর্থিক অবস্থা ও প্রয়োজন সম্পর্কে জানা, ভ্রাম্যমাণ বাজার/নোঙরখানা চালুসহ মানুষের দেখভাল করার সব দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে। সে মর্মে

করোনাকালীন সময়ে দুইজন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুইজন করে স্বেচ্ছাসেবী গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি গ্রামে ও শহরাঞ্চলের প্রতিটি ওয়ার্ডে মোট চারজন করে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা যেতে পারে। গরিব অসহায় মানুষদের তালিকা অতিদ্রুত প্রস্তুত করতে হবে। যেহেতু পুরো প্রক্রিয়াটি নতুন করে করা সময়সাপেক্ষ। তাই বিবিএস-এর সর্বশেষ জরিপটাকে কাজে লাগিয়ে তালিকাটা প্রস্তুত করাই এক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত হবে। একটি বিশেষ ডিজিটাল পদ্ধতিও আমরা কাজে লাগাতে পারি। যেমন সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সারাদেশের ইউনিয়ন (গ্রামভিত্তিক)/ওয়ার্ড পর্যায়ে ফেসবুক আইডি খুলে তার মাধ্যমে কারা সাহায্য পেল (ব্যক্তির নাম), কি কি সাহায্য পেল (দ্রব্যের নাম), কি পরিমাণ পেল তার তথ্য প্রকাশিত হলে পুরো প্রক্রিয়াটির সুবিধা সবার হাতে হাতে পৌঁছানোসহ যেমন তার স্বচ্ছতা বজায় থাকবে, তেমনি নির্ধারিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও

স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ করতেও বিশেষ সুবিধা হবে। এছাড়া প্রশাসনিক স্তরের বাকিদের নিয়ে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক উদ্যোগে খাদ্যদ্রব্য ও কৃষিপণ্য সরবরাহ চেইন চালু রাখতে হবে। 

কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, খুজরা বিক্রেতাসহসহ নিম্মবিত্ত সকল শ্রেণির মানুষের জন্য নতুন করে আর্থিক বরাদ্দ ঘোষণা করতে হবে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য আপৎকালীন সুদবিহীন ঋণ প্রদান করতে হবে। ভাসমান ৪৫ লক্ষাধিক মানুষদের আলাদাভাবে খাদ্য ও অর্থসুবিধা দিতে হবে। এই সকল টাকাগুলো অবশ্যই মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছানো জরুরি। ভাসমান মানুষ ও অতি গরিব কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অর্থ সরাসরি তাদের হাতে পৌঁছানোর দায়িত্ব সেনাবাহিনীর মাধ্যমে করাই যথার্থ হবে। এছাড়া সামনে আগত সকল সমস্যা (যেমন বর্তমানে কৃষকের ঘরে বোরো ধান তোলা) এই মানুষগুলোকেই সর্বোত্তমভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন ধান কাটা- মাড়াইয়ের দেশীয় যন্ত্রপাতি ও কারখানাগুলোকে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া—কৃষকদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি, সরকার হতে এখনি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি তার ভয়াবহ রূপ নিতে বাধ্য।

লেখক: রাহুল বিশ্বাস

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //